কলমের খোঁচা

শিশুশ্রম: এই লক ডাউনের কালে গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ:১২ই জুন:- গত শতাব্দীর তিনের দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি আগামী পৃথিবীতে কি ধরণের সমস্যা আনতে পারে তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা ক্রমশঃ দানা বাঁধতে শুরু করে। শিশুশ্রমে গরিব দেশগুলি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির দরুণ কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে- এই ভাবনা চিন্তা ও সেই সময়কাল থেকেই তীব্র হতে শুরু করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে পরিবার পরিকল্পনা একটি আশু সমাধান- এই ভাবনার পক্ষে সেই সময়ে ইউরোপে একটি বড়ো ধরণের সামাজিক আন্দোলন তৈরি হয়।
ইউরোপের এই আন্দোলনের এক নেত্রী ১৯৩৬ সালে গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করে জনসংখ্যাবৃদ্ধি রোধে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁর তাঁর অভিমত জানতে চান। এই মতামত চাইবার উদ্দেশ্য ছিল, পরিবার পরিকল্পনা ঘিরে আন্দোলনে গান্ধীজীর সমর্থন পাওয়া। আলোচনাতে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি ভারতের দারিদ্রের অন্যতম প্রধান কারণ- এটা স্বীকার করে ও পরিবার পরিকল্পনার ভাবনার সঙ্গে সহমত পোষণ করতে পারেন নি গান্ধীজী।তাঁর সুপারিশ ছিল, বিবাহিতদের ব্রহ্মচর্য আর নিরাপদ সময়ের সঠিক ব্যবহার( তেন্ডুলকর- চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৫)।
শিশুশ্রম ঘিরে আজকের গোটা বিশ্বের ভাবনা চিন্তা, সেই ভাবনা চিন্তার শরিক হয়েও আমাদের দেশ, আমাদের দেশের মানুষদের ভাবের ঘরে চুরির বিষয়টি যেন গান্ধীজীর এই অবৈজ্ঞানিক , প্রায়ান্ধকার কথার গহীনে লুকিয়ে আছে। জয়প্রকাশ নারায়ণের পত্নীর স্মৃতিচারণে তাঁর বিবাহিত জীবনে গান্ধী আশ্রমে এই ব্রহ্মচর্য ঘিরে পরবর্তী জীবনের হাহাকার হয়ত অনেকেই জানেন। সেই জানার ভিতর দিয়ে বোঝা যায় , বিজ্ঞান, প্রকৃতির প্রবণতার বলপূর্বক বিরুদ্ধাচারণ আর তার পাশাপাশি আমাদের মতো গরিব দেশে একটা বড়ো অংশের মানুষদের ভিতরে সন্তানকে, তা সেই সন্তান যে বয়সেরই হোক না কেন, তাকে একটা কাজে ‘ জুতে ‘ দিয়ে একটু সাংসারিক সাশ্রয় প্রবণতা বিষয়গুলিকে।
অধুনা প্রয়াত বাংলা সাহিত্যের এক খ্যাতনামা অধ্যাপকের নীচের ফ্ল্যাটে থাকতেন এককালের আগুণখেকো অতি বাম নেতা। সেই অধ্যাপকের শ্যালক ছিলেন নিবন্ধকারের বন্ধু। ফলে উপরের ফ্ল্যাটে যাতায়াতের দৌলতে নীচের ফ্ল্যাটে আগুনখেকোর পত্নীর শিশু ‘ কাজের মেয়ে’ র উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার কিছু কিছু দুর্ভাগ্য হয়েছিল। বাসন ভেঙেছে বলে সেই বাচ্চা মেয়েটিকে প্রবল শীতের রাতে বাইরে বের করে দিতেন ওই প্রাক্তন আগুনখেকো পত্নী। বাচ্চাটির গায়ে হাত তোলা তো ছিল ওদের বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রাক্তন নেতাটিকে একটি দিন ও তার ‘অতি ভালো’ বলে লোকের কাছে পরিচিত পত্নীর বাড়ির ‘কাজের লোক’ , সেই শিশু শ্রমিকটির উপর ধারাবাহিক শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার ঘিরে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে সেই আবাসনের একজনও আবাসিক শোনেন নি। ওই নেতা এখন যখন বুদ্ধিজীবী হয়ে মোদি- মমতার ঔচিত্য শেখাতে বামপন্থীদেরই মতাদর্শগত সংঘাতকে একমাত্র আশ্রয় করেন, সভা সমিতিতে তুফান তোলেন, তখন আর বিরক্তি না, ঘেন্না লাগে। চরম ঘেন্না লাগে।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষাব্দে এসে ও আমরা দেখছি গোটা বিশ্বে শিশু শ্রমের বিভৎসতাকে। আমাদের রাজ্যে কতখানি খারাপ অবস্থায় আমরা আছি শিশু শ্রমকে ঘিরে তা এই লক ডাউনের ক্রান্তিকাল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।আর এই প্রেক্ষিতেই বার বার মনে হচ্ছে, অভিজিৎ তরফদারের সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘ কুসুমনগরে’ পরিবার পরিকল্পনা ঘিরে সরকারী হাসপাতালের পরিকাঠামোর মর্মান্তিক ঘটনাক্রম গুলিকে।
