রাজনৈতিক রাজ্য

নীরবে চলে গেলেন বীরভূমের সিপিআইএম‌ এর একনিষ্ঠ কর্মী ভোঁদল সোরেন—সঞ্জীব বর্মণ।


:চিন্তন নিউজ:৬ই অক্টোবর:-“ মাননীয় সভাপতি মহাশয়, মঞ্চে উপবিষ্ট নেতাগণ, মা- বোনেরা ও বন্ধুগণ…”—না,এইভাবে গুছিয়ে বক্তৃতা তিনি করতে পারতেন না। কোনো সভায় তাঁঁর জন্যে একটা চেয়ার নির্দিষ্ট থাকলেও ধপ করে মেঝেতে বসে পড়তেই তিনি অভ্যস্ত ছিলেন, সেটাই যেন ছিলো তাঁঁর স্বচ্ছন্দ বোধের স্বাভাবিক প্রকাশ। অত্যন্ত সুব্যবহারের অধিকারী ছিলেন বটে, কিন্তু চট করে উচ্চতর নেতৃত্বের চোখে পড়ার মতো বাচনভঙ্গি বা বিভঙ্গ এ সব কিছুই ছিলো তাঁঁর অজানা। আসলে তিনি কখনো নেতা বা মাথা কিছুই হয়ে উঠতে শেখেননি,শিখতে চাননি। তাই হয়ে উঠতেও পারেননি, চানওনি বোধহয়। বড়, ছোটো, ঘরোয়া সব সভাতেই প্রায় দেখতে না পাওয়া একটা কোনে সব সময় তাঁঁর অবস্থান,এমনকি যে সভার সে আয়োজক সেখানেও। কিছু বলতে বললেই প্রায় প্রতিটি মিটিংয়েই ভাঙা রেকর্ডের মতো একটা-দুটো বাক্যই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাঁপা গলায় তিনি বলতেন, “ আছি গো আছি,যাবো কোথা, আর জায়গা কোথা আছে, সমাজের সবাইকে বুঝাছি তো ‘বুকের কথা মুখে আনতে হবে, হকের কথা বলতে হবে, জোট বাঁধতে হবে’। কিন্তু ’সাঁওতাল বলে শুধু আমরা বুঝালে হবে ? তুমাদেরও তো যেতে হবে- গাঁয়ে, সাঁওতাল পল্লীতে” (কত সহজ কথা অথচ কত দরকারী কথা তাইনা ?—

