কলমের খোঁচা

রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহী নারী


মল্লিকা গাঙ্গুলী: চিন্তন নিউজ:৮ইমে:- বাংলা ও বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উজ্বল ভাস্কর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই এক মহৎ বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্র সাহিত্য চেতনা কে বিশ্লেষন করা নিতান্ত স্পর্ধার পরিচয়। সুদীর্ঘ দেড় শতাব্দী প্রাচীন রক্ষণশীল বঙ্গ সমাজে বসে যে গভীর প্রজ্ঞা প্রত্যয় ও অনন্যসাধারণ মনোবিশ্লেষন করে কবি তার চরিত্রগুলি চিত্রিত করেছেন সেই চরিত্র গুলি যেন আজ ও সমান প্রাসঙ্গিক এবং জীবন্ত। সমগ্র রবীন্দ্র সৃষ্টি থেকে কবির ভাবনায় নারী বা আরো ছোট করে রবীন্দ্র কাব্য উপন্যাসের বিদ্রোহীনী নারীদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে- কবি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নারী চরিত্রের গহনে ডুব দিয়ে অবলোকন করেছেন নারীর মনোভূমিকে। প্রতিটি চরিত্র আলাদা আলাদা অথচ তিনি একই সুতোয় গেঁথেছেন প্রত্যেকটি নারীর ভিতরের সুপ্ত বিদ্রোহী ভাবনাকে।

রবীন্দ্র রচনাবলীর বিশাল বিপুল জলধীতে সাঁতার কাটা সহজসাধ্য নয়; বিশেষ কিছু নারীচরিত্রের অন্তর্বেদনার দিকে নজর দিলেই রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহী নারী ভাবনার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম এবং প্রধান পরিচয় তিনি কবি; শুধু কবিমাত্র নন বিশ্বকবি। তাঁর কাব্য পরিক্রমায় প্রতিবাদী নারীসত্তার বিশেষ উদাহরণ মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা। রাজনন্দিনী চিত্রাঙ্গদা অর্জুনকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন- “নহি দেবী -নহি সামান্যা নারী/ পূজা করি… যদি পার্শ্বে রাখো মোরে/ সঙ্কটে সম্পদে/ সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে/ পাবে তবে চিনিতে মোরে।” অর্থাৎ নারীকে যেমন দেবীর আভরণে আদর্শ লোকে স্থাপন করা যায় না তেমনি অবহেলার পাত্রী ও নারী নয়। পুরুষের জীবনে রমনীর ভূমিকা তখনই সার্থক হবে যদি নারীকে নিছক নর্মসঙ্গীনী হিসাবে নয় প্রকৃত কর্মসঙ্গীনী রূপে তাকে তার সামাজিক অবস্থানে সুদৃঢ় করা হয়। মহুয়া কাব্যের “সবলা” কবিতায় নারীর বলদৃপ্ত আত্মঘোষনা- “নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার /কেন নাহি দিবে অধিকার/ হে বিধাতা… নত করি মাথা প্রান্তে কেন রব জাগি!!” মানসিক ভাবে চির স্বাধীন এই নারীকে রবীন্দ্র কাব্যে বারবার দেখা যায়। ‘বিদায় অভিশাপ’ এর দেবযানী বা ‘চণ্ডালিকা’ র চন্ডাল কন্যা যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আর “সাধারণ মেয়ে” কবিতায় বঙ্গ রমনীর এক অদ্ভুত ফ্যান্টাসি- কল্পনাবুনন।

সমাজ চেতনার এক প্রখর আলো “পুনশ্চ” কাব্যের ‘সাধারণ মেয়ে’টিকে করে তুলেছে অসাধারণ। এই কবিতার আঙ্গিকের গদ্য ছন্দে আছে প্রথাভাঙার বিপ্লব, আবার কবিতায় নারীদরদী ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের প্রশস্তি, অপরদিকে সমাজের প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে নারীর ক্ষোভ অভিমানের ধূমায়িত বিদ্রোহী গুঞ্জরণ শোনা যায়- “আমি অন্তপুরের মেয়ে চিনবে না আমাকে!”- এই অতি সাধারণ মেয়ে টির জীবনের গল্পে সেই তথাকথিত পুরুষের প্রতি প্রতিবাদ; যে পুরুষ নারীর বাইরের আলগা লাবণ্যে ভোলে, তলিয়ে দেখতে চায় না মেয়েটির ভিতরের অসাধারণত্বকে। কবিতার ছত্রে ছত্রে সাধারণ মেয়ে মালতী আর তার কল্পনার পুরুষ নরেশের গল্পে পুরুষ প্রধান সমাজে নির্যাতিতা রমনীর বুকের গভীরে বিদ্রোহের বানী গুমরে মরে। তবে নারীকে লেখাপড়া শিখে আত্ম শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সমাজের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে এ ইঙ্গিত ও কবি ই দিয়েছেন। জীবনে হার মেনে নয় সক্রিয় ভাবে না হলেও অন্তত নিষ্ক্রিয় ভাবে চেতনায় নারীকে বিদ্রোহী হতে হবে বলে কবি মনে করেন। সমাজে নারীর অবস্থান পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক নারীর যৌনতা তার নৈতিকতা সম্পর্কে বহুল মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষন হয়ে থাকে। বিশ্ব মনস্তত্ত্বের সর্বত্র কমবেশি নারী সন্তান উৎপাদপন কারিনী, গৃহ পারিপাট্য সাধিনী। পরিবারের সেবা তার ধ্যান জ্ঞান এবং শেষ পর্যন্ত সে শুধুই জননী স্নায়ুসর্বস্ব ভাবাবেগে ছিন্ন ভিন্ন এক রমনী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সংসার খাঁচায় বন্দিনী নারীকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ যেমন “পঞ্চভূত” গ্রন্থের ‘নরনারী’ বা “কালান্তর” গ্রন্থের ‘নারী’ প্রবন্ধে মুক্ত নারীর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

