কলমের খোঁচা

আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে — সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:১৯শে মে:- “ভিয়েতনামের মানুষ বিশ্বের ন্যায়বিচারের যোদ্ধা। তাদের সংগ্রাম মহাকাব্য। এটি সেই বীরত্বকে বারবার স্মরণ করায় যা মানুষ কোনো মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই সম্ভব করতে পারে। ” — বার্ট্রান্ড রাসেল

যুগপৎ অমর ও অম্লান এই মহাকাব্যিক, মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যাঁর জীবন ও কর্ম এক ও অভিন্ন তিনি সেই মুষ্টিমেয় যোদ্ধা ও বিশ্বজয়ী জননেতাদের মধ্যে একজন যিনি বারবার সোচ্চারে বলেছেন,“ যুদ্ধ পাঁচ, দশ, বিশ বছর বা তার বেশি সময় ধরে চলতে পারে। হ্যানয়, হাইফঙ ও অন্যান্য শহর ও কলকারখানা ধ্বংস হতে পারে। কিন্তু, ভিয়েতনামের জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করা যাবে না। স্বাধীনতা ও মুক্তির চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই।” তিনি ভিয়েতনামের মুক্তি আন্দোলনের মহান যোদ্ধা হো-চি-মিন। বিপ্লবী হো-চি-মিন। এক স্মরণীয় মহাকাব্যের নায়ক হো-চি-মিন। যিনি একাধারে মহামতি লেনিনের মার্কসীয় তত্ত্ব বিশ্লেষণের ও ব্যাখ্যার প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত ও আপ্লুত, স্তালিনের নেতৃত্বে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শরিক আবার চীনে বিপ্লবী সংগ্রামের সহায়ক এবং ফরাসী কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার দিন গুলিতে সক্রিয়, দক্ষ এবং সুযোগ্য একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক, একজন মহান আন্তর্জাতিকতাবাদী। আজ তাঁর ১৩১ তম জন্মদিবস। ১৯৬৮ সালের ২৩-২৯ ডিসেম্বর কেরালার কোচিতে অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি(মার্কসবাদী)’র অষ্টম কংগ্রেসে হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক শ্রেণী সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে উল্লেখ করা হয়, তার আগে ওই বছরেরই ২০-২১ নভেম্বর ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের পান্ডা, যুদ্ধাপরাধী রবার্ট ম্যাকনামারার কলকাতা আগমণে ক্রুদ্ধ হাজার হাজার ছাত্রের সম্মিলিত সোচ্চার প্রতিবাদে, ঘৃণায় কল্লোলিত হয় কলকাতা যা কিনা এরাজ্য, এদেশের সীমানা ছাড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের আন্তর্জাতিক আঙিনাকেও আলোড়িত করে। ১৯৬৯ সালের ২০ শে জুলাই দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারের স্বীকৃতির দাবীতে যুক্তফ্রন্টের ১১টি দল ও ৫২ টি গণসংগঠন ‘ ভিয়েতনাম সংহতি দিবস’ উদযাপন করে কলকাতায় বিশাল সমাবেশের মধ্যদিয়ে,১৯৬৯ সালের ৩ রা সেপ্টেম্বর বিপ্লবী হো-চি-মিনের জীবনাবসানের সংবাদ ৪ঠা সেপ্টেম্বর গভীর শোকের সঙ্গে গণশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁকে মহান আন্তর্জাতিকতাবাদী ও ভিয়েতনাম মুক্তি আন্দোলনের মহান নেতা অভিহিত করে সুতরাং হো-চি-মিনের সঙ্গে, সংগ্রামী, নির্ভীক ভিয়েতনামের সঙ্গে এদেশের প্রগতিপন্থার, বিশেষ করে এ বাংলার আরো যথার্থ করে বললে এ বাংলার প্রতিবাদী যৌবনের সম্পর্ক “ ইয়ংকীদের বোমার চেয়েও / অনেক শক্তিশালী।” তাই হো-চি-মিনের জন্মদিবস আমাদের কাছে একটু অন্য রকম বার্তা বহন করে নিয়ে আসে।

