চিন্তন নিউজ: ৮ই মে:–“ কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের সপ্ততিতম- বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে যে জয়ন্তী উৎসব হয়েছিল, সেখানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁকে মানপত্র অর্পণ করতে গিয়ে “সার্বভৌম কবি” বলে সম্বোধন করেছিলেন। যদি কোনো বিশেষণে কবি রবীন্দ্রনাথকে ভূষিত দেখতে ইচ্ছা করে তা বোধ হয় সবচেয়ে শোভন এই “সার্বভৌম” শব্দটি। সর্বভূমিতে তাঁর বিচরণ, সর্বক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপ্তি, সর্বদেশে তাঁর অধিষ্ঠান, সর্বমানবীয় আস্বাদে ও আকুলতায় তাঁর শিল্পীসত্তার পুষ্টি, সর্বজনের অন্তরে তাঁর অধিকার…। ”( হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়- রবীন্দ্রনাথ শতবার্ষিকী প্রবন্ধ-সংকলন, এনবিএ,পৃঃ ৯ )। তাঁর অপূর্ব সৃষ্টির সম্ভারে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে আমাদের ঔৎসুক্য মননকে আলোড়িত করেছেন,তাঁর ‘সাহিত্য, শিক্ষা, স্বদেশ, সমাজ, সমবায়, পল্লিপ্রকৃতি ইত্যাদি ’ ক্ষেত্রগুলিতে দিগন্তবিস্তৃত দৃষ্টিপাত আমাদের চিত্তকে যেভাবে অনুরণিত করেছে, তাঁর সারা জীবনের অবিচ্ছেদ্য সাধনায় ও সৃষ্টিতে মানবিকতার জয়গান আমাদের মনুষ্যত্বের পূর্ণ প্রতিষ্ঠায় যেভাবে কান্ডারীর ভূমিকা পালন করেছে আজো করে চলেছে তাতে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের ঋণের অন্ত নেই। “রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষা দিয়েছেন, কথা বলার ব্যাকরণ শিখিয়েছেন,গান দিয়েছেন,…প্রত্যেকেরই ভাবনার বিন্যাসে তাঁর অভ্রংলিহ প্রতিভার অনুশাসন। রবীন্দ্রনাথকে প্রক্ষিপ্ত রেখে আমাদের চিন্তা-কল্পনা-বিশ্লেষণ ক্ষমতা অনড়। তিনি একই সঙ্গে আমাদের দিগনির্দেশক, আমাদের কষ্ঠিপাথর, আমাদের নির্ভরতা।”(অশোক মিত্র, প্রবন্ধ-সংগ্রহ, আনন্দ,পৃঃ৩৫)। এবংবিধ হিমালয় সদৃশ, সমুদ্রগভীর, অভ্রভেদী কালোত্তীর্ণ অসামান্য সম্পদের একছত্র অধিকারী রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি উপলক্ষ্যে কিছু বলা বা লেখা এই অর্বাচিনের পক্ষে নিতান্ত ধৃষ্টতা বইতো নয়।অথচ কীর্তি ও বহুমখী প্রতিভার এই বিপুল ঐশ্চর্য থেকে আমাদের প্রাপ্তিও যেহেতু অসীম সুতরাং বছরে অন্তত একটা দিন “ফুলের মালা, দীপের আলো, ধুপের ধোঁয়ার” কৃত্রিম আতিশয্যের আড়াল ঠেলে “সরল প্রাণে নীরব হয়ে” তার সৃষ্টির সামনে নতমস্তকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনে দ্বিধাচিত্ততা সেও তো এক অন্তহীন অকৃতজ্ঞতা । অনস্বীকার্য ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে একথা আজ অস্বীকার করার পথ আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি যে,সচেতন বা অবচেতনে রবীন্দ্র প্রতিভার সতত প্রয়োজনীয় অন্বেষণে আমরা কিন্তু বারবার তাঁর অসামান্য কবিতা সম্ভার ও গানকেই আঁকরে ধরেছি, এতে দোষের কিছু নেই বরং এও আমাদের এক পরম প্রাপ্তি। মনের আনন্দ, প্রাণের আরাম। রবীন্দ্র কবিতা, গান-তার আবেদন, সুরের মূর্ছণা, ছন্দের দীপ্তি আমাদের যেন চির অমলিন, চির অম্লান সুখ স্বপ্নের ভেলার আরোহী করে ভাসিয়ে নিয়ে চলে দিক থেকে দিগন্তে।বরীন্দ্র কবিতা ও গানের রস আস্বাদনে আমাদের যেন অন্ত নেই। কিন্তু এই একমাত্রিক চিত্ত বৈকল্যই শ্যাওলা মলিন করে দেয় পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রনাথ অন্বেষণে আমাদের আবশ্যিক অনুসন্ধিৎসাকে।