সঞ্জয় গান্ধীর ‘নাসবন্দি’ আমাদের সামাজিক জীবনে কি ভয়ঙ্কর একটা সঙ্কট ডেকে এনেছিল, তার স্মৃতি ধরে রাখা প্রজন্ম এখন প্রায় বায়োলজিকাল কারণেই নেই। নতুন প্রজন্মের সামনে সেইসব বিভৎসতাকে আজকের প্রজন্মের রাজনীতিকেরা ও নানা কারণেই সে ভাবে তুলে ধরেন না। এই না তুলে ধরার প্রেক্ষিতের ভিতরেই বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অজানা থেকে যায় বলপূর্বক নাসবন্দি আর তাকে ঘিরে রাজনৈতিক হিন্দুদের ভয়ঙ্কর সামাজিক অপপ্রচারের দিকটিও। তাই এখনো গোটা ভারতের মতোই বাংলার ও আর্থ- সামাজিক ভাবে পিছিয়ে তোলা মানুষদের কাছে দেশের অর্থনীতির সার্বিক বিপর্যয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি ঘিরে কোনো তাপ উত্তাপের পরিবেশই সেভাবে তৈরি হয় নি। তাই আজও আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষেরা সন্তান একটু চলতে ফিরতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই সেই সন্তানকে আয়ের একটা উৎস হিশেবে দেখতে শুরু করে।আর এই ভয়ঙ্কর সামাজিক সঙ্কটের পথ ধরেই রাজনৈতিক হিন্দুরা মুসলিম জনসংখ্যা ঘিরে আজগুবি তত্ত্বের উপস্থাপনা করে।এই ভাবে তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ‘ সাম্প্রদায়িকতা’ কে প্রতিষ্ঠিত করে।
বহু রাজনৈতিক – সামাজিক ঘূর্ণায়মানতার পরেও শিশু শ্রমের বিষে আমরা বুঝিবা নীলকন্ঠ হয়ে আছি।কৌতুকে করুণায় নয়, গ্রাম বাংলাতে বামপন্থীদের শাসনপাটের প্রথমাব্দে শিশুশ্রমের ভয়াবহ ছবি অভিজিৎ তরফদারের ‘ কুসুমনগরে’ আছে।সেই প্রেক্ষিত বাম শাসন কালের দীর্ঘপ্রবাহের পর পরিবর্তিত শাসকদের প্রায় দশ বছরের শাসনকালে ও তেমন কিছু যে রদবদল হয় নি লক ডাউন যেন চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে।
ঘরে তো খাবার নেই। এই ‘ নেই’ টা করোনা কালে তো ভয়াবহতার শেষতম সীমানাতে এসেছে। তাই শিশু যখন চায়ের দোকান, সাইকেল গ্যারেজ , এমন কি চোলাইয়ের ঠেকে কাস্টমারদের ‘মাল’ পৌঁছে নিজের পেট ভরানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তখন তার প্রতি বিশেষ সহানুভূতি দেখানোর মতো আর্থিক পরিকাঠামো টুকুও তার মা বাপের নেই। তাঁরা চাইলেও পারে না এই দুর্দিনের , আকালের সময়কালে সন্তানের অসহায়তাকে একটু বিশেষ সহৃদয়তার সঙ্গে দেখতে।
অমলেন্দু চক্রবর্তী মানবতা এই মহাসঙ্কট লগ্নকে ধরেছিলেন তাঁর ‘ আকালের সন্ধানে’ তে।শিশুশ্রমের প্রত্যক্ষ প্রতিচ্ছবি সেখানে না থাকলেও অর্থনেতিক সঙ্কট, বিশেষ করে খাদ্য সঙ্কট কি ভাবে গোটা জনজীবনে একটা গ্রহণকাল নিয়ে আসে তার মরমী উপস্থাপনার ভিতর দিয়ে তিনি দেখিয়েছিলেন মনুষ্যত্বের সঙ্কটকে।সঙ্কটের ব্যাপ্তি আজ আমাদের গোটা সভ্যতাকে কোন স্তরে এনে ফেলেছে, করোনাকাল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েদিল।যন্ত্রণার বিষয়, এই ক্রান্তিকালে না সরকার, না সামাজিক সংগঠন- কারো পক্ষ থেকেই শিশু শ্রমের অন্তর্ভূক্ত শিশুদের এই সময়কালের চরম যন্ত্রণা ঘিরে কেউই কার্যত কোনো ভূমিকা পালন করল না। শিশুদের সুরক্ষার জন্যে সরকারী স্তরে বেশ কিছু সংস্থা আছে।সেগুলির কাজ কার্যত শৌখিন মজদুরি।এমন কি এন জি ও দের পৃষ্ঠপোষকতা করা ওই সব সরকারী সংস্থা গুলির একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশির ভাগ এন জি ও ই এই শিশু শ্রমের বিষয়টিকে নিজেদের টি আর পি বৃদ্ধির একটা সহজ পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মৈত্রেয়ী দেবীও নেই।গৌরী আইয়ুবও নেই। তাঁদের হাতে গড়া ‘খেলাঘর’ ও ভেঙে গেছে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।