কলমের খোঁচা

“বাদাবন, বাঁধ, মানুষের গপ্পো”: অর্ণব রায়


আমায় দোষ দিও না বাপু। আমি সক্কালে আনন্দ গিলে বাজারে যাই। সন্ধ্যায় রিমোট নিয়ে ৯ থেকে ২৪ সংখ্যার চেহারা দেখে, আনন্দ করে টাইমসে চেপে পাক্কা মাথাদের বাণীতে পুষ্টি নিই। আমি এসবে নেই। সুন্দরবন আর কলকাতায় দুই বন্ধুর গপ্পো নেহাত শুনে ফেললাম এক চায়ের দোকানে। এদেরও বলিহারী! ঘুষখোরদের হেভিওয়েট উপাধিপ্রাপ্তি, ভূতের হিসাবে ফাইনাল মার্কশীট, দাড়ি আর বুদ্ধির ব্যস্ত অনুপাত বৃদ্ধি – কত মজার ব্যাপারস্যাপার ঘটছে চারদিকে । সেগুলো নিয়ে আড্ডা না! যাকগে, যাক, যা শুনেছি, তুলে দিলাম। তোমাদের যদি কাজে লাগে – পরোপকার করার ইচ্ছা মাঝেমাঝে কার না হয় !!

কলকাতার বন্ধু- ইয়াসের ল্যাজঝাপটা কেমন লাগল?
সুন্দরবনের বন্ধু – সব শেষ। বাঁধ ভাঙল। নোনা জল ঘরে খেলা করছে। পানের বরজ, পুকুরে মাছ, চাষবাস যেটুকু, সব শেষ। তাও ত ইয়াস ঝড় আসলে পড়ল উড়িষ্যায়।

ক- ঝড়ের চেয়ে ত জলোচ্ছ্বাস বেশী হল, সংবাদে দেখলাম।
সু – জলোচ্ছ্বাস এত হতে পারে আগে বলা হয়নি, ঝড়ের কথাই এলাকায় বেশী বলা হয়েছে। ফলে ঘরের সব জিনিষ ওপর থেকে নীচে নামিয়েছি, ঝড়ে পড়ে যাতে না যায়, মাটির বাঁধ ভেঙে জল এসে সব নষ্ট করে দিল। এখন শুনছি, আবহাওয়া দপ্তর নাকি প্রচুর জলোচ্ছ্বাসের সতর্কবার্তা দিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ঝড়ের সতর্কবার্তা দিয়ে গেছে বেশী।

ক – পাকা বাঁধ ত হল না। তার ৪ হাজার কোটি টাকা ফেলে রেখে শেষে দিল্লীতে ফেরত দেওয়া হল। এখন ৫০০ কোটি টাকা ত্রাণ সাহায্যের জন্য হা-পিত্যেশ করে থাকতে হল। তোরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই রইলি।
সু – কে আর আমাদের কথা ভাবে?
ক – ভেবেছিল ত। ২০০৯ এর আইলার হঠাৎ বিরাট ঝড় ও ক্ষয়ক্ষতি দেখে বামফ্রন্ট সরকার পাকা সমাধান করতে এগোল। সেজন্য কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের ইঞ্জিনিয়ার, পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানীরা মিলে টাস্ক ফোর্স তৈরী হল। শুনেছি তারা বলেছেন, যেসব এলাকায় খুব ঝড়বৃষ্টির প্রকোপ হচ্ছে সেখানে, অর্থাৎ সুন্দরবনের মোট ৩৫৮৪ কিমি মাটির রিঙবাঁধের মধ্যে ৩৭৭ কিমি বাঁধ পাকা বাঁধ হবে। নদী বরাবর ‘টো ওয়াল’ করে ‘প্রি-কাস্ট’ কংক্রিট-স্ল্যাব দিয়ে লাইনিং করা হবে।‌ কোথাও কংক্রিট স্ল্যাবের বদলে ব্রিক পিচিং করা হবে সিমেন্ট মর্টার দিয়ে। তলায় ফিল্টারিং করা হবে ঝামা ইট ইত্যাদি দিয়ে। ঢাল হবে, ৩:১ / ৪:১। উঁচু হবে ষোল থেকে কুড়ি ফুট ।‌ ঘাসের চাপড়া দেওয়া হবে গ্রামের দিকের ঢালে, নদীর দিকে ম্যানগ্রোভের সারি লাগানো হবে, গ্রামের দিকে দেশী গাছের সারি লাগানো হবে। নদীর পলি তুলে বাঁধের গ্রামের দিকে মাটি ভরাট হবে। ঝড়ের ,জলের ধাক্কায় বাঁধ আর ভাঙবে না। নামখানা, গোসাবা, সাগর, বাসন্তী, পাথরপ্রতিমা, কুলতলি ইত্যাদির কিছু কিছু অংশ।
সু – ভাঙেনি। সাগর, মৌসুমি, বাঘডাঙায় যে ৮৪ কিমি এমন পাকা বাঁধ করা হয়েছে এই আয়াসের ঝড়ে, জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় সেখানে কিচ্ছু হয়নি। সেখানকার লোকরা শুধু রক্ষা পেয়েছে না, আশেপাশের থেকে অনেক মানুষ সেখানে গিয়ে ইয়াসের সময় থেকেছে। তারপর, আর হল না কেন ? বাম সরকার গেছে ত দশ বছর হয়ে গেল।

