দেশ

মাতৃভাষা রক্ষার জন্য নিজের প্রাণের বলিদান দেওয়া মহান একাদশ ভাষা শহীদকে শ্রদ্ধায় – স্মরণ


সেখ ইসরাইল:চিন্তন নিউজ:১৯শে মে:- #বাংলাভাষার একাদশ_ভাষা শহীদ… দুপুর দুটো পঁয়ত্রিশ। উনিশ মে ১৯৬১, ভারতের আসাম রাজ্যের মফস্বল শহর শিলচরের তারাপুর রেলস্টেশন। নিশ্চিত শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে সত্যাগ্রহ। তার আগে সত্যাগ্রহীরা পদযাত্রায় পরিভ্রমণ করেন শিলচর তথা বরাক উপত্যকার সমগ্র জনপদ। শিলচরের রেললাইনে পরস্পরে খোশগল্পে মশগুল। মাইকে একটানা বেজে চলছে— ‘মাতৃভাষার রাখিতে মান/জীবন দিতে হও আগুয়ান/নওজোয়ান নওজোয়ান।’ কিছুক্ষণ পরপর দৃপ্ত শপথে উচ্চারিত হচ্ছে— ‘মাকে মোরা আই বলবো না/জান দেবো জবান দেবো না/মানি না মানবো না/মাতৃভাষার অপমান সইবো না।’ বোধহীন শাসক সমুদ্রের গভীরতায় অজ্ঞাত, পর্বতের দৃঢ়তায় অন্ধ, ধাবমান জলের শক্তিতে দ্বিধাগ্রস্ত, ইতিহাসে অবিশ্বাসী আর সম্মিলিত মানুষের শক্তিতে আস্থাহীন। তাদের হঠকারী সিদ্ধান্তে ফিরে আসে রক্তস্নাত একুশ। রক্তের আখরে আর একটি মহাকাব্য রচিত হলো আমাদের দুঃখিনী বর্ণমালা বাংলায়। হঠাৎ গুলির শব্দে হতচকিত সবাই। সত্যাগ্রহীদের হৃদপিণ্ড বিদ্ধ করল শাসকের তপ্ত বুলেট। মুহূর্তেই শহীদ হলেন ১১ জন।
বোন কমলার চোখ ভেদ করে গেল ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেট। একটি গুলি এসে ভেদ করল শচীন্দ্র পালের প্রশস্ত বুক। রেল কর্মচারী কানাইলাল নিয়োগী জল আনতে গিয়েছিলেন গুলিবিদ্ধ সত্যাগ্রহীদের জন্য। তারও বুকে এসে বিঁধল গুলি। এমনিভাবে কুমুদ রঞ্জন দাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, হীতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সুনীল সরকার ও সতেন্দ্র দেব শহীদ হলেন। একে একে একটি বোন ও দশটি ভাই মাতৃভাষার উপাসনায় বুকে পেতে নিল শাসকের নির্দয় বুলেট। ভাষা জননীর বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করে সংগ্রামের আর এক নতুন ইতিহাস রচনা করল ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরের বাংলাভাষীরা।

কমলা_ভট্টাচার্য:

বাংলাভাষা সংগ্রামের একমাত্র মহিলা শহীদ। তার বয়স ছিল ১৬ বছর। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার পরপরই তিনি ভাষা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পিতৃহীন কমলা তার ভাই শ্রী রামরমণ ভট্টাচার্যের সাথে শিলচরের বিলপাড়ে অবস্থিত বাসায় থাকতেন। তাদের পরিবার ১৯৫০ সালে দেশ ভাগের বলি হয়ে সিলেট জেলা থেকে কাছাড়ে যায়।

শচীন্দ্র_পাল :

১৯ বছরের শচীন্দ্র পাল ছিলেন শ্রী গোপেশ পালের ৬ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। তিনি কাছাড় হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষার পরপরই যোগ দেন ভাষা আন্দোলনে। তাদের পূর্ব নিবাস ছিল হবিগঞ্জ মহকুমার নবীগঞ্জের সন্দপুরে।

কুমুদরঞ্জনদাস:

মৌলভীবাজারের জুড়ী থেকে বাস্তুহারা হয়ে কুমুদ রঞ্জন দাসরা শিলচরে যান। মায়ের মৃত্যুর পর কুমুদ ৮ বছর বয়সে ত্রিপুরায় মামার বাড়িতে থেকে এম ই পর্যন্ত পড়াশোনা করে গাড়িচালক হন। বৃদ্ধ পিতা, ৪ বোন ও ১ ভাইকে নিয়ে তাদের সংসারে কুমুদই ছিলেন একমাত্র উপার্জনকারী।

সুকোমল_পুরকায়স্থ:

করিমঞ্জের বাগবাড়ী গ্রামে ছিল সুকোমল পুরকায়স্থদের বাড়ি। তার পিতা শ্রী সঞ্জীবচন্দ্র পুরকায়স্থ ডিব্রুগড় শহরে ব্যবসা করতেন। বাংলাভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে সুকোমল জীবন দিয়ে মাতৃভাষার ঋণ পরিশোধ করলেন।

হীতেশ_বিশ্বাস:

হরিশচন্দ্র বিশ্বাসের বড় সন্তান ছিলেন হীতেশ বিশ্বাস। ১২ বছর বয়সে বাস্তুহারা হয়ে সিলেট জেলার হবিগঞ্জের ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ত্রিপুরার খোয়াই শহরে গিয়ে উদ্বাস্তু কলোনিতে বসবাস শুরু করেন। শিলচর শহরের অম্বিকা পট্টিতে ভগ্নীপতির বাসায় অবস্থানকালে ভাষা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে জীবনদান করেন।

বীরেন্দ্র_সূত্রধর:

বীরেন্দ্র সূত্রধর শৈশবেই বাস্তুহারা হয়ে পিতা নীলমণি সূত্রধরের সাথে নবীগঞ্জের বরহমপুর থেকে শিলচরে যান। ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি যে দিন শহীদ হলেন তখন তার ঘরে ছিল ১৮ বছরের বিধবা স্ত্রীর কোলে ১ বছরের মেয়ে রানী।

তরণী_দেবনাথ:

তার পিতা শ্রী যোগেন্দ্র দেবনাথ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্যামগ্রাম থেকে দেশভাগের সময় শিলচরে গিয়ে বয়ন ব্যবসা শুরু করেন। তরণী দেবনাথ শহীদের মৃত্যুবরণ করার প্রায় ৬ মাস আগে একটি বয়নযন্ত্র ক্রয় করে রাঙ্গিরখাড়ী অঞ্চলে জয়দুর্গা কলোনির ভিত্তি স্থাপন করেন। তার বয়স ছিল ২১ বছর।

কানাইলাল_নিয়োগী:

৩৭ বছর বয়সী কানাইলাল নিয়োগী ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়োগী ও শ্রীযুক্তা শান্তিকনা নিয়োগীর তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। ময়মনসিংহ জেলার খিলদা গ্রামে ছিল তার পিতৃভূমি। স্ত্রী, ২ ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে তিনি শহীদত্ব বরণ করেন।

চণ্ডীচরণ_সূত্রধর:

১৯৫০ সালে হবিগঞ্জের জাকরপুর গ্রাম থেকে উদ্বাস্তু হয়ে চণ্ডীচরণ সূত্রধর তার মামা সুরেন্দ্র সূত্রধরের সাথে শিলচরে যান। ভাষা আন্দোলনে তিনি যখন শহীদ হলেন তখন তার কোনো আত্মীয় শিলচর শহরে ছিল না। প্রতিবেশী স্বজনরাই তার শ্রাদ্ধাদি কাজ সম্পন্ন করেন।

সুনীল_সরকার:

শ্রী সুরেন্দ্র সরকারের ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে সুনীল সরকার ছিল সবার ছোট। দেশ বিভাগের বলি হয়ে ঢাকার মুন্সীবাজারের কামারপাড়া থেকে শিলচর শহরের নতুন পট্টিতে তারা বাসা বাঁধেন। সুনীল এমই পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন।

সত্যেন্দ্র_দেব:

শশী মোহন দেবের ৪ সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে সত্যেন্দ্র দেব। উদ্বাস্তু হয়ে তারা ত্রিপুরার নূতন রাজনগর কলোনিতে বাসা বাঁধেন। তিনি প্রাইমারি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। মাতৃভাষার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি জীবন দান করেন। তার বয়স ছিল ২৪ বছর।

ফাল্গুন পেরিয়েছিল মাস তিনেক আগে। তবু ফিরে আসে ফাল্গুন। থোকা থোকা রক্ত ফোঁটায়, শিমুলে, পলাশে আর কৃষ্ণচূড়ায়। শিমুলের রং লাল, পলাশের রং লাল, কৃষ্ণচূড়ার রং লাল, রক্তের রং লাল, দ্রোহের রং লাল— সেই লাল আগুন ছড়িয়ে পরে সারা বরাক উপত্যকায়। বরাক উপত্যকা থেকে সমগ্র আসামে। আর বরাক উপত্যকার সর্ববৃহৎ গণআন্দোলনে পরিণত হয় ভাষা আন্দোলন। এই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিরা প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাতে থাকে। আসাম রাজ্যের অহমিয়া ছাড়া অন্যসব জাতিগোষ্ঠী বাংলাভাষীর এই আত্মদান ও ভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে সংহতি প্রকাশ করেন, শ্রদ্ধা ও শপথে; ভাষার দাবি না আদায় করে তারা কেউ ঘরে ফিরে যাবে না। শিলংয়ের খাসিয়া সম্প্রদায়ের জনগণ এক বিশাল শোক মিছিলের আয়োজন করেন। আসাম বিধান সভা থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরিভাষী নন্দকিশোর সিংহ পদত্যাগ করেন। ভারতের জাতীয় সংসদে ভাষা শহীদদের সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত আসাম রাজ্য সরকার ভাষার প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। চব্বিশ অক্টোবর ১৯৬২ তে আসাম রাজ্যের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সরকারি ভাষা হিসেবে অহমিয়া এবং বরাক উপত্যকার (কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি) সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি লাভ করে। একটি বোন ও দশটি ভাইয়ের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় মাতৃভাষার অধিকার। মূলত একষট্টির ভাষা সংগ্রামই বরাকভূমিতে বাংলাভাষাকে মজবুত ভিত্তি দিয়েছে; দিয়েছে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার প্রেরণা ও শক্তি।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।