কলমের খোঁচা

কাজী নজরুল ইসলাম নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী ভাবনা  


লেখিকা : লালিমা চ্যাটার্জী: চিন্তন নিউজ:২৬শে মে:–   আমরা বাঙালী, আমাদের মননে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় রবিঠাকুর, অশনে- ব্যসনে কবিগুরু আবার ভাবের ঘরেও তিনি ( আজ অবশ্য সে ভাবের ঘরে ভন্ডামির আসর)—– এ হে হে হে, ভুলেই গেছি, আরে কলম ধরেছি তো দুখু মিঞার জন্য ( ধৃষ্টতা মার্জনীয়) —— সেই ছোট্ট বেলা থেকে আমরা বাঙালিরা শিখে থাকি, “” বলতো বাবা, বিদ্রোহী কবি কে? বলতে পারলে না তো, কাজী নজরুল ইসলাম, আর ভুলো না কিন্তু। “
    তারপর  একটি একটি করে শ্রেণী সোপান পার হয়েছি, কিন্তু নজরুল – চর্চা, নজরুল- চেতনা, নজরুল সংবেদনা সবটাই লাভ করেছে এক অমোঘ কক্ষপথ যা ঘূর্ণায়িত হয়েছে  সেই বহুশ্রুত বহুচর্চিত  উপাধিটিকে কেন্দ্রে রেখে —– বিদ্রোহী কবি নজরুল।
        আমরা সেই হতভাগ্য বাঙালী যারা কোনোদিন তাঁর এই বিদ্রোহের রূপরেখাটুকুর বিস্তারের খোঁজ নিইনি—– নজরুলের বিদ্রোহকে আমরা পরাধীনতার প্রতি বিদ্বেষ, শ্রেণী শোষণের প্রতি বিদ্বেষ, আত্মগ্লানি  মগ্ন বিদ্বেষের মধ্যে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করেছি, আজও করে চলেছি। তাই আজও নজরুল – যাপন অসমাপিত।
    আজ যদি বিদ্রোহী কবির বিদ্রোহময়তাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিমায় পেশ করি তবে হয়তো অপরাধ বোধের গ্লানি কিছুটা হলেও কমবে।
    
  নজরুলের বিদ্রোহী মনন আমরণ তার সঙ্গ ছাড়েনি। জীবনে যা করেছেন সব কিছুতেই  তাঁর এক অবাধ বিদ্রোহ জড়িয়েই থেকেছে। কবিতার ক্ষেত্রে তো আমরা তাঁর বিদ্রোহী সত্তার আলোচনায় অক্লান্ত। কিন্তু তাঁর জীবন চর্যায় যে “বিদ্রোহ ” তাঁকে প্রতিটা  আগল পেরোতে কতটা সাহায্য করেছিল “তার খবর কে রাখে?”
      শুধু দুঃখভারাক্রান্ততাতেই তাঁর দুঃখের শেষ হয়নি —- তার সঙ্গে কোপের পর কোপ হেনেছে দারিদ্র্য, অন্নাভাব, অর্থাভাব,  স্বজনবিয়োগের ব্যথা  সর্বোপরি আত্মজকে হারাবার কঠিন নিয়তি——-কিন্তু  চরম হতাশায় তলিয়ে যাবার ক্ষণে এই বিদ্রোহকেই আঁকড়ে ধরেছেন, যে বিদ্রোহ ছিল সম্পূর্ণ “আমি ” – র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহে যদি সেদিন জয়ী না হতে পারতেন, যদি নিজেকে এটা বোঝাতে না পারতেন যে হেরে যাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহই তাঁর একমাত্র হাতিয়ার তবে আজও তিনি নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে রাখার ক্ষেত্রে সার্থক হতেন না। তাই তিনি দাঁতে দাঁত চেপে খানসামা কাজ করেছেন, রুটির দোকানে অতি।সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করেছেন, মসজিদে মোয়াজ্জেমের কাজ করেছেন,নাটকের দলে যুক্ত হয়েছেন, সামরিক দলেও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।এই সামরিক অভিজ্ঞতা তাঁর মধ্যে জন্ম দিয়েছিল বিপ্লবের। আমরা এই বিপ্লবী মনটাকে তাঁর বিদ্রোহী মননের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। রাজনৈতিক বিপ্লবে বিশ্বাস জন্মেছিল অবচেতনার পরতে পরতে যা ছিল অবশ্যম্ভাবী  কিন্তু বিদ্রোহ সিঞ্চিত হয়েছিল  চরম সচেতনতার বাধ্যতায়। একজন মানুষ কতবড় বিদ্রোহী হলে আত্মজের মৃতদেহ দাফনের খরচ জুটিয়েছিলেন নিজের লেখনী বিক্রি করে —- তাঁর বিদ্রোহী মন সেদিন তাঁকে নিজের সৃষ্টিক্ষমতাকে পণ্য করে তোলার সাহস জুগিয়ে ছিল। ভিক্ষার অনিবার্যতাকে রুখে দিতে,  আপন সৃষ্টিশীলতাকে বিপনণে পরিণত করা বড়ো সহজ বিদ্রোহ ছিল না কিন্তু।
 