যদি রবীন্দ্র উপন্যাসে উঁকি দেওয়া হয় সেখানে ও নারী যথেষ্ট আত্মসচেতন। বিশেষ করে চোখের বালি’র বিনোদিনী। ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বে নারী পুরুষের যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব বিরোধিতা ও প্রতিযোগিতার ভাব যা থেকে জন্ম নেয় এক আক্রমণাত্মক তিক্ততা- সেই আভাস মেলে বিনোদিনী চরিত্রে। ‘চোখের বালি’র মহেন্দ্র-বিনোদিনীর প্রেমে ভালোবাসা বা আকর্ষণ যতখানি আছে অ-ভালোবাসা বা বিকর্ষণ ও কিন্তু কম নয়। বিনোদিনীর মুখে- “আমি কি জড়পদার্থ। আমি কি মানুষ না। আমি কি স্ত্রীলোক নই।একবার যদি আমার পরিচয় পাইত তবে আদরের চুনির সঙ্গে বিনোদিনীর প্রভেদ বুঝিতে পারিত।” এখানেই বিনোদিনীর আত্ম শ্লাঘা। শুধু তাই নয় রবীন্দ্র উপন্যাসে বিনোদিনী চরিত্রটিই যেন বিদ্রোহী নারীর প্রতিভূ। সে অল্পবয়সী বিধবা, উত্তাল যৌবনা, সুন্দরী,মোহময়ী, ব্যক্তিত্ব সম্পন্না নারী। যে নিজের জীবন পিপাসা কে সমাজের যূপকাষ্ঠে বলি দিতে পারে নি,চায়ওনি। চরম পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর স্বাধিকার রক্ষার উদ্ধত আত্মঘোষনা বিনোদিনীর নারীধর্ম। বিশ্ব কবির আর এক আকর্ষণীয় প্রতিবাদী নারী ‘ঘরে বাইরে’র বিমলা। নিখিলেশের স্ত্রী হিসেবে সাজানো গোছানো ললিত সংসার সুখের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ। বিমলার অবৈধ প্রণয়কে আশ্রয় করে সমাজ খাঁচা থেকে স্বাধীন ডানা মেলে আত্মপরিচয় পাওয়ার প্রবল প্রচেষ্টার নামই বিপ্লব। যদিও তার অবৈধ প্রেম এসেছিল সমাজ অনুমোদিত দেশ প্রেমের ছদ্মনামে। গল্পের পরতে পরতে নানান ঘাত প্রতিঘাতে বিমলা চরিত্রের যে উন্মোচন সেখানে ন্যায় অন্যায়ের উর্দ্ধে বিমলার বিদ্রোহী নারীসত্তার বিকাশ। আদর্শ সৎ চরিত্রবান অথচ নিরুত্তাপ স্বামী নিখিলেশের সঙ্গে বিমলার দাম্পত্য সম্পর্কের একঘেয়েমি তাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। ঠিক সেই সময় সন্দীপ তার জীবনে এক ঝলক সতেজ বাতাস শুধু নয় যেন দমকা ঝড়; বিমলার সমস্ত সংস্কার,সমাজ সংসার সব এলোমেলো করে দিল। সন্দীপের আপাত মোড়কে মোড়া স্বদেশীয়ানা তার সুতীব্র সপ্রতিভ আত্ম ঘোষনা ভয়ংকর অলংকরণে নিজেকে শিক্ষিত, নানান প্রতিভা প্রকাশে পারদর্শী এহেন এক দুর্ধর্ষ পুরুষের কাছে বিমলার যথার্থ সৎ মানবিক স্বদেশেপ্রমী প্রকৃত পুরুষটি ম্লান হয়ে যায়।সাময়িক বিকৃতি হলেও বিমলা সন্দীপের মধ্যে ই তার প্রার্থিত পুরুষ টি কে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। বিমলা আসলে এক প্রকৃত বিদ্রোহী নারী। সতীত্ব নামক সংস্কারের বাইরে এসে দাঁড়ানোর সাহস সে রাখে। নারী সবসময় সব ক্ষেত্রে পুরুষের ইচ্ছার ছায়া মাত্র নয়। তার স্বতন্ত্র সত্ত্বা আছে। অবচেতন মনে থাকা প্রবল বাসনা তাকে নতুন পথে যেতে সাহসী করে। উপন্যাসেে র শেষে