কলমের খোঁচা

দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে — সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:৯ই জুন:- কোনোদিন আপাত সাফল্যের রাঙতায় মোড়া কোনকিছু স্থায়ী হয় না। আজ যে বিষয় নিয়ে শ্লাঘা বোধ করছি তা প্রকৃতপক্ষে ক্রমশ পুঞ্জীভূত ঘৃণার দিনলিপি হয়ে উঠবে নাতো ? যা হয়তো ভীষণ বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে যে কোনো দিন, যে কোনো সময়!” হয়তো প্রাসঙ্গিক, হয়তো বা নয়, তবু মনের খেয়ালে এই শিক্ষার আতস কাঁচের তলায় বর্তমান ঘটনা প্রবাহকে বিবেচনায় রেখে আমাদের দেশের এবং রাজ্যের সর্বময় কর্তা, কর্ত্রীদের লীলাখেলা সম্পর্কে একটি দুটি কথা যদি তুলে ধরা যায় তাহলে কী খুব গর্হিত কাজ কিছু হবে ? এই যেমন ধরুন আমাদের কর্তব্যনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী “মন-কী-বাত”, “দিয়া জ্বালাও,থালা বাজাও” আর “প্যাকেজ” এই থ্রি লেয়ার “N-95” মাস্কের নিরাপদ আড়ালে কেমন,— ১) দেশের ১০ কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের আপন ঘরে ফিরতে চাওয়ার সাংবিধানিক আইনী অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য সম্পাদনের বদলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আসার আগে পর্যন্ত অবজ্ঞা, উপেক্ষা আর লাঞ্ছনার চুড়ান্ত নষ্টামি করলেন, আক্ষরিক অর্থেই নরক যন্ত্রণাময় অসহায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ার সবচাইতে বৃহৎ, শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ শ্রমশক্তিকে ! কপর্দকশূন্য, অভুক্ত তাদের খোলা আকাশের নীচে একেবারে রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য করলেন, ২) গোটা কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষকের পথে বসার সুবন্দোবস্ত করে শুধু লুঠেরা কর্পোরেট গ্রুপের স্বার্থে সর্বনাশা কৃষি অর্ডিন্যান্স বহাল করলেন, এমনই তার মাহাত্ম যে কৃষিতে সামান্য যা সরকারী কৃপাদৃষ্টি ছিল তাও উধাও। তার মানে করোনা কারনে আত্মত্যাগ করবে কৃষক আর খোদ সরকারকে পাহাড়াদার করে লুঠবে মোদীজির স্নেহধন্য দেশপ্রেমিক বেনিয়াকূল। ৩) দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প রেলের তো এই লকডাডাউনের সময়েই ‘মাল্টি স্কিলিং’য়ের নামে ব্যাপক ছাঁটাই আর ঢালাও বেসরকারী করণের দরজা হাট করে খুলে দিয়ে তার অন্তর্জলিযাত্রা প্রায় চুড়ান্ত করেই ফেলেছেন। শ্রমনিবিড় এই শিল্পকে ধ্বংস করার প্রকৃত রাষ্ট্র নায়কোচিত বিভঙ্গে মোদীজি বুঝিয়ে দিয়ছেন তার আসল ‘মন কী বাত’ ৪) স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা, আইসিডিএস,১০০ দিনের কাজ, গ্রামীণ উন্নয়ন, নারী ও শিশু কল্যাণ- সব জরুরী ক্ষেত্র গুলিতে ‘করোনা প্যাকেজে’ -য়ের ছলনায় ব্যাপক ব্যয় বরাদ্দ ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে, অথচ প্রায় সব অংশের অর্থশাস্ত্রী, সমাজবিজ্ঞানী, সমাজকর্মীদের