শহিদ আমীর হোসেন চৌধুরী (১৯১০-১৯৬৪)
অবিভক্ত পাকিস্থানে চৌষট্টির আদমজি পাটকলকে কেন্দ্র করে মূলত ভাষাভিত্তিক যে দাঙ্গা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্থানে শুরু হয়েছিল,তা অচিরেই ধর্মীয় দাঙ্গাতে পর্যবসিত হয়।এই দাঙ্গার শহিদ, নজরুল গবেষক, অনুবাদক ও বুদ্ধিজীবী আমীর হোসেন চৌধুরী।
তাঁর জন্ম ১৯১০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বর্তমান ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার রাইপাড়ায় । তাঁর পিতা তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এবং মাতা হোমায়েরা খাতুন ছিলেন শিক্ষাব্রতী বেগম রোকেয়ার ছোট বোন । হোমায়েরা রোকেয়ার ঘনিষ্ঠ সাহচার্য পেয়েছিলেন।রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর পর তাঁর মেয়েদের জন্যে ভাগলপুরে ইস্কুল প্রতিষ্ঠার সবথেকে সহায়ক ছিলেন এই মহীয়ষী নারী।
মাত্র ১২ বছর বয়সে আমীর হোসেন চৌধুরীর পিতৃবিয়োগ ঘটায় মায়ের সাথে কলকাতায় তাঁর মাসী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের কাছে চলে যান । সেখানে আবার লেখা-পড়া শুরু করেন এবং ১৯৩৩ সালে ইসলামিয়া কলেজ( আজকের মৌলানা আজাদ কলেজ) থেকে বি. এ. পাস করেন । আমীর হোসেন চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে যুক্ত থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন ।
রাজনৈতিক কারণে কয়েকবার কারাবরণও করেছেন । ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে আসেন । আমীর হোসেন চৌধুরী সরকারি চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও স্বাধীনচেতা হওয়ার কারণে চাকরি ছেড়ে তিনি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন ।
কলা বিভাগের ছাত্র হয়েও ব্যবসাক্ষেত্রটি নির্বাচন করেন বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মক্ষেত্রকেই অবলম্বন করে । এক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ পুরুষ ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী ডঃ কুদরত-ই-খুদা । তাঁরই অনুপ্রেরণায় তিনি রসায়ন শিল্পকারখানা স্থাপন করেছিলেন । আমীর হোসেন চৌধুরীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘রিমা কেমিক্যাল’ । ১৯৫৬ সালে পাট থেকে গবেষণা করে তিনি ‘ডুরেক্সিন’ উদ্ভাবন করেন ।
৫২’র ভাষা আন্দোলনে আমীর হোসেন চৌধুরী সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনেও তিনি সাংগঠনিক পর্যায় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । পারিবারিকসূত্রেই আমীর হোসেন চৌধুরী সাহিত্য সাধনায় ব্রতী ছিলেন । তিনি জীবনবোধ কে বিজ্ঞানমনস্কতা এবং অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল চেতনায় নিবেদিত করেছিলেন।
আমীর হোসেন চৌধুরীর সাহিত্য সাধনার আদর্শ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও মুকুন্দ দাস এবং তাঁর মাসী রোকেয়া আর রোকেয়ার মন্ত্রশিষ্য সুফিয়া কামাল।‘নজরুল কাব্যে রাজনীতি’, ‘নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ (পুস্তিকা) সহ একাধিক প্রকাশিত গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন।
আদমজি পাটকলকে কেন্দ্র করে ‘যে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল , সেই দাঙ্গার প্রবাহমানতা দীর্ঘকাল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে ছিল।সেই দাঙ্গার প্রবাহমানতায় ৬৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে শহিদ হন বিজ্ঞানমনস্ক ও অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল চেতনায় সমৃদ্ধ নজরুল বিশেষজ্ঞ আমীর হোসেন চৌধুরী ।