বর্তমান ভারতবর্ষে ভয়ঙ্কর মহামারীর হামলায় বিধ্বস্ত ভারতবাসীর বিশেষ করে শ্রমজীবি ভারতবাসীর অবর্ণনীয় দূরবস্থার মধ্যেও এমনকি রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ যখন আর রাখঢাক না করে তার ক্লেদাক্ত চেহারা প্রকাশ করছে প্রতিদিন, প্যাকেজের ছলনার আড়ালে এই দেশ কে পুরোপুরি ধান্দার ধনতন্ত্রের লুঠের উর্বর মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত করছে খোলাখুলি, নির্লজ্জতাকেও লজ্জিত করে তাও আবার জনউদ্ধারের নামে তখন এই নষ্টামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যেও আমাদের মার্কসবাদ লেনিনবাদের একজন সফল রূপকার হিসাবে বিপ্লবী শিক্ষক হো-চি-মিনের জীবন ও শিক্ষা নতুন করে অনুশীলন করা, আত্মস্থ করা দরকার ।
(২)
হিংস্র বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিরূদ্ধে,“লেনিন পরিচালিত ১৯১৭ সালে রুশ দেশের মহান অক্টোবর বিপ্লব ছিল প্রথম বিজয়, স্তালিনের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ ও হিটলারের বিরুদ্ধে লালফৌজ ও জনগণের সাফল্য ছিল দ্বিতীয় বিজয়, মাও- জে-দঙের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের চীনের বিপ্লব ছিল তৃতীয় বৃহত্তম সাফল্য এবং চতুর্থ বৃহত্তম বিজয় হলো ভিয়েতনামের মুক্তি। ” হো-চি-মিন ছিলেন স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, ভিয়েনামের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ফান সি’র উচ্চতা(৩১৪৩ মিটার) কেও ছাড়িয়ে যাওয়া সেই মহান মার্কসবাদী বিপ্লবী যিনি মার্কস ও লেনিনের বৈপ্লবিক ও বৈজ্ঞানিক মতবাদকে পরিশীলিত করে নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে সংশ্লেষিত করে সহস্র বছরের উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামের আগুনে পুড়ে ইস্পাত কঠিন ভিয়েতনামের মাটিতে প্রয়োগ করেছিলেন, এবং একে একে জাপান,ফরাসি ও আগ্রাসী আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামের মুক্তি হাসিল করেছিলেন। “Imagination is more important than knowledge. Imagination is the language of the soul.Pay attention to your imagination and you will discover all you need to be fulfilled” —Albert Einstein. সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে
অসমসাহসী সংগ্রামকে ভিয়েতনামের মাটিতে সম্পূর্ণ করার কাজে বিপ্লবী চেতনার সঙ্গে তার অসীম সৃষ্টিশীল কল্পনা শক্তির সম্পৃক্তকরণ ঘটিয়েই তাই হো-চি-মিন লেনিনবাদ সম্পর্কে বলতে পেরেছিলেন,“আমাদের দেশে এবং চীনে অলৌকিক ‘জ্ঞানকোষ’ সম্পর্কিত একটি লৌকিক উপকথা প্রচলিত আছে। কেউ কোন বড়ো সমস্যায় পড়ে এই বই খুললেই তারমধ্যে সমাধান খুঁজে পাবেন। আমাদের কাছে লেনিনবাদ সেই অদ্ভুত ‘জ্ঞানকোষ’ই মাত্র নয়,বরং লেনিনবাদ ভিয়েনামের বিপ্লবী জনগণের কাছে দিকদর্শন। আমাদের চূড়ান্ত জয়ের পথে অর্থাৎ সমাজতন্ত্র সাম্যবাদের পথে লেনিনবাদ আলোক বিচ্ছুরণরত এক অনির্বাণ জ্যোতির্ময় সূর্য”(যে পথ আমাকে লেনিনবাদে নিয়ে এল)। জাপান, ফরাসি এবং সর্বশেষ আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ গৌরবময় এবং দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের যেমন সুযোগ্য নেতা ছিলেন হো-চি-মিন। ঠিক তেমনি মারণ করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় সারা বিশ্বের মডেল আজকের সমাজতান্ত্রিক ভিয়েনামের মাটিতে সমাজতন্ত্রের সাবলীল গঠন প্রক্রিয়াতেও প্রতিভাধর বিপ্লবী নেতা হো-চি-মিনের লেনিনবাদের আলোকপ্রাপ্ত এবং অকল্পনীয় আত্মত্যাগে সংশ্লেষিত সৃজনশীল নেতৃত্বও তেমনি ইতিহাসের এক গৌরবময় উপাখ্যান।
(৩)
ভিয়েতনামের সহস্র বছরের উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামের পীঠস্থান নঘে আন প্রদেশের নামদান জেলার কিমলিন গ্রামে ১৮৯০ সালের ১৯ শে মে হো-চি-মিনের জন্ম। হো’র বিপ্লবী জীবনের অনুপ্রেরণা তাঁর পিতা নগুয়েন সিন সাক শৈশবে বাবা মাকে হারিয়ে দূর সম্পর্কিত এক আত্মীয়ের বাড়ীতে গৃহ ভৃত্তের কাজ নিয়ে যে অকথ্য,অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা ও অত্যচারের শিকার হয়েছিলেন তা তাঁকে দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি ও এই মুক্তির শর্ত হিসাবে শিক্ষার আলোক প্রাপ্তির প্রতিজ্ঞায় ঋগ্ধ করেছিলো। ক্রমশ বিপ্লবী কাজে জড়িয়ে পড়া সিন সাক তাঁর অসীম অধ্যাবসায়ে ভাষা, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি এই সমস্ত বিষয়ে শিক্ষালাভে ও জ্ঞানার্জনের প্রতিজ্ঞাকে সত্যিই বাস্তবায়িত করলেন ১৯০১ সালে তার ডক্টরেট ডিগ্রী লাভের মধ্য দিয়ে। সিন সাকের এই জেদ ও সংগ্রামের আগুনে আলোকোজ্জ্বল বহুমুখী ঘটনাবহুল জীবনশৈলী হো-চি-মিন তো বটেই তার বড় পুত্র খিয়েম এবং কন্যা নগুয়েন থান কেও অনিবার্য ভাবে প্রভাবিত করেছিল। হো-চি-মিনের বোন থান-য়ের কাজ ছিল গোপনে অস্ত্র সংগ্রহ করে বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। দিনের পর দিন এই কাজ করতে গিয়েই তিনি একদিন ধরা পড়েন এবং সুদূর কোয়াঙ গাই প্রদেশে তিনি নির্বাসিতা হন। কিন্তু সেখানেও “ অন্তসত্ত্বা মেয়েরা সন্তনের জন্ম দেয় আর তুমি জন্ম দাও বন্দুকের”এই অশ্লীল বাক্যবাণে বিদ্ধ থানের মুখ দিয়ে শত অবর্ণনীয় নির্মম অত্যাচারের পরেও বীরপুঙ্গব অত্যাচারীরা একটি কথাও বার করতে পারেনি বিপ্লবী দের সম্পর্কে। ঠিক যেমন ভিয়েতনামে রোমান হরফে দেশী ভাষা শিক্ষার প্রচলক হো’র দাদা খিয়েমও মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিয়ে নিদারূণ অত্যাচার সহ্য করেছিলেন দিনের পর দিন বীরের মতো কিন্তু কখনো আত্মসমর্পন করেন নি কাপুরুষের মতো। সুতরাং হোচিমিন তার শানিত চেতনার সুযোগ্য উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন তার আপন জন্মসূত্রেই। হো-চি-মিনের নিজের কথায়, “ আমি একজন বিপ্লবী। আমি যখন জন্মগ্রহণ করি তখন আমার দেশ দাসরাষ্ট্র। আমি যুবক বয়স থেকেই এর মুক্তি সংগ্রামে নিযুক্ত। এই আমার জীবনের ব্রত। ”
(৪)