  রাজনৈতিক চেতনাগত বিদ্রোহ  বিস্তার খুঁজে পেয়েছিল সামাজিক  অবমাননাকর পরিস্থিতির বিরুদ্ধাচরণের মধ্যে —- তাই আপন ধর্মনৈতিক চেতনাকে এতটুকু ক্ষুন্ন না করে জাপটে ধরতে পেরেছিলেন সেই বিদ্রোহী মনটাকে, যে সাহস জুগিয়েছিল,  সমতার কথা বলতে, যে উদ্যত করেছিল ধর্মভাবনা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বিরুদ্ধে লেখনীকে শাণিত করতে আবার সেই বিদ্রোহী চেতনার চোরা স্রোত ফল্গুধারার মতো বয়ে গেছে তার সাঙ্গীতিক চর্চার মধ্যে দিয়ে —–ফলস্বরূপ  বিরোধ- বৈষম্যহীণ কবি সত্তা কখনো অনায়াস কৃষ্ণপ্রেমী — কখনো নিবেদিতপ্রাণ শাক্ত,কখনো প্রগলভ প্রেমিক, কখনো মগ্ন সুফীসাধক। তৎকালীন সাঙ্গীতিক পরিবেশে তাঁর বিদ্রোহী সত্তাই আপন অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার হয়ে উঠেছে— সুর রনণের আঙিনায়  রবীন্দ্রমগ্নতা সেদিন যে প্রভাব বিস্তার করেছিল তাকে ছাপিয়ে যাবার বৃথা বিদ্রোহে বিশ্বাস না রেখে তার পাশাপাশি আপন পদচারণার অভিঘাত রেখে যাওয়াতেই অধিক মনোনিবেশ করেছিলেন নজরুল —- নজরুল অনুরাগীদের শ্রুতিমার্গে অনায়াসে সেই পদচারণায় বিদ্রোহের নিক্কণ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে এ বিশ্বাস অস্বীকার করা অসম্ভব। তাই তো তাঁর প্রেম সাকারেই সার্থক — রবীন্দ্র পরবর্তী কবিগোষ্ঠীতে তাঁর নাম আমরা লিখেছি কিন্তু সত্যিই কি রবীন্দ্র বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রচারের আলোয় আনার কোনো প্রচেষ্টা তিনি কখনো করছেন কি?তাঁর সাঙ্গীতিক নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে আজো বহু গুণমুগ্ধ গবেষণারত। তিনি কত সহজে শরীরী প্রেমকে বর্ণায়িত করেছেন আবার স্বচ্ছন্দে তার উত্তরণ ঘটিয়েছেন অসীমের নীলিমায় —–  একদিকে বলেছেন ” ঘুমাও ঘুমাও দেখিতে এসেছি ভাঙিতে আসিনি ঘুম ———-  আমি নয় ওই কলঙ্কি চাঁদ নয়নে হেনেছে চুম” তখন তিনি  আদ্যোপান্ত প্রেমিক তাই  রাগের উপশমের আর্জি জানিয়েছেন সঙ্গে বলেছেন অপার্থিব অনুরাগ নয় রাগেই তাঁর অভিরুচি  ( শৃঙ্গারের শীৎকার এখানে অকপট)।আবার তিনিই  নবঘনশ্যামের মুখে বসিয়ে দিচ্ছেন, ” ও পথে চোর কাঁটা সখী তারে বলে দিও/ বেঁধে না বেঁধে না লো যেন তার উত্তরীয়/ এ বনফুল লাগি না আসে কাঁটা দলি / আপনি যাব চলি বঁধুয়ার কুঞ্জগলি—- অভিসারের কি অপূর্ব  অজুহাত যাতে জড়িয়ে আছে রাধারাণীর প্রতি  ত্রস্ত সতর্কতা। এই কবিই বলেছেন, ” দ্বার খুলে আর রাখবো না পালিয়ে যাবে গো—— কাকে ধরতে চেয়েছেন? সাকারের মধ্যে দিয়ে নিরাকারকে? কিন্তু সেই ধরতে চাওয়ার মধ্যে যেমন মগ্নতা আছে তেমনি বিদ্রোহের গোঁয়ার্তুমিও আছে —- সেই একমাত্র পথ যেপথে ঈশ্বর সান্নিধ্য সম্ভব কিন্তু আরাধ্য তখনই ধরা দেন যখন ভক্তের বিদ্রোহের কাছে হার মানেন। নিবেদনই প্রাপ্তির একমাত্র সোপান নয়, বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে নৈকট্যের দাবি জানিয়ে  ঈশ্বরের কাছে নিজের অপরিহার্যতার দাবি নিয়ে পৌঁছোতে পারলে পরমেশ্বর – প্রাপ্তি অনেক বেশি সম্মানের হয়। এত আপন করে করে মহামহিমময়কে পাবার আকাঙ্খা যিনি পোষণ করতেন তিনিও কিন্তু   আত্মসমর্পণ করেছেন,”” সম্বর সম্বর মহিমা তব / হে ব্রজেশ ভৈরব আমি ব্রজবালা—– এখানেও তিনি আত্মমগ্ন বিদ্রোহী তাই অনায়াসে পৌরুষের অহংকার ত্যাগ করে ব্রজবালায় নিজেকে বিলীন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।( সেদিনের সমাজেও কিন্তু গোপীপ্রেম বর্তমান উত্তরণ লাভ করেনি)
আকাশবাণীতে কর্মরত কবিকে আমরা চাহিদার দাবি মেটাতে কলম ধরতে দেখি।সেদিন কি তাঁর বিদ্রোহী সত্তার চ্যুতি ঘটেছিল?  এপ্রশ্ন  সংগত। কিন্তু যদি তাই হতো তবে তো কালের গতিতে হারিয়ে যেতেন তিনি—– একদিকে চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিয়েছেন অন্যদিকে বিদ্রোহকে হাতিয়ার করে রাগরাগিণী, তাল- ছন্দ- সুর, সেসব নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাঙাগড়ার খেলা খেলেছেন।যাকে আমরা বার বার বিদ্রোহ বলছি, কেন তাকে আমরা একবারও আমিত্বের দৈন্যতাকে অতিক্রম করার শাণিত শক্তির মর্যাদা দিচ্ছিনা??? এখানেই কি আমাদের ভাবনার পঙ্গুত্ব নয়? সাহস এবং বিদ্রোহ পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক —- তবে কেন নজরুল সস্তার রাংতা মোড়া বিদ্রোহী কবির মুকুটে বন্দী? তার সাহসী মনন ঋদ্ধি কেন আমাদের কাছে বার বার আবেদন করেও প্রত্যাখ্যাত হয়?