পরামর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ দেশের বামপন্থীদের উথ্বাপিত *আয়কর দেননা এমন সমস্ত পরিবারকে ছ’মাস মাসিক ৭৫০০ টাকা নগদ * রেগায় বর্ধিত মজুরি সহ অন্তত ২০০ দিনের কাজ * শহরের গরিবদের মধ্যে কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প চালু করা এবং * বেকারভাতা চালু এই দাবীগুলির স্থান হচ্ছে ডাষ্টবিনে । ৫) দফায় দফায় লকডাউনের সুযোগকে দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পবিত্র কাজে লাগিয়ে দরদী মোদীজি দেশের এমনিতেই রাষ্ট্রীয় বদান্যতায় আর্থিক ভাবে দরিদ্রতম এবং বিপুল জনসংখ্যাধিক্য অংশ শ্রমজীবী জনগণকে গভীর অন্ধকারে নিক্ষেপ করে নতুন শ্রম আইন লাগু করার কাজও পাকা করে ফেললেন। আপাতত বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার গুলি তার পরীক্ষাগার। কি বলা হলো সেখানে ? ক) চাকরির জন্যে কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হবে না, খ) পিএফ, গ্র্যাচুইটির দাবী করা যাবে না, গ) কোনো ইউনিয়ন বা আন্দোলনের অস্তিত্ব থাকবে না, ঘ) কাজের সময়সীমা মালিক নির্দিষ্ট করবে, অতিরিক্ত কাজের জন্যে কোনো অতিরিক্ত মজুরি মিলবে না, ঙ) বছরে ছুটির কোনো অধিকার থাকবে না, চ) সকল কাজের চরিত্র হবে অস্থায়ী সুতরাং বরখাস্ত করার সম্পূর্ণ অধিকার মালিকের এবং এক্ষেত্রে শ্রমিকের আইনী সহায়তার রক্ষাকবচ বিলুপ্ত হবে, ছ)বোনাসের অধিকার, মহিলাদের মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার লোপ পাবে, জ) কর্মক্ষেত্রে আঘাত ও অঙ্গহানির ক্ষতিপূরণের, পেনশনের, শ্রমিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার অধিকার থাকবে না, ঝ) শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি হবে মালিকের ইচ্ছাধীন ইত্যাদি। এতে দেশের,দেশের বাইরের ‘মুনাফা (আসলে ধান্দা) স্বর্গ, মুনাফা ধর্ম’ ধান্দার ধনতন্ত্রের একনিষ্ট উপাসকদের চিত্ত বিগলিত হর্ষধ্বনি আর থামেনা। সবাই যেন, সবই যেন মোদী ময় ! কারন তাদের আসল এবং একমাত্র লক্ষ্য কি করে এমনকি করোনার করাল গ্রাস থেকেও “প্রফিট” গোছানো যায়, মানুষের সর্বনাশ আর রক্তচোষাদের পৌষমাস। সেক্ষেত্রে আবার রাষ্ট্র তাদেরই সহায়। ‘আম আদমির’ নয়। একটা ভোটের পর আরেকটা ভোট পর্যন্ত আম আদমির জন্যে ভেবে ফালতু সময় নষ্ট করে কি লাভ! আবার ভোট আসুক তখন দেখা যাবে। “জাতের নামে বজ্জাতি”র তাস তো আছেই। কিন্তু তারপর ? এই আপাত ‘সাফল্যের’ কদর্য পুঁজিবাদের সঙ্গে ধান্দার ধনতন্ত্রের সেবাদাস রাষ্ট্রের মধুচন্দ্রিমাই কি ইতিহাসের শেষ ধাপ ? প্রশ্ন টা সহজ উত্তরটাও জানা,—না,এবং না। এগিয়ে চলাই ইতিহাসের ধর্ম, পশ্চাৎপদতার সঙ্গে ইতিহাসের সখ্যতা ? নৈব নৈব চ।