এ সম্পর্কে এখানে দুটি একটি বিষয়ের অবতারনা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৩০ সালের ৩০ শে আগষ্ট রবীন্দ্রনাথ তার পুত্রবধু প্রতিমা দেবী কে এক পত্রে লিখছেন, “…যাকে বলি বিজ্ঞান, সায়ান্স, তার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে জ্ঞানের জন্যে অপরাজিত যত্ন। কোথাও আন্দাজ খাটবে না, খেয়াল কে মানবে না, বলবে না ধ’রে নেওয়া যাক, বলবে না সর্বজ্ঞ ঋষি এই কথা বলেছেন। ”(সুত্রঃ রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানরচনা সংগ্রহ, আজকাল প্রকাশন) । বিজ্ঞান চিন্তক এই রবীন্দ্রনাথ কে আমরা খুঁজবোনা কেন ? পরম আত্মীয়তার বন্ধনে বন্দী করবোনা কেন ? যে সময়ে অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার আর অপবিজ্ঞানকে সর্বরোগহরা প্রতিশেধকের বিশেষ মর্যাদার কৌলীন্য প্রদান করা হচ্ছে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এবং তাও আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তখন রবীন্দ্রনাথের এই মহান ভাবনাকে আমরা বিজ্ঞানকে তার স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে অনুপ্রেরণার আকর হিসাবে সংগ্রহ করবো না ? সঞ্চয় করবোনা ? আজ যখন সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের ভারতবর্ষেও প্রকৃতির প্রতিশোধের সর্বগ্রাসী আক্রমণের মুখে রাষ্ট্রীয় অপদার্থতার সবকটা মুখোশকে ফালাফালা করে এই আক্রমণ মোকাবিলার প্রধান সৈনিক সমূদয় চিকিৎসক, সেবীকা, অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীদের সহায়তায়, এই আক্রমণে সবচেয়ে বিপদাপন্ন, ক্ষতিগ্রস্ত নিরন্ন, গরিব শ্রমজীবি সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশবাসীর সহমর্মিতায় যারা অকুতোভয়ে অগ্রগামী সেই “চোখে দেখতে না পাওয়া” বামপথানুসারী দের কাছে, বিশেষকরে যৌবনের অগ্রদূতদের কাছেও এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথই পথ প্রদর্শক, আলোর দিশারী। আজ থেকে এক শতাব্দী পূর্বে ম্যালেরিয়া নিবারনী উদ্যোগের প্রাণপুরুষ যশস্বী চিকিৎসক, বিজ্ঞানসাধক, সমাজসেবী ডাঃ গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূয়শী প্রশংসা করে এবং তার এই মহৎ কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,“…পরস্পরের মিলনের নানা উপলক্ষ্য চাই। এমন অনেক উপলক্ষ্য চাই যাতে আমাদের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মিলতে পারে। দেশ বলতে যা বুঝি, সকলে তা বোঝে না, স্বরাজ কী অনেকে বোঝে না। কিন্তু মিলন বলতে যা বুঝি, এমন কেউ নেই যে তা বোঝে না। যদি কোনো-একটা গ্রামের সকলে মিলে কিছু পরিমাণেও রোগ কমাতে পারি, তবে বিদ্বান মূর্খ সকলের মেলবার এমন সহজ ক্ষেত্র আর হতে পারে না।”(সুত্রঃ রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান রচনা সংগ্রহ, আজকাল প্রকাশন পৃঃ ১২৩-২৪)। আজকের পশ্চিমবাংলায় করোনা মোকাবিলায় বর্তমান রাজ্য সরকারের অশ্লীল অপদার্থতা কার্যত অপরাধের বদ্ধভূমিতে দাঁড়িয়ে কাদের গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা পুরণের অঙ্গিকারের জাজ্বল্যমান প্রতিচ্ছবি হয়ে অম্লান থাকবে আগামী ইতিহাস যথা সময়ে তার সাক্ষী দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত থাকছে। “ যাঁহারা ইম্পিরিয়ালিজমের খেয়ালে আছেন, তাঁহারা দুর্বলের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও অধিকার সম্বন্ধে অকাতরে নির্মম হইতে পারেন এ-বিষয়ে সন্দেহ নাই, পৃথিবীর নানাদিকেই তাহার দৃষ্টান্ত দেখা যাইতেছে। …নিজেদের নিশ্চিত একাধিপত্যের জন্য একটি বৃহৎ দেশের অসংখ্য লোককে