কবিতার ক্ষেত্রে  কোনো ব্যাকরনগত দায়ভার কবির থাকে না—– কারণ নন্দনতত্ত্ব সহৃদয় হৃদয় সংবাদিতার অনুগত। কিন্তু নজরুল তাঁর কবিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে  সে স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ আস্বাদন করতে পারেননি তার কারন তাঁর বিদ্রোহী তকমাটি কিন্তু সফল গীতিকবি হিসেবে তিনি,মনোগ্রাহী সুরস্রষ্টা হিসেবে তিনি অনেক বেশি স্বাধীন, অবাধ। এই বাধাহীন স্ব- অধীনস্থ বিচরণ ক্ষেত্রটি কিন্তু কোনো আপসমুখীনতার মধ্যে  দিয়ে অর্জিত হয়নি, সেখানেও ছিল নীরব বিদ্রোহ। সুরের, গীতিময়তার, ছন্দের, তালের যে অজস্র ভাঙাগড়ার কাজে তিনি নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন সেখানে সচেতন বিদ্রোহ ছিল —– তাই তার রাগ থেকে রাগান্তরে যাওয়ার প্রবণতা,তাঁর গানের সঞ্চারীর অবিনবত্ব নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে, গুরুচন্ডালীর অভিযোগের কানাকানি শোনা গেছে,রসোত্তীর্ণতার প্রশ্নে মতবিরোধ হয়েছে যার প্রাবল্যে হারিয়ে গেছে মতবিনিময়ের সুযোগ।তবু বিদ্রোহী মননটির সযত্ন লালনে সফল হয়েছিলেন বলেই আমার এমন একজন সৃজনশীল সঙ্গীতস্রষ্টাকে পেয়েছি। বিদ্রোহী কবির তকমাটাকে সরিয়ে মানবদরদী মননঋদ্ধ সেই কবিত্বের আঘ্রাণের সময় চলে যাচ্ছে —- যতদিন না আমরা এই বিদ্রোহী চেতনাকে কবির স্বতন্ত্র অথচ স্বাভাবিক যাপণ হিসেবে গ্রহণ করতে না পারব ততদিন নজরুলের সৃষ্টি বৈচিত্র্য ও তার প্রেক্ষাপটের সঠিক মূল্যায়নের তৃপ্তি অধরাই থেকে যাবে।
    

