বিশেষ প্রতিবেদন : মল্লিকা গাঙ্গুলী: চিন্তন নিউজ:৮ই ফেব্রুয়ারি:– অতি সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা হিমবাহ ধসের যথার্থ কারণ বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে এটি নিছক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। ভারতবাসী কোন অপদার্থ সরকারের অধীনে বাস করে তাও প্রমাণ করে রবিবারের এই হিমবাহ ধস।
রবিবারের ঘটনার অকুস্থল গাড়োয়াল হিমালয়ের পশ্চিমে ঋষিগঙ্গা পূর্বে গোরিগঙ্গা উপত্যকার মাঝে চামোলি জেলায় অবস্থিত ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম নন্দাদেবী পর্বত, আর নন্দাদেবী অভয়ারন্য ও ঋষিগঙ্গার মাঝে বিরাজ করে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার একশ আট মিটার উচ্চতায় উত্তর নন্দাদেবী ও দক্ষিণ নন্দাদেবী এই দুভাগে বিভক্ত ১৯ কিমি করে দীর্ঘ দুটি হিমবাহ। এই হিমবাহ গলা জলে পুষ্ট নদী ঋষিগঙ্গা যা পরে ধৌলিগঙ্গা নাম নিয়ে অলকানন্দা নদীতে মিশেছে। ধৌলিগঙ্গার তীরে যেমন যোশীমঠ,করণপ্রয়াগ তেমনি অলকানন্দা অববাহিকায় ভারতের বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র তথা পর্যটন কেন্দ্র শ্রীনগর, হরিদ্বার, রানীখেত, ভীমতাল ইত্যাদি অবস্থিত।
বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির দেশ ভারতবর্ষ ও বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়নের কবলিত। উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব পরে হিম অঞ্চলে। কারণ উষ্ণতা বরফ গলিয়ে দেয়। ২০১৯ সালেই বিশ্ব পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে ভারত, চীন,নেপাল ও ভুটান সীমান্তে দ্রুতগতিতে বরফ গলছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জমুয়া ম্যুরের জানিয়েছিলেন, গত চার দশক ধরে অতিমাত্রায় হিমালয়ের বরফ গলছে, কাজেই মানুষকে সচেতন হতেই হবে। কিন্ত দরজায় টোকা দিয়ে প্রকৃতি বারবার “সতর্ক হও” জানান দিলেও মানুষের কর্ণপাত নেই। বিশেষজ্ঞ মহলের সমস্ত প্রকার সাবধান বাণী উপেক্ষা করে আশু লাভের আশায় মানুষ প্রাকৃতিকে নানা ভাবে অপব্যবহার করে চলেছে, যার কুফল বারবার সামনে আসছে, গত রবিবারের বিধ্বংসী হিমবাহ ধস যার অতি সাম্প্রতিক প্রমাণ।
২০১৭ সালে বিশ্ব পরিবেশ বিজ্ঞানীরা হিমালয়ের হিমবাহের গলন সম্পর্কে চূড়ান্ত সাবধান বার্তা জারি করে বলেন, হিমাচল অঞ্চলে নতুন কোনো বিদ্যুত প্রকল্প গড়ে তোলা কোনো ভাবেই সঠিক হবে না। অথচ প্রশাসনের চরম অবহেলা আর শিল্পপতিদের মাধ্যমে অর্থ লাভের আকাঙ্খার শিকার চামোলীর তুষার ধ্বসের ভয়াবহতা, স্বচক্ষে দেখলো সমগ্র ভারতবাসী। এই সমীক্ষক দলের প্রাজ্ঞ বিজ্ঞানী প্রদীপ শ্রীবাস্তব ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “আমাদের পরামর্শ ও মতামত সরকারকে বোঝাতে আমরা অক্ষম।”
পার্বত্য অঞ্চলের নদী প্রকল্প গড়ে তোলার আগে প্রশাসন পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কোনো মতামত মানতেই চায়নি। ভারতের হিমবাহ চরিত্র ও অবস্থান বোঝার মতো তেমন কোনো সংস্থা তৈরি করায় হয়নি, ডব্লিউ, আই, এইচ, জি নামে যে প্রতিষ্ঠানটি ছিল তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন বিজ্ঞানীরাই প্রশ্ন তুলেছেন যে সব নদীপথে হিমবাহ বয়ে আসে সেখানে বিদ্যুত প্রকল্প গড়ে ওঠে কি ভাবে? প্রকল্প গড়ে তোলার আগে হিমবাহের চরিত্র সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক ছিল, তবু কেন উত্তরাখন্ড সরকার সমস্ত বিধি নিয়ম অস্বীকার করে এন টি পি সি কে বিদ্যুত তৈরির ছাড়পত্র দিল এর জবাব প্রশাসনকেই দিতে হবে।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নন্দাদেবীর তুষার ধসে অলকানন্দা ও ধৌলগঙ্গা তীরবর্তী বহু গ্রাম ভেসে গেছে, বিশেষ করে ঋষিগঙ্গার এন টি পি সি এর বিদ্যুত প্রকল্পে সকালের শিফটে কর্মরত ১৫০ জন এবং আরও ২০\২৫ জন তরতাজা মানুষ নিখোঁজ, তারা জলের তোড়ে কোথায় ভেসে গেছে তার ঠিকানা পর্যন্ত নাই। এই মানুষ গুলি বেঁচে নেই ধরে নিয়েই সরকার কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন করছে। এই মানুষ গুলোর জীবনের দাম হিসেবে দু /চার লাখ টাকা সর্বহারা পরিবারের হাতে গুঁজে দিয়েই সরকার তথা শিল্প সংস্থা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাবে, কিন্ত এই বিপর্যয়ের দায় সরকারেরই একথা ভুললে চলবে না।
যে প্রকৃতি মানুষকে মায়ের মত লালন পালন করে সেই প্রকৃতির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মানুষেরই। কিন্ত নির্বাচিত সরকারের পাখির চোখ ভোট, তাই চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের ধ্বজা তুলতে গিয়ে বারবার সাধারণ মানুষকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একদিকে অশিক্ষিত নেতা-মন্ত্রীর প্রশাসনের অভিজ্ঞতা শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাব অপর দিকে অনিশ্চিত ক্ষমতায় থাকাকালীন আখের গোছানোর রাজনীতিই বিভিন্ন প্রকার পর্যয়ের সৃষ্টি করে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে চামোলীর এই হিমধস মনুষ্যকৃত।
প্রকৃতির স্নেহে সমগ্র জীবকুল নির্ভয়ে বাঁচতে পারে আর সেই প্রকৃতিকে যথেচ্ছ অপব্যবহার করলে তার রুদ্র রূপের শিকার হতে হয়। কিছু মানুষের অবিমিশ্রকারিতা আর সরকারের স্বার্থপর নীতি বারবার নিরীহ সাধারণ মানুষের জীবন হানি ঘটায়। চামোলির ঘটনায় বিশ্ব পরিবেশবিদদের সঙ্গে একজোট হয়ে জনগনের উচিত মুনাফালোভী প্রশাসনের এই অন্যায়, স্বার্থপর, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো।
আজকের স্লোগান হোক-
LIVE IN YOUR ENVIRONMENT
AND LET LIVE AND SAFE HER