সার জীবন জেলে বা আত্মগোপনে স্বদেশে বা বিদেশে অসহনীয় কষ্টের মধ্যেদিয়ে দিনযাপন করলেও এক মুহূর্তের জন্যেও এই ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি হো-চি-মিন। বিস্মৃত হননি এই বিশ্বাস থেকে যা তিনি আশৈশব বুকে লালন করেছেন,“স্বাধীনতার চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই।” বরং আমৃত্যু প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নেতৃত্বে থেকে এই বিশ্বাসের মর্যাদাকে তিনি সুরক্ষিত করে গেছেন। শুধু ভিয়েতনামের জনগণ নয় এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা তথা বিশ্বের সমস্ত দেশের নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষ এই বিশ্বাসকে প্রাথমিক সত্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং হো-চি-মিন কে পৃথিবী ব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামের একজন আন্তর্জাতিক নেতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। মার্কস এবং এঙ্গেলস বারংবার খুব জোরের সঙ্গে তাদের সমসাময়িক দের এটাই বোঝাতে চেয়ে ছিলেন যে, তাদের তত্ত্বটি অন্ধ বিশ্বাস প্রসূত কোনো “কঠোর বাধ্যতামূলক অনুশাসন” নয় এবং এই তত্ত্বের সাহায্যে সুদূর ভবিষ্যতে সামাজিক ব্যবস্থার অতএব কোনো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা তারা করেন নি, বরং তাদের তত্ত্ব টি সমাজ বিবর্তনের কিছু মৌলিক সূত্র যার সাহায্যে তাদের উত্তরসূরীরা, তাদের সুবিধামত সময়োপযোগী করে রাজনৈতিক তত্ত্ব সৃষ্টি করতে পারবে। তাঁর শিক্ষক, উপদেষ্ঠা, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ প্রদর্শক উজ্জ্বল নক্ষত্র মহামতি লেনিনের বিশ্ববিক্ষায় উদ্ভাসিত হো-চি-মিন, মার্কস এবং এঙ্গেলসের এই শিক্ষাকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামে এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন ভিয়েতনামে সমাজতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে একজন মহান চিন্তাবীদ ও প্রকৃত বিপ্লবী রাষ্ট্রনেতার ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে প্রয়োগ করেছিলেন। তাই হো-চি-মিন বলে ছিলেন,“ সমাজতন্ত্রকে কিছু নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্তর অতিক্রম করেই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এবং এই স্তর গুলিকে সেই দেশের ইতিহাস ও সামগ্রিক পরিস্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ হতে হবে। একজন যোগ্য নেতা ও জনগণের সত্যিকারের বন্ধুর দায়িত্ব একটি পরিচ্ছন্ন এবং শক্তিশালী জনগণের (কমিউনিষ্ট) পার্টি গড়ে তোলা যে পার্টি আক্ষরিক অর্থেই জনগণের সার্বিক স্বার্থ সুরক্ষাকারী জনগণের বিপ্লবী পার্টি হয়ে কাজ করবে, মহান জাতীয় ঐক্যকে এমন ভাবে প্রয়োগ করবে যা সমাজতান্ত্রিক মানুষ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। যে পার্টি জনগণের মধ্যে একাত্ম হয়ে জীবনের মধ্যদিয়ে প্রসারিত হয়েছে এমন সব ঐতিহাসিক শিক্ষাকে মূলধন করে মানবিক সভ্যতার যে মূল্যবোধ তাকে ক্রমাগত স্বচ্ছ করে জাতীয় চরিত্র গড়ে তুলবে যা কিনা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো মহত্তম সংগ্রামে নিজেকে মানসিক ও শারিরীক ভাবে বিলীন করতে সক্ষম। স্বাধীনতার আগে ও পরে ভিয়েতনামে অত্যন্ত যোগ্যতার এই কাজ টাই করেছিলেন হো-চি-মিন। যা আজো বিশ্বের বিস্ময়। ভিয়েতনামের শক্তির উৎস।
