কলমের খোঁচা

আমি সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহিঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।


মিতা দত্ত:চিন্তন নিউজ:২৭শে জুন:– একজন বুদ্ধিজীবীর প্রধান কাজ অনুসন্ধান, অনুশীলন ও জিজ্ঞাসার দ্বারা প্রতিনিয়ত তাড়িত হওয়া ও বিদ্যমান ব্যবস্থার ভুলত্রুটি তুলে ধরা এবং তার পরিবর্তনের জন্য সচেষ্ট হওয়া। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য সৃ‌ষ্টি ও কার্যাবলী পর্যালোচনা করে তারই সুলুকসন্ধানের একটা চেষ্টায় ব্রতী হয়েছি। যদিও আমার পক্ষে এই কাজ করা কতটা ঠিক জানি না। কিন্তু সব ব্যক্তিরই নিশ্চয় এই অধিকার ও স্বাধীনতা থাকা উচিত, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের নিজের চোখে দেখা ও সকলের কাছে তুলে ধরা।

১৮৩৮ সালের ২৬ জুন উত্তর চব্বিশ পরগণার নৈহাটির অন্তর্গত কাঁঠালিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে এই মহান পুরুষ পৃথিবীর আলো দেখেন। বেড়েও ওঠেন এই গ্রামে। ছোটোবেলায় তাঁর বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ দেখা দেয়। গ্রামের পাঠশালায় পাঠ শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনিই প্রথম গ্রাজুয়েট। আইনি বিভাগেও নিজের পারদর্শিতার পরিচয় দেন। ফলে সহজেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হয়েছিলেন। সেই সুবাদে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলায় তাঁকে কাটাতে হয়েছিল।চাকরির সাথে সাথে তাঁর সাহিত্য সৃ‌ষ্টিও চলতে থাকে।

তাঁর বয়স ২৪ বছর। প্রকাশিত হয় ‘দুর্গেশনন্দিনী’। ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাংলা সাহিত্যের সার্থক ও সফল উপন্যাসের অভাব পূরণ করে। আবার ১৮৭২ সাল থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘বঙ্গদর্শন’। বাংলাভাষার পাঠক প্রথম একটি সর্বাঙ্গসুন্দর পত্রিকার আস্বাদ পায়। ইতিমধ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের নতুনভাবে গদ্যের প্রকাশ শুরু হয়। দুঃখের হলেও সত্যি সেই সাহিত্যের ভাষা সাধারণের বোধ‌গম্যের ভাষা ছিল না। এককথায় লালনের ভাষা থেকে তার অবস্থান ছিল বহুদূরে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা ছিল সংস্কৃত ভাষার অনুসারী। তাই তাঁর লেখা সমাজের ওপর তলার লোকের কাছে কদর ছিল। ‘কমলাকান্ত’ ছদ্মনামে তিনি সাহিত্য সৃ‌ষ্টি করেছেন। ‘ঋষি’ উপাধিতে তিনি ভূষিত হয়েছেন। উপন্যাস, প্রবন্ধ ও বিভিন্ন গদ্যে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর প্রকাশ ঘটে। পাঠককূল চেটেপুটে তাঁর স্বাদ নেয়। কখনও কখনও তাঁর লেখনী যেন তৎকালীন সমাজের দর্পণ হয়ে ওঠে। জনগণ চমকিত হয়।

ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী নগ্নরূপ ক্রমশ প্রকটিত হয়। তার প্রভাব পড়ে প্রথমে কৃষককুলে ও সমাজের খেটে খাওয়া শ্রেণির ওপর। তারপর সমাজের সর্বশ্রেণির ওপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার নেমে আসে।অত্যাচারের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে যুবকবাহিনী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বদ্ধপরিকর হন। সেই আন্দোলনের মানসভূমি তৈরির ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মায়ের তিনটি রূপ তুলে ধরেন। এই মা হলেন দেশমাতা। দেশমাতা যে ব্রিটিশ শাসনে কালিমালিপ্ত হয়ে আছে এবং এই মাকে দশভুজায় রূপান্তরিত করতে হবে যুবকশ্রেণিকে, এই বলে যুবসমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে তোলেন। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘বন্দেমাতরম’ সংগীত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

যে মানুষটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মননক্ষেত্র রচনা করেন, সেই মানুষটি কিন্তু চুড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক ছিলেন, যার প্রকাশ পাওয়া যায় তাঁর লেখনীতে । ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসে তারই প্রকাশ ঘটেছে। আরো নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘বৃষবৃক্ষ’-এ, যা যন্ত্রণাদায়ক। এরকম একজন ব্যক্তির এই মানসিকতা সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পারে না।

তিনি মার্জারের মুখনিঃসৃত বাণী দিয়ে সমাজের অসাম্যের কথা তুলে ধরলেও তিনি অসাম্যের সমর্থক ছিলেন। তারঁ ‘সাম্যবাদী’ প্রবন্ধের অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হওয়ায় তিনি প্রবন্ধটির প্রকাশ বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, “আমি সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদনক্রমে নহি”। তিনি ‘কৃষক শ্রেণির দূর্দশা’ প্রবন্ধে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা কৃষকরা সমাজের তথাকথিত ওপরতলার দ্বারা শোষিত হয় বলার পাশাপাশি এটাও বলেন, “এটা লিখে আমি জমিদারদের সতর্ক করেছি।” তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে ছিলেন। তাঁর মতে, চিরস্থায়ী অচল হলে ব্রিটিশদের অসুবিধা হয়ে যাবে।

মীর মুশারফ হোসেন ‘জমিদারি দর্পণ’ নামে একটি নাটক লেখেন। সেটির মঞ্চস্থের জনপ্রিয়তা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি মন্তব্য করেন, এটি মুসলমানের গদ্য নয়, এর ভাষা উন্নত। কোনো লেখকের এই ধরনের মন্তব্য বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম বিরোধিতার সমালোচনা উঠেছিল। তার কারণ, তার সৃষ্টির মধ্যে প্রতীয়মান।

তিনি বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন, তবে তিনি সততার সাথে স্বীকার করেছেন। এখানেই হয়তো তাঁর জয়। কোনো রকম মুখোশের ব্যবহার করার প্রয়োজন বোধ করেননি।এই শিক্ষাই তিনি আমাদের দিয়ে গিয়েছেন।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।