কলমের খোঁচা

“স্পর্ধিত বিবেক”—মৃত্যুঞ্জয়ী সোমেন চন্দ –সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:২৪শে জুন:–

তাকে তুমি চেন না, আমিও না,
তাতে তার কি এল গেল!
চুপিসারে তার আসা ও যাওয়ার,
সময়, একশ পেরিয়ে গেল।
ইতিহাস তাকে জন্ম দিয়েছে,
ইতিহাস তাকে চেনে—
জীবন দিয়েই, প্রতি জন্মে
সে মৃত্যুকে নেয় কিনে।

বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি বাদ দিয়ে সম্ভব নয় আবার স্বাধীনতা পূর্ব ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ তাঁকে ছাড়া এদেশে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক তথা বামপন্থার “দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার” অতিক্রমের দুঃসাহসিক অভিযাত্রার রোমাঞ্চকর কাহিনীও প্রশ্নহীন ভাবে অসম্পূর্ণ, অনুজ্জ্বল। অথচ অন্তহীন বিস্ময় এই যে, ফেলে আসা শতাব্দীর ১৯২০ সালের ২৪ শে মে এই গ্রহে তাঁর আসা, আর ১৯৪২ য়ের ৮ ই মার্চ নির্মম মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বড়ো অসময়ে তার চলে যাওয়ার মধ্যে ব্যবধান মাত্র ২১ বছর ৯ মাস ১৫ দিন। তিনি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা লেখক, শিল্পী,স্রষ্ঠাও। সেই তিনিই আবার গরিব সূতাকলের শ্রমিক বস্তির, মুটে মজুরের, রিকশা চালকের স্বপ্নহীন জীবন যুদ্ধে অক্ষয় নিরাপত্তা বোধ। ১৭ থেকে ২১ এই ঠিক মাত্র পাঁচ বছর তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির সময় কাল। অন্তহীন আশ্চর্যের আঁধারে বন্দী না হয়ে উপায় থাকে না সাধারণের মধ্যে তো বটেই, অনুল্লেখনীয় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমনকি বামপন্থী প্রগতিশীল চিন্তা ও চর্চা জগতেও বিস্মৃত প্রায় তিনি যেন প্রায় সবার অলক্ষ্যেই পেরিয়ে গেলেন এই ধরাধামে তার জন্মের গোটা একটা শতাব্দী। কেমন যেন উন্নাসিক উপেক্ষার অথবা সময়ের অপচয় বিবেচনায় খানিক বোধহয় এড়িয়েই যাওয়া হলো তাকে। অথচ ঠিক এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। বিশেষ করে আজ যখন বিশ্বের, দেশেরও প্রগতিপন্থা নতুন রণসাজে সজ্জিত ফ্যাসিবাদী শক্তির চ্যালেঞ্জের সামনে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলার প্রজ্ঞায় নিজেকে প্রাণীত করছে। মাত্র ২১ বছর বয়সে তার অমূল্য জীবন তিনি আহুতি দিয়ে গিয়ে ছিলেন শ্রমজীবি জনতার মুক্তিযজ্ঞে। জীবনের স্বার্থকতার অর্থ খুঁজে ছিলেন মৃত্যুর অভিধানে। তাঁর জন্মশতবর্ষে বামপন্থী যৌবনও কেমন যেন নিস্তরঙ্গই থেকে গেল। কে তিনি ? তিনি সোমেন চন্দ। “সোমেন চন্দ, উলঙ্গ বিদ্যুৎ / সোমেন চন্দ, স্পর্ধিত বিবেক / সোমেন চন্দ, মানুষের মুখ।”(সোমেন চন্দকে-রাম বসু)। ১৯৪২ সালের ৮ ই মার্চ ঢাকায় এক ফ্যাসি বিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে রক্ত পতাকা হাতে শ্রমিকদের একটি মিছিল নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় ক্লীব ফ্যাসিস্ট জল্লাদ বাহিনীর অতর্কিত হামলায় ‘নীল আকাশে নীচে এই পৃথিবী, আর পৃথিবীর পরে ওই নীল আকাশ’কে সাক্ষী রেখে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন সোমেন চন্দ। সাহিত্য স্রষ্ঠা সোমেন চন্দ, কমিউনিষ্ট বিপ্লবী সোমেন চন্দ। সাহিত্য সৃষ্টির আকর অনুসন্ধানে যিনি গরিব শ্রমিক বস্তিকেই করে ছিলেন সুখের আস্তানা,ওই বয়সেই দ্বিধার তুচ্ছ বাঁধন মুক্ত হয়ে বলতে পেরেছিলেন, “শ্রমিক বস্তিতে একবার না গেলে আমি লিখতে পারিনা” লাল পতাকা হাতে তাঁর সেই পরমাত্মীয় সর্বহারা শ্রমিকদের সব পাওয়ার স্বপ্নমাখা চলমান দৃপ্ত মিছিলেই আত্ববলিদান দিয়ে তিনি সেদিন যেন কবি গুরুর দুর্বার মর্মবাণীকেই স্বার্থক করে তুলেছিলেন, “কী গাহিবে, কী শুনাবে! বলো, মিথ্যা আপনার সুখ, / মিথ্যা আপনার দুঃখ। স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ / বৃহৎ জগৎ হতে সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে। / মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে / নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা / মৃত্যুরে করিনা শঙ্কা।”(এবার ফিরাও মোরে)। ক্লীবতার কাছে ঋণী হওয়ার চেয়ে অমূল্য জীবনের বিনিময়ে সূর্যের তারুণ্যে রচনা করে গেছেন যিনি মহান আদর্শকে অম্লান রাখার অতুলনীয় গৌরব গাথা তিনিই সোমেন চন্দ। যাঁকে “আমাদের