নিরস্ত্র করিয়া তোলা যে কতবড়ো অধর্ম, কী প্রকান্ড নিষ্ঠুরতা তাহা ব্যাক্ষা করিবার প্রয়োজন নাই ; কিন্তু এই অধর্মের গ্লানি হইতে আপনার মনকে বাঁচাইতে হইলে একটা বড়ো বুলির ছায়া লইতে হয়” (সুত্র-রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক চিন্তা, চিন্মোহন সেহানবিশ, রবীন্দ্রনাথ শতবার্ষিকী প্রবন্ধ সংকলন, এনবিএ, পৃ ১৬৯) আক্ষরিক অর্থেই, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, আন্তর্জাতিক চিন্তা নায়ক এই রবীন্দ্রনাথকে তাই দ্বিধাহীন ভাবে “ইম্পিরিয়ালিজম” সম্পর্কে ক্রুদ্ধ হয়ে উচ্চারণ করতে শোনা যায়,“ একটি সমগ্র জাতিকে অর্থের লোভে বলপূর্বক বিষপান করানো হইল। এমনতর নিদারুন ঠগীবৃত্তি কখনো শুনা যায় নাই। চীন কাঁদিয়া কহিলঃ ‘আমি অহিফেন খাইব না।’ ইংরেজ বণিক কহিল ‘সে কি হয়?’ চীনের হাত দুটি বাঁধিয়া তার মুখের মধ্যে কামান দিয়া অহিফেন ঠাসিয়া দেওয়া হইল ; দিয়া কহিল‘ যে অহিফেন খাইলে তাহার দাম দাও।’ বহুদিন হইল ইংরেজরা চীনে এইরূপ অপূর্ব বানিজ্য চালাইতেছেন। ”(সুত্রঃ ঐ, পৃঃ১৫৭) আজকের বিশ্বে ক্রমাগত গিরগিটির মতো রঙ বদলে ফেলা ধান্দার ধনতন্ত্রের ক্লেদাক্ত চেহারা, জীবনের মূল্য নির্ধারণে সমাজবাদের সঙ্গে এখনো তার মৌলিক পার্থক্য দেখে এটা বুঝতে কী খুব অসুবিধা হয় যে, তৎকালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির, রাষ্ট্রনীতির অমিমুখ, গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণে রবীন্দ্রনাথ কত গভীর বস্তুনিষ্ঠতার অধিকারী ছিলেন! সভ্যাতার অগ্রগমনে বিশ্ব মানবতার, অপরিমেয় মানবিক মূল্যবোধের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের স্থানাধিকারী রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় জন সমাজের আভ্যন্তরীণ দগদগে কাঠামোর দিকেও তাঁর তীক্ষ্ণ, শানিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যা বলেছেন এবং প্রতিকারের পথ বাতলেছে আজো তা সমানভাবে প্রণিধান যোগ্য এই বিবেচনায় তার উল্লেখ করে এ লেখার ইতি আপাতত টানা যেতে পারে,“ আমাদের ভদ্রসমাজ আরামে আছে, কেননা আমাদের লোকসাধারণ নিজেকে বোঝে নাই। এইজন্যই জমিদার তাহাদিগকে মারিতেছে, মহাজন তাহাদিগকে ধরিতেছে, মনিব তাহাদিগকে গালি দিতেছে,পুলিস তাহাদিগকে শুষিতেছে, গুরুঠাকুর তাহাদের মাথায় হাত বুলাইতেছে, মোক্তার তাহাদের গাঁট কাটিতেছে, আর তাহারা কেবল সেই অদৃষ্টের নামে নালিশ করিতেছে যাহার নামে সমন-জারি করিবার জো নাই। আমরা বড়োজোর ধর্মের দোহাই দিয়া জমিদার কে বলি তোমার কর্তব্য করো, মহাজন কে বলি তোমার সুদ কমাও, পুলিসকে বলি তুমি অন্যায় করিয়ো না—এমন করিয়া নিতান্ত দুর্বলভাবে কতদিন কতদিক ঠেকাইব। চালুনিতে করিয়া জল আনাইব আর বাহককে বলিব যতটা পারো তোমার হাত দিয়া ছিদ্র সামলাও। সে হয় না ; তাহাতে এক সময়ে এক মুহূর্তের কাজ চলে কিন্তু চিরকালের এ ব্যবস্থা নয়। সমাজে দয়ার চেয়ে দায়ের জোর বেশী। অতএব সব-প্রথমে দরকার, লোকেরা আপনাদের পরস্পরের মধ্যে যাহাতে একটা যোগ দেখিতে পায়। অর্থাৎ পরস্পরের মধ্যে একটা রাস্তা থাকা চাই। সেটা যদি রাজপথ না হয় তো অন্তত গলিরাস্তা হওয়া চাই। লেখা পড়া শেখাই এ রাস্তা। ”(লোকহিত)। যিনি বলেছিলেন,“ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে”(সভ্যতার সংকট) তাঁর সেই বিশ্বাসের প্রতি নিঃর্শত আত্মসমর্পণ করে আসুন আজ তাঁর পূণ্য জন্মদিবসে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার প্রতিভাসে পরিশুদ্ধ করি আমাদের বন্ধুর অথচ বিজয়ীর পদযাত্রা