আদিবাসীদের কাছে তাঁঁদের জীবন যন্ত্রণা বুঝতে শুধু আদিবাসী নেতা,সংগঠক কর্মীদের গেলেই হবে না। ড্রয়িং রুমের গন্ধমাখানো অবসর বিনোদনের শহুরে রাজনীতির সংকীর্ণ গন্ডি পেরিয়ে বাকীদেরও যেতে হবে প্রান্তিকতার কাছাকাছি। যত মূল্যবানই হোক বাস্তবে প্রয়োগেই কিন্ত তত্ত্বের মুক্তি নাহলে সে বন্দী বইয়ের পাতায়। এ যেন শেকড়ের সন্ধানে শেকড়ের কাছেই যাওয়া, যেতে বলা )। সব মিলে একটা অত্যন্ত সাদামাটা, নিস্তরঙ্গ জীবনের মালিক ছিলেন। তবু অত্যন্ত অসময়ে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তাঁঁর এই রকম হঠাৎ করে চলে যাওয়া কেন তৈরি করলো এতবড় শূণ্যতা ? কেন বয়ে নিয়ে এলো কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে না পারা গভীর এক দিগন্ত বিস্তৃত স্তব্ধতা ? শুধু তাঁঁর পাড়া বা গ্রাম টুকুতেই তো নয়। কাষ্ঠগড়া, মাসড়া, সালবাদরা, নিরিসা, শালবুনি, রাণী—রামপুরহাট এক নম্বর ব্লকের বিশেষ করে আদিবাসী সংখ্যাধিক্য সব গ্রাম গুলোতেই যেন অতি কাছের কাউকে চিরকালের জন্যে হারানোর যুগপৎ ব্যক্ত, অব্যক্ত যন্ত্রণার প্রতিভাস। হঠাৎ, সামান্যতম কোনো পূর্ব লক্ষণ বা বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই তার অসুস্থ হয়ে পড়া (পরে জানা গেল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ)। প্রথমে গুরুত্ব না দেওয়া(যা হয়), তারপর প্রাথমিক চিকিৎসা অতঃপর রামপুরহাট হাসপাতাল, সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ, ছ’দিনের অসম যুদ্ধ, “ মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই ”- দারিদ্র তাঁঁকে হারাতে পারেনি,কিন্তু কালব্যাধী তাঁঁকে জিততে দিলনা,১৭ সেপ্টেম্বর’ ভোর ৫-৩০ টায় তার “ মহাপ্রয়াণ”। ১৭ তারিখেই তখন কটা হবে ? তিনটে, সাড়ে তিনটে ? ছোট্টো একটা এ্যাম্বুলেন্সে নিজের ভিটেয় পোঁছালো তাঁঁর নিথর দেহ,সেদিন বৃষ্টি ছিলনা তবু পরম আত্মীয় বিয়োগে শোকবিহ্বল হাজার চোখের জলে ভিজেছিল খরবনার মাটি। চিরঘুমে শায়িত জীবন সঙ্গীর শেষশয্যার পাশে সংজ্ঞাহীন স্ত্রী, কখনো বাবার দিকে,কখনো মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দুটি শৈশবের কি হারিয়ে গেল বুঝে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা তখনো প্রখর সূর্যের উপস্থিতিকে ম্লান করে যেন নামিয়ে আনল গভীর অন্ধকার। আদিবাসী অধিকার মঞ্চের পতাকায় ঢেকে দেওয়া হলো তাকে পরম শ্রদ্ধায়। এযে ছিলো তার নিজের সংগঠন,এই সংগঠনেরই সে জেলা কমিটির সদস্য, ব্লক কমিটির সম্পাদক ছিলো। এই সংগঠনের পতাকা হাতেই মাটিতে পা রেখে আকাশে মাথা ঠেকিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে সোচ্চারে সে বলতো “ আমার হক কারুর বাপের কেনা গোলাম লয়, বাঁচতে গেলে লড়তে হবে, লড়াই করেই বাঁচতে হবে”।আদিবাসী উন্নয়নের রঙিন স্বপ্ন ফেরি করে আদিবাসী সংগঠনের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে যারা শুধু নিজেদের অট্টালিকা আর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের জন্যে আদিবাসী জীবনের অমলিন মর্যাদা কে বন্ধক রেখেছে লুঠ, বিভেদ আর বৈষম্যের লুম্পেন বেলেল্লাপনার কাছে তাদের সে ঘৃণা করতো। তার গভীর বিশ্বাস আর ভরসা ছিল নিজের সংগঠন আর সংগঠনের পতাকায়। বাকরুদ্ধ, শোকস্তব্ধ ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র নেতৃত্ব লাল পতাকায় আচ্ছাদিত করলেন চিরঘুমে শায়িত তাদের সাথীকে। এ পতাকা যে তার বড় প্রিয়,তার গর্ব,তার অহংকার। খরবনা থেকে রামপুরহাট তিন কিলোমিটার পথ কখনো পায়ে হেঁটে,কখনো সাইকেলে কত মানুষকে নিয়ে সে কত মিছিলে হেঁটেছে এই পতাকা হাতে। গেছে সিউড়ী, কলকাতা। ভয় বা প্রলোভন কিছুই তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি প্রিয় লালঝান্ডাকে। হাজার মুষ্টিবদ্ধ হাতে অনুরণিত হলো হারানো সাথীর হার না মানা পথে অবিচল থাকার, সাথীকে না ভোলার, তার স্ত্রী,পুত্র-কন্যাকে আত্মীয়তার অটুট বন্ধনে বেঁধে রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার। সময় হলো, এবার নিজের ছোট্টো ভিটে থেকে তার চিরকালের জন্যে বিদায় নেবার পালা। জীবন সঙ্গীনির শূণ্য দৃষ্টি, রেখে যাওয়া প্রজন্মের উদাস চাউনি,আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী আর অসংখ্য