বিদ্রোহ যে তাঁর সমস্ত শিরা উপশিরায় বহতা ধারার মতো ছিল তার প্রমাণ তার নীরব জীবনেও প্রকাশ পেত।বোধশক্তি, বাচনশক্তি ব্যাধির করাল ছায়াগ্রস্ত হয়েছিল——- অমন নির্নিমেষ গভীর দৃষ্টি ভাষাহীন হয়ে  গিয়েছিল—- কিন্তু যে বিদ্রোহী মন নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন, সেই মন নৈশব্দের মধ্যেও আপন অস্তিত্বের জানান দিত।বাকহারা কবির সামনে কেউ ভুল গাইলে, সুরের স্খলন ঘটলে তিনি বিক্ষুব্ধ হতেন,হাতের কাছে যা পেতেন তা ফুলের মালাই হোক্ আর গানের পাতাই হোক্, ক্রোধান্বিত হয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতেন — রসাবমাননার  বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন ।
তাই জয় হোক্ বিদ্রোহী কবির,জয় হোক্  অমিতসাহসী কবির আর জয় হোক্  দুখু মিঞার যিনি বিদ্রোহকে হাতিয়ার করেই বিস্রস্ত জীবনচর্যাকে আয়ত্তে আনার নিয়ত যুদ্ধের সৈনিক ছিলেন।
   .



মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।