ক – ঐ ৮৪ কিমি পাকা বাঁধ হয়েছে ‘কোস্টাল জোনাল রেগুলেশন আ্যক্ট’ মেনেই। কিন্তু তোরা, মানে সুন্দরবনের লোকরা, জমি দিচ্ছিস না?
সু – জমি সরকার চাইল কই? জমি অধিগ্রহণের জন্য তেমন উদ্যোগই ত নেই। যে সামান্য এলাকায় উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে এমনকি টাকা দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু অধিগ্রহণ করেনি এখনো। শুনেছি,পাখিরালয়ের ওখানে হোটেল রিসর্টের জমি অধিগ্রহণের মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আজও জমি নেয়নি। হোটেল রিসর্টের মালিকরা টাকা পেয়েছে ,আবার চুটিয়ে হোটেল – রিসর্টের ব্যবসাও করে যাচ্ছে।

ক – তাহলে সুন্দরবনে করছে কি? গত বছর আমফানে বড় বিপর্যয় হল। তারপরও চুপ । বিশ্ব উষ্ণায়নের মধ্যে এখন মাঝেমধ্যেই ,বিশেষত বঙ্গোপসাগরের ভৌগলিক অবস্হানের কারণে , ঘূর্ণীঝড় হবে – অনেকদিন ধরে বলছেন আবহাওয়া-বিজ্ঞানীরা। তারপর নদীগুলোর নাব্যতা কমছে, জল ধরে রাখতে পারছে কম।
সু – এই সরকার পাকা বাঁধ করবে না।
ক – না করার কারণও ত কিছু বলছে না। পাকা বাঁধ করলে অসুবিধা কি ,তাও ত বলছেন না কোন এখনকার সরকারী বিশেষজ্ঞ। যদি অন্য পাকা ব্যবস্হা করা যায় তা কি? তাও ত দশ বছরে ভাবা হল না। আসলে, আর কোন কিছু উপায় নেইও। অতজন এক্সপার্ট মিলে বললেন, তারা সবদিক ভেবেই ত বলেছেন। এরা শুধু শুধু ফেলে রেখেছেন কাজটা।
সু – আর, বারেবারে বিপর্যস্ত হচ্ছি আমরা, সুন্দরবনের মানুষরা। আয়লার পর ফণী, বুলবুল, আমফান, ইয়াস – ছোটবড়ো ঘূর্ণিঝড় ত এখানে এখন ফিবছরই হয়ে চলেছে । মাটির বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে বারবার। আমরা কি বেঁচে থাকব না পরিবার ঘরবাড়ী গরু ছাগল মাছ কাঁকড়া প্রভৃতি নিয়ে ? থাকব না আমরা সুন্দরবনের মানুষরা বেঁচে ?

ক – বাঁধ মেরামতি নাকি হয়না? টাকা সব জলে চলে যায় ?
সু – তা আছে কিছুটা ঠিকাদারদের চুরি। আর , তাদেরও ত তোলা দিতে হয় অনেককে।
ক – সে সমস্যা আছে । কিন্তু মেরামতি ত দীর্ঘস্থায়ী (পার্মানেন্ট ) বা সাময়িক( প্যালেটিভ )- দুধরণের হয়।‌ কোন ধরণের মেরামতি , কত কিমি বাঁধ মেরামতির জন্য কত টাকা বরাদ্দ গেল , তা না জানলে ত বোঝাও যায়না , কাজ কতটা কেমন হওয়ার কথা, আর মেরামতি হয়েছে কতটা । আর, মাটির বাঁধ মেরামতি করে এই বিপর্যয় আটকানো যাবেনা কিছু এলাকায়। তাই ত ৩৭৭ কিমি মাটিবাঁধ পাকা করার উপায় বার হল।
সু – বিকল্প ও ত কিছু নেই।
ক – অন্য কিছু নাকি ভাবা হবে, এখন কেউ কেউ বলছেন! কোটি কোটি ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানো হবে এক বছরের মধ্যে।
সু – আসলে, তোদের কলকাতার লোকদের এ নিয়ে কোন ধারণাই নেই?
ক – তাই?
সু – হ্যাঁ। ম্যানগ্রোভ গাছ প্রাকৃতিক ভাবেই সুন্দরবনের নদীর তীরে জন্মায় , চাষ করা বা বৃক্ষরোপন করা যায় না। ম্যানগ্রোভ গাছ ডালিয়া বা গোলাপের মতো চারা নিয়ে এসে পুঁতে দিলে হয়না। ম্যানগ্রোভের বীজ পুঁততে হয়। এই বীজ সুন্দরবনের নদীতে ভেসে আসে, বন দপ্তরকে মজুরি দিয়ে লেবার লাগিয়ে নদীর পাড় থেকে সেই বীজ সংগ্রহ করতে হয় । সাধারণত এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে এই বীজ পাওয়া যায়। এক মরশুমে খুব বেশী হলে ২০-২৫ লাখ বীজ সংগ্রহ করা যায়। সংগৃহীত সব বীজ আবার ব্যবহার যোগ্য নয়। ম্যানগ্রোভ বীজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বপন যোগ্য করে তোলা হয়। এবার এই প্রক্রিয়াজাত বীজ বপনের কায়দা আছে। এটা সময় সাপেক্ষ এবং পরিশ্রম সাধ্যও বটে। কেবল লোনা নদীর ধারেই ম্যানগ্রোভ বীজ বপন করা যায়। যখন ভাঁটা থাকে দ্রুততার সঙ্গে গর্ত খুঁড়ে বীজ পুঁততে পুঁততে যেতে হয়। জোয়ার এলেই বীজ বপনের কাজ বন্ধ রাখতে হয়। এবার বল দেখি ৫ কোটি ম্যানগ্রোভ লাগাতে কত সময় লাগতে পারে! সুন্দরবনের জঙ্গলে এক লপ্তে ১ বর্গ কিমি জায়গা পাওয়া কঠিন। যদি পাওয়াও যায় তবে এক ফুট ফাঁক রেখে ৩৩টি সারিতে ম্যানগ্রোভ বীজ পুঁতলে এক বর্গ কিমি জমিতে ১ লক্ষ বীজ পোঁতা সম্ভব। এই সব বীজ থেকেই গাছ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ধরে নিলাম সব বীজ থেকেই গাছ হলো এবং বেঁচে গেলো….

