কলমের খোঁচা

বিবেকানন্দ ও ধর্ম।


চিন্তন নিউজ, কল্পনা গুপ্ত: ১২ ই জানুয়ারি ২০২১- এই দিনটিকে আমাদের দেশে যুব দিবস হিসাবে পালন করা হয়। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। উত্তর কলকাতার ছেলে তিনি। বিবেকানন্দ ও ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর দর্শনের মূল কথার কিছু উল্লেখ করার প্রধান কারণ হলো এই যে, তাঁর জন্মের ১৫৯ বছর পরেও সমাজে তাঁর দার্শনিক ভাবধারা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের দেশে বা বিশ্বজুড়ে লক্ষ্য করা গেছে যে আদর্শ নিয়ে বা কোন একটা সংকল্প নিয়ে এমন কোন কথা বিঘোষিত হয় না যা মানুষকে অনিবার্যভাবে নাড়িয়ে যায়। বিবেকানন্দ সমস্ত মানুষকে, বিশেষত যুব সম্প্রদায়কে সেভাবে ডাক দিয়ে গেছেন। মানুষ গড়ার ইতিহাসে তিনি ধর্মের উপর আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন বলে যদি কেউ নিবৃত্ত হন তাহলে তা ঠিক হবে না। তিনি বলেছিলেন ধর্মকে সমাজের দায় বহন করতে হবে। মানুষকে জাগাতে চেয়েছিলেন সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে। তাই বিবেকানন্দকে বুঝতে গেলে এভাবে বুঝতে হবে।

১৮৯৭ সালে আমেরিকা থেকে ফিরে বিবেকানন্দ রামেশ্বর মন্দিরে একটি বক্তব্যে বলেছিলেন যে, মন্দির তৈরি করতে গেলে শুধু একটা গৃহ নির্মানই যথার্থ নয়, কয়েকটি মানুষ যারা নিঃস্বার্থ ও পবিত্র তারা যদি একজোট হয় তবে সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। গায়ে তিলক মাটি কেটে চিতা বাঘ সাজলেই শিবকে দেখা যায় না। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে দেখা- এইই হলো বিবেকানন্দের ধর্মের মূল কথা। একবার তিনি এক বিখ্যাত মন্দিরে গিয়েছেন, মন্দিরের দরজা দীর্ঘক্ষণ বন্ধ দেখে এক চিঠিতে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করেন – ” এই ঠাকুর খাবার খাচ্ছেন তো এই ঠাকুর পোষাক বদলাচ্ছেন আর মন্দিরের দ্বারে অসংখ্য নিরন্ন মানুষ। যে দেশে জ্যান্ত ঠাকুরের পূজা হয় না সেখানে জপতপ বৃথা। ” বিবেকানন্দের ধর্ম মানে মানুষের যন্ত্রণাকে, দুঃখকে, কষ্টকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে শেখা। এক গুরুভাইকে আমেরিকা থেকে চিঠিতে লিখছেন, বরানগরে অনেক দরিদ্র মানুষ আছে, একটা বড় চালা চাই, সেখানে তাদের নিয়ে আনা চাই। তারপর ম্যাজিক লন্ঠন দিয়ে, গ্লোব দিয়ে তাদের পড়াতে হবে। পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে তা জানাতে হবে। যদি তা পারো তবে বুঝবো তোমরা মরদ, আমার কাজে আসবে।

১৮৯৩ এর ১৯ শে সেপ্টেম্বর চিকাগো ধর্ম মহাসভায় বিবেকানন্দ সর্বজনীন ধর্ম ও সর্বজনীন মানুষের কথা ঘোষণা করেছিলেন যা পূর্বে হয়নি। তিনি বারবার বলেছেন ব্যাক্তিকে তার সংকীর্ণ গন্ডির বাইরে বেড়িয়ে বিরাটের মধ্যে এসে দাঁড়াতে হবে। বলেছেন সম্প্রসারণই জীবন, সংকোচনই মৃত্যু। বিরাট চেতনার প্রকাশই বিশ্বে শান্তি আনতে পারে একমাত্র। একটি হিন্দুকে বৌদ্ধ বা মুসলিম হতে হবে না, একজন বৌদ্ধ বা মুসলমানকে হিন্দু হতে হবে না। প্রত্যেকে তার নিজ ধর্ম স্বীকার করে তার মধ্যে থাকবে কিন্তু তার মধ্যে উন্নতির আসীম অবকাশ থাকবে। তিনি বলেছেন, ‘একত্বরূপ সেই এক ধর্মেরই বিবিধ প্রকাশমাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেইটিকেই সে বাছিয়া লইতে পারবে। আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম রূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই একমাত্র আশা। আমি মানসচক্ষে দেখিতেছি যে এই বিবাদ বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিয় দেহ লইয়া মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।’ বিবেকানন্দের সার্বজনীন ধর্মটি অসাধারণ। সেই ধর্ম উদারতার অনন্ত হাত বিস্তার করে পৃথিবীর সব মানুষকে আলিঙ্গন করবে। সে ধর্মে অসহিষ্ণুতা বা নিপীড়নের কোন স্থান নেই। তিনি সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের, বিশ্বমানবতার প্রতিনিধি। বিবেকানন্দ সব ভেদাভেদের গোড়া ধরে উপরে দিতে চেয়েছিলেন। এই ভাবনাটুকু আজকের ভারতে ভীষণ প্রাসঙ্গিক।

নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর আহ্বান – ” নতুন ভারত বেড়ুক। বেড়ুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে,জেলে, মালা,মুচি, মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে।… বেড়ুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। ঝোড়, জঙ্গল, পাহড়, পর্বত থেকে। এরা সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে,নীরবে সয়েছে আর তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। এরা একমুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উলটে দিতে পারবে।”

আজ ফুল খেলার দিন নয়, আজ তাদের সরিয়ে দেবার, হঠিয়ে দেবার দিন, যারা এই সাম্যবাদী সর্বত্যাগী সমাজতন্ত্রী সন্ন্যাসীকে কুৎসিতভাবে, লজ্জাজনকভাবে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নিজেদের মতো ব্যবহার করছে। যারা বিবেকানন্দের উক্তিকে সামনে পেছনে কেটেছেঁটে মানুষের কাছে তুলে ধরছে -তাদের চিনে, তাদের বয়কট করে, তাদের অসাধু ধর্মীয় ভেদাভেদের, সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর ও সমাজের নির্যাতিত, নিপীড়িত দলিত সম্প্রদায়ের উপর অমানবিক আচরণের উদ্দেশ্যকে প্রতিহত করার দিন এসেছে। তাই এই যুদ্ধে সামিল হতে গেলে বিবেকানন্দের মতন মনীষীর জীবন দর্শনের সাথে সঠিক পরিচয় হওয়া দরকার। বিবেকানন্দ চর্চা জীবন চর্যায় জল সিঞ্চন করলেই হবে যুব দিবসের সার্থকতা।
বিবেকানন্দের জন্মদিনে চিন্তনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হলো সংক্ষিপ্তভাবে তাঁর দর্শনের প্রতি আলোকপাত করে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।