এবার আমাদের এই রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর দিকে একবার সুখদৃষ্টি ফেরান, দেখুন ! ১) করোনা বিপদকে প্রথম থেকে লঘু করে দেখে, চালাকি করে ঘেঁটেঘুঁটে একাকার করে এখন সব নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি হাত তুলে দিয়েছেন। তাতেই তাঁকে নামী সাহিত্যিক বলছেন ‘বাঘিনী’, ‘ঝাঁসির রাণী’, গানওয়ালা তাঁর মধ্যে দেবীত্ব লেপে দিয়ে গান বাঁধছেন,গাইছেন, হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙ বাজিয়েরা তোষামুদে ঢোল বাজাচ্ছেন,প্রসাদ প্রত্যাশী লিখিয়ে নিবিড় চাটুকারিতায় পাতার পর পাতা ভরিয়ে তুলছেন, কিন্তু এটাই কি তাহলে “সভ্যতার শেষ পুণ্য বানী” ? ২) পরিযায়ী শ্রমিকদের সেই প্রথম থেকেই তিনি ফেরৎ আনতেই চাননি, যখন তারা অনেক টালবাহানার পর এলেন তখনো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশ মতো তাদের জন্যে কোনো রকম আগাম ব্যবস্থাতো তিনি করলেনই না উল্টে শ্রমিকদের নিয়ে আসা ট্রেনকে কটাক্ষ করে বললেন। কি বলে ? “করোনা এক্সপ্রেস”! বলা যায়! মুখ্যমন্ত্রীর মতো এমন দায়িত্ব পূর্ণ জায়গায় থেকে নিতান্ত অসহায় মানুষের সঙ্গে এই রকম চটুল, অশ্লীল রঙ্গ- রসিকতা করা যায় ! শুধু কি তাই, কোয়ারেন্টিন সেন্টারে পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকা, খাওয়ার চরম অব্যবস্থায় সঙ্গত ক্ষোভ কে উপহাস করে তার ‘ধন্যি মেয়ে’ সাংসদ বললেন, এখানে সবাইকে জামাই আদর দেওয়া সম্ভব নয়!, “একেই কি বলে সভ্যতা”? গরিব অসহায় মানুষকে নিয়ে এই অশ্লীল উপহাস জিতে যাবে ? এই রাজ্যে ভয়াবহ করোনা প্রকোপে লকডাউনের গোটা সময়টাতে শাসক দল হিসাবে যে তৃণমূল দেদার গরিবের চাল চুরি ছাড়া কিছুই করলো না সেই দল পরিচালিত একটি সরকারের এইরকম বেয়াদপি সহ্য করবে মানুষ ? ৩) আমপান ঝরের পরে সাতদিন সরকার হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলো, মুখ্যমন্ত্রী নিজে শুধু ঘুমিয়ে থাকলেন না, তার সাধের প্রশাসনকেও ঘুম পারিয়ে রাখলেন তারপর যখন নাকি মানুষ সরকারী সহায়তায় সব ভরসা হারিয়ে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বামপন্থীদের, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের দিকেই তাকিয়ে থাকলেন তখন হঠাৎ জেগে, রেগে উঠে তিনি ফরমান দিলেন সরকার ছাড়া কেউ ত্রাণ দিতে পারবে না। উদ্ধত, আর অসহ্য তাঁর হুঙ্কার, তাতেও চিটফান্ড ওয়ালা কাগজগুলোর গদগদ ভাব আর ধরে না। কিন্তু এই হাততালির, এই বেলেল্লাপনার ইতিকথাই কী শেষ ? আর ঘৃণার দিনলিপি ? তা কী মূল্যহীন ? তার কি আর পর নেই ? নেই কোনো ঠিকানা ? আছে, নিশ্চয় আছে। তারও পর আছে, পরেরও আছে ঠিকানা। সেই “ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে / ক্ষুব্ধ এদেশে রক্তের অক্ষরে।” কেউ পার পাবে না। না মোদী, না মমতা। ইতিহাসের কাছে প্রাণপণে পৃথিবীর জঞ্জাল সরানোর অঙ্গীকারের কবি আমাদের মুখে যুগিয়ে দিয়ে গেছেন প্রতিবাদের ভাষা, ছুটিয়ে দিয়ে গেছেন প্রতিরোধের আগুন, “আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই / স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের / চিতা আমি তুলবই।”
——————


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।