হাতে হাত ধরে পায়ে পা মিলিয়ে একসঙ্গে পথচলা সাথীদের শোক বিহ্বলতায় ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে বাতাস, ছোট্টো নিকানো উঠনে যত্নে বেড়ে ওঠা হলুদ গাঁদার ফুল গুলোও আজ যেন বড় অসহায় বোধে আচ্ছন্ন। বাড়ীর অদূরেই শ্মশান, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সাথীকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গ্রাস করবে লেলিহান শিখা। শ্মশান অভিমুখে বেরলো শেষ যাত্রা মাঝে একটু থামতে হলো সেই জায়গায় যেখানে অক্লান্ত চেষ্টায়, অদম্য জেদে সে গড়ে তুলেছিল বিপ্লবী সিধু-কানুর তীর-ধনুক হাতে চিরপরিচিত, চিরঅম্লান পূর্ণাবয়ব মূর্তি। বছরে একবার একটা নির্দিষ্ট দিনে সবাই যেত সেখানে মালা দিতে। সভা হতো, গান হতো। কিন্তু প্রতিদিনের দেখভালের দায়িত্ব সে তার নিজের কাছেই রেখেছিল। আদিবাসী অধিকার আদায় ও রক্ষার সংগ্রাম কে কিভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের চেহারা দিয়েছিল মৃত্যঞ্জয়ী সিধু-কানুর বীরের সেই গৌরব গাথা এতশত তিনি বুঝতেন না হয়তো, কিন্তু এইটুকু তিনি নিশ্চয় বুঝতেন, আদিবাসী জীবনের হৃদয়ের স্পন্দনের নাম সিধু-কানু, ধমনীতে ধাবমান রক্তস্রোতের নাম সিধু-কানু। ‘গান স্যালুট’য়ে নয় সমুদ্র গর্জনের স্মৃতি জাগানো, মুষ্টিবদ্ধ হাতের রেড স্যালুটেই চির বিদায় নিলেন বীরভূমের প্রিয়, অতি প্রিয় সাথী। অবুঝের মতো অসময়ে তিনি যে চলে গেলেন, একবার কী ভেবে গেল দারিদ্রের মতো বিপুলাকায় দৈত্যের সঙ্গে অসম যুদ্ধে স্বামীকে পাশে নিয়েই এঁটে উঠতে ক্লান্ত, অবসন্ন যে নারী, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সেই সঙ্গীকে হারিয়ে দুটি শিশুপুত্র নিয়ে আজ এই জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার ভরসা অনুসন্ধান করবেন কোথায়, কীভাবে ? কেন ? গোটা পার্টি টাই একটা পরিবার নয় ? সাধ্যের সীমাবদ্ধতা কে সম্মিলিত ইচ্ছার পরাক্রমে পরাজিত করে, অতিক্রম করে তাঁর কাছে ভরসা হয়ে পোঁছে যেতে পারবেনা পার্টি ? অতএব ৪ঠা অক্টোবর প্রয়াত সাথীর বাড়ী পৌঁছে গেলেন ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বীরভূম জেলা কমিটির সম্পাদক মনসা হাঁসদা, সঙ্গী আদিবাসী অধিকার মঞ্চের জেলার ও স্থানীয় পার্টি নেতৃবৃন্দ। বাড়িয়ে দিলেন পরিবারের প্রধানের অভিভাবকত্বের সহমর্মিতার হাত,“পার্টি আছে, থাকবে পাশে,তোমাদের পাশে। পার্টি থাকতে তোমার ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার কোনো ব্যাঘাত হবেনা। স্বামী কে তোমার ফেরাতে আমরা পারবোনা,কিন্তু তাইবলে তুমি একা তা ভেবো না” মাথায় হাত রেখে যখন বললেন মনসা হাঁসদা গত ১৭ই সেপ্টেম্বর স্বামীর শেষ শয্যার পাশে পাথর প্রতিমার যে চোখে ছিল শুধুই শূণ্যতা আজ সেই চোখ বেয়েই নেমে এলো জীবনকে আঁকরে ধরার আকুল আবেদন আর সঙ্গে সঙ্গে “ বেজে উঠলো এক দুর্বার উচ্চারণ / এক প্রত্যয়ের তপ্ত শঙ্খধ্বনি-/ প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে,/ প্রাণ থাকলেই স্থান আছে মান আছে / সমস্ত বাঁধা -নিষেধের বাইরেও / আছে অস্তিত্বের অধিকার। ” প্রয়াত সাথীর স্ত্রীর হাতে প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশী কিছু দিলেন কী পার্টির নেতৃবৃন্দ ? যা দিলেন তা কি হারানো সাথীর অসময়োচিত অনুপস্থিতির সমতুল ? তবে কি এই উৎসবের সময় সামান্য কিছু তাঁর স্ত্রীর হাতে তুলে দিতে পেরে গভীর শ্লাঘায় অবগুন্ঠিত পার্টি ? না। আসলে এর একটাও নয়। ন্যুনতম কর্তব্যবোধ আর দায়িত্ব বোধে সম্পৃক্ত এটা আসলে মমত্ববোধ আর কমিউনিস্ট মূল্যবোধের সংশ্লেষণে নির্মাণ করতে চাওয়া একটা সেতুর শিলান্যাস। নিজের গ্রাম,নিজের শহর, জেলা, রাজ্য, দেশের সীমা ছাড়িয়ে যে সেতু কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা নির্মাণ করতে চাই এই সমগ্র গ্রহটা জুড়েই। বৈষম্য আর বিভেদের জান্তব অশ্লীলতার জঞ্জাল দুপায়ে মারিয়ে যে সেতু পেরিয়ে বারবার ফিরে যাবে মন সাথীদের কাছে, হারানো সাথীদের পরিবার পরিজনদের কাছে আর কখন বাবার কখন মায়ের কখন ভাইয়ের বা ভগিনীর মমত্ব মাখানো হাতে হাত ধরে,বুকে বুক রেখে বলতে পারবো এইতো আছি তোমার কাছাকাছি।

                                

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।