গিয়ে বিমলার মোহ কাটালেও আসলে বিমলা রক্ত মাংসের মানবী। নিখিলেশের ভালোমানুষী সততা যত্নবান স্বামী সত্ত্বা ছাড়াও এক উদ্দাম সাহসী বেপরোয়া পুরুষ কে সে কামনা করে। সন্দীপ রাংতায় মোড়া ভেকধারী স্বদেশী হলেও বিমলা নারীহৃদয় জয় করার সমস্ত কৌশল তার ছিল। আর ভালোবাসার জন্য সর্বস্ব বাজি রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ী বিমলা ঘরের থেকে বাইরে বেরিয়ে প্রবল ভাবে প্রতিবাদী নারী। রবীন্দ্র সাহিত্যে বিদ্রোহী নারীর মনোবিশ্লেষনের এই অসাধারন দক্ষতা কবি অর্জন করেছিলেন নিজস্ব বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতা লব্ধ গভীর বোধ দিয়ে।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির শিক্ষা সহবৎ আর পরিবারের কিছু বিশিষ্ট মহিলার বলিষ্ঠ উপস্থিতি কবি মনোভূমে নারী বিদ্রোহের ভূমিকা প্রস্তুত করে দিয়েছিল।ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ, ঠাকুর বাড়ীর পাশ্চাত্য আধুনিকতার প্রভাব পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথের সমাজ সংস্কার পিতা দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের ব্রাহ্ম সমাজ পরিচালনা সেকালের সমাজ শৃঙ্খল মুক্তির ইতিহাস। ব্রাহ্ম বাদী আধুনিক ঠাকুর বাড়ীতে কবি অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্র নাথের আধুনিক প্রথাবিরূদ্ধ মনোভাবের প্রভাব শুধু সমাজে নয় বিশেষ ভাবে ঠাকুর বাড়ীর মহিলা মহলের উপর ও পড়েছিল। সেই পরিমণ্ডলে সত্যেন্দ্রনাথ পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী এবং জ্যোতিদাদার স্ত্রী কাদম্বরী দেবী কবির ‘নতুন বউঠান’ যিনি কবির আকৈশোর সাহিত্য চর্চার প্রধান উৎসাহদাতা। আর ছিলেন কবির বড়দিদি যিনি বেথুন কলেজের প্রথম বাঙালি নারী সে যুগে সেমিজ গায়ে খোলা পালকি চড়ে স্কুলে যাওয়ার সাহস দেখান! আর ঘরের বাইরে সদ্য যুবক কবি মুক্ত নারী হিসেবে প্রত্যক্ষ করলেন বোম্বাইয়ের বিলাত ফেরত মারাঠী রমনী আন্না তড়খড় কবির নলিনী কে। এরপর কবি তার সুদীর্ঘ জীবনে দেশে বিদেশে বহু নারীর সঙ্গ ও সাহচর্যে আসেন এবং কবির নারী মুক্তি ভাবনা সুদূর দিগন্তে পাখা মেলে।

একজন পুরুষ হয়ে নারী মনের আনাচে কানাচে অবাধে প্রবেশ করতে সক্ষম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রকৃত প্রেমিক প্রবর রবীন্দ্র চেতনায় নারী নিছক দেহমাত্র নয়। এক সজ্ঞান সচেতন অনুভূতিশীল সর্বোপরি স্বাধীন ব্যক্তি সত্ত্বা। নারী হৃদয় অতলে অবগাহন করে কবিগুরু নারীকে শুধু অন্তঃপুর বাসিনী কন্যা- ভগিনী- জায়া বা মাতা হিসাবে নয় প্রকৃত মানবসত্তায় পুরুষের সহযাত্রী রূপে আত্মপ্রকাশ করাতে চেয়েছিলেন। সর্বকালের নারীবাদ, নারী স্বাধীনতা প্রচারে নিঃসন্দেহে পথ প্রদর্শক বিশ্বকবি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।