(৫)
উর্বর সমভূমি, বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চল, গভীর বনভূমি আচ্ছাদিত ভিয়েতনাম ; মেকং ও লোহিদ নদীর স্নিগ্ধ জলে অবগাহনকারী ভিয়েতনাম ; ধান, চা , কফি, ভুট্টা, চিনাবাদাম, কলা, আখ, নারকেল—উৎপাদনে সমৃদ্ধ ভিয়েতনাম ।এই ভিয়েতনামে প্রথম ইউরোপীয় হানাদার হলো পর্তুগিজ। কিন্তু পর্তুগিজ নয়, ১৮৮৩ সালের মধ্যে সমগ্র ভিয়েতনাম ফরাসি উপনিবেশে পরিণত হয়। দশ বছর পর ১৮৯৩ সালে লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম নিয়ে গঠিত হয় ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ইন্দোচীন ইউনিয়ন। হাজার বছর ধরে নানান হানাদারের মোকাবিলায় অভ্যস্ত ভিয়েতনাম এই দখলদারিত্বের গা জোয়ারিকে মেনে নেয়নি বরং এর বিরুদ্ধে বারে বারে জানকবুল লড়াইয়ে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। দীর্ঘস্থায়ী এই সংগ্রামকে সফল পরিণতির সোনালি সূর্য উদয়ের ইঙ্গিত দিয়েই ১৯২৫ সালে ফরাসি উপনিবেশ মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার সাহসী স্বপ্ন নিয়ে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের নতুন এক নেতার দেখা পেলেন ভিয়েতনামের জনগণ। তিনিই পরবর্তী কালে মুক্তি সংগ্রামের এবং মুক্ত ভিয়েতনামের পুনর্গঠনের বীর নায়ক হো-চি-মিন। তাঁর হাত ধরেই এই আন্দোলনের পুরোধা সংগঠন হো-চি-মিনের তৈরি যুবলীগের গর্ভেই জন্মনিল ইন্দোচীন কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৩০ সালে। ভার্সাই সন্ধির সমস্ত শর্ত হেলায় পদদলিত করে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ১৯৩৯ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। ফ্রান্স, বৃটেন যেমন এই যুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে অবস্থান করে তেমনি জার্মানি ও ইতালির এই দুই মিত্র শক্তির সঙ্গে ১৯৪০ সালে জাপান মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং এই মিত্রতার সুযোগ নিয়ে জাপান ইন্দোচীনে সৈন্য সমাবেশ ও বিমানঘাঁটি ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে অনধিকার প্রবেশ কে বৈধতা দেয় গায়ের জোরে এবং এই সুযোগে ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষের ওপর অহেতুক হামলা চালিয়ে নির্বিচারে হত্যালীলা সংগঠিত করতে থাকে ইতিমধ্যে জার্মানির কাছে পর্যুদস্ত ফ্রান্স জাপানের এই ভূমিকায় নীরবতার পথ নেয় । ইতিমধ্যে চীনে প্রবাশে হো-চি-মিন গঠন করেন কমিউনিস্ট দের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন ভিয়েতমিন যেখানে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যেকোন রাজনৈতিক মতাদর্শেরই সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল। এই ভিয়েতমিনের সদস্যদের নিয়েই ১৯৪৩ সালে জেনারেল ভো নগুয়েন গিয়াপ জাপানিদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেন গেরিলা যুদ্ধ । এবং অকল্পনীয় এই