ক- কিন্তু ঘোষণা হয়েছিল গত আমফানের পর এক বছরের মধ্যে ৫ কোটি ম্যানগ্রোভ লাগানোর হবে । তা হয়নি বলে এবার তা লাগানো হবে বলা হচ্ছে।
সু – ৫ কোটি ম্যানগ্রোভ গাছের বীজ সংগ্রহ করে বপন করতে মোটামুটি ২০ বছর লাগবে, ৫০০ বর্গ কিমি জমি লাগবে। এসব গুল শুনে লাভ আছে? আর, লাগিয়েই বা কি হবে? প্রকৃতি যে বাদাবন তৈরী করেছিল তাই ধ্বংস করা হচ্ছে মাছের ভেড়ি , হোটেল ,রিসর্ট ইত্যাদি বানানোর জন্য। এলাকার কত্তারা চুপ, বন্দোবস্ত আছে । মানুষের তৈরী করা ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করা আরো সোজা। মুখে বলা হবে , এত এত লাগানো হয়েছে, কিন্তু তা হয়ত হবে অনেক কম বাস্তবে , কে আর হিসাব আর বাস্তব দেখতে মেলাতে আসছে ?

ক- হ্যাঁ, ২০১১ সালে বাদাবন ছিল ২১৫৫ বর্গ কিমি ২০১৯ এর বনদপ্তরের সার্ভে অনুযায়ী ২১১২ বর্গ কিমি, অর্থাৎ কমেছে ৪৩ বর্গ কিমি। তারপর আজ দুবছরে আরো কমেছে। বাম সরকারের উদ্যোগে কেন্দ্র- রাজ্যের সম্মিলিত টাস্ক ফোর্সের প্রকল্পটির মধ্যে পাকা বাঁধের সঙ্গে ম্যানগ্রোভ ,দেশী গাছ বাঁধের সামনে পিছনে লাগানোর কথা বলা আছে । তবে, এটা ঠিক, ম্যানগ্রোভ দিয়ে সব আটকানো পুরো অবাস্তব প্রস্তাব। প্রযুক্তি আছে, প্রযুক্তিবিদরাও প্রস্ত্তত। তবু..। দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের প্রকল্প, টাকা রেডি অবস্হায় পেলেও কোন উদ্যোগ নেই।‌
সু- দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হলে ত্রাণের ডোলের রাজনীতি আর হবে না ত ! তাহলে ত্রাণ দিয়ে ভোট নেওয়া হবে কি করে?

ক- হয়ত, শুধু ভোট- রাজনীতিই এখন হয় । কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি হবে বলছে সামান্য হলেও দু- একজন।
সু- এ ত তোদের কলকাতায় রাজপথের ধারে শৌখিন ঝা-চকচকে কৃত্রিম সাজানো না । তাতে পরিবেশ ধ্বংস অপরাধ। কিন্তু যেখানে আমাদের জীবন অস্তিত্ব, সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেখানে শুধুই পরিবেশ নিয়ে ভেবে লাভ?

ক- তা ঠিক। কোন উন্নয়ন জরুরী হলেও পরিবেশের একটুও ক্ষতি না করে আজ অবধি পৃথিবীর কোথাও বোধহয় হয়নি। দরকার যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মত
পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন করার এবং তা করার পর পরিবেশ-ক্ষতির ক্ষতিপূরণ প্রযুক্তির বা ট্রাডিশনাল পদ্ধতিতে যতটা করা যায় ,তা দ্রুত করা। কেউ কেউ মাটির বাঁধের সামনে সল্ট মার্শ করার কথা বলছেন। অবাস্তব প্রস্তাব । সুন্দরবনের মানুষদের বিপর্যয়ের প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিচয় নেই এইসব কথায়।
সু- দলে দলে যুবকরা সস্তায় মজুরী মেনে অন্ধ্র, কেরালা তামিলনাড়ুতে চলে যাচ্ছে। উপকূলের জীবিকা বারবার ঝড়ের আঘাতে বিপন্ন। ত্রাণ দিয়ে সারা বছর পরিবার চালানো যায় না।

ক- তাহলে, বাদাবনের মানুষদের এখন ভবিতব্য?
সু- অন্ধকার । অন্তত যতদিন সবাই মিডিয়ার কথায় মজে নিজের ভালো- মন্দের বোধও হারিয়ে ফেলবে , ততদিন পর্যন্ত ত বটেই।
১৪/৬/২১


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।