বীরত্বপূর্ণ গেরিলা যুদ্ধে গিয়াপের নেতৃত্বে ভিয়েতমিনরা জাপানের হাত থেকে উত্তর ভিয়েতনাম মুক্ত করে। ১৯৪৬ সালে ফ্রান্স ভিয়েতনামকে ইন্দোচীন ফেডারেশনের অন্তর্গত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকার করলেও ভিয়েতনামের দক্ষিণ অঞ্চল কে দখল করে রাখে। ফরাসী শক্তির উৎখাতে ভিয়েতমিনরা হ্যানয় আক্রমণ করে ইতিমধ্যে ১৯৪৯ সালে চীনের সফল বিপ্লব ভিয়েতমিন বিপ্লবীদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করে। ১৯৫৪ সালের ৭ ই মে ৫৭ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ফরাসী ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের শক্তিশালী ঘাঁটি দিয়েন বিয়েন ফু’র পতন হয় জেনারেল গিয়াপের নেতৃত্বে ভিয়েতমিনদের গৌরবজ্জ্বল লড়াইয়ের ফলে। ফরাসীরা এবার বাধ্য হয়ে জেনিভা চূক্তির মাধ্যমে ভিয়েতনামকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগকরে। তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেবল পরবর্তী সংগ্রামের সময় সঞ্চিত করার লক্ষ্যে হো-চি-মিন তা কৌশলগত কারনে সাময়িক ভাবে মেনে নেন। উত্তর ভিয়েতনামে বিপ্লবী সরকার গঠিত হলেও দুর্বল ফ্রান্সের জায়গায় দক্ষিণ ভিয়েতনাম ধীরেধীরে ক্রমশ আগ্রাসী আমেরিকার একক উপনিবেশে পরিণত হয়। এবার দক্ষিণ ভিয়েতনামকে আমেরিকার কবল মুক্ত করার জন্যে হো-চি-মিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট। ১৯৪৬ সালে ফরাসীদের বিরুদ্ধে যে বীরত্বপূর্ণ মুক্তি সংগ্রাম শুরু করেছিলেন ভিয়েতনামের মানুষ সেই ভিয়েতনামের মুক্তির অদম্য আখাঙ্কার সামনে রাসায়নিক মারণ গ্যাস, আকাশ থেকে মুড়িমুড়কির মতো বোম নিক্ষেপ, সীমাহীন নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে মহান আত্মত্যাগের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মার্কিনী ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদী’ আগ্রসনের শোচনীয় পরাজয়ের মধ্যদিয়ে ১৯৭৫ সালে পূর্ণাঙ্গ মুক্তির স্বাদ অনুভব করে সংগ্রামী ভিয়েতনাম ও তার সংগ্রামী জনগণ। যে সংগ্রাম শুরু করে অনেকখানি পথ পার করে দিয়ে গিয়েছিলেন সর্বার্থে সুযোগ্য নেতা হো-চি-মিন। আজ তাই বিপ্লবী হো-চি-মিনের ১৩১ তম জন্ম বর্ষে বিশ্বকবির কাছে আমাদের অশেষ ঋণ আরেকটু বাড়িয়ে আমরা ভিয়েতনাম তথা সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের পরম আত্মীয় হো-চি-মিনের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে বলতে পারি আর নিজেদের গর্বিত করতে পারি।—আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার/ চরণ ধুলার তলে। / সকল অহংকার হে আমার / ডুবাও চোখের জলে।

তথ্য সূত্রঃ হো চি মিন ও ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ-অনুনয় চট্টোপাধ্যায়, Contrmporary World Situation And Validity of Marxism, গণশক্তি সুবর্ণজয়ন্তী স্মারক সংকলন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস-প্রফুল্ল চক্রবর্তী, সিদ্ধার্থ গুহরায়, যে পথ আমাকে লেনিনবাদে নিয়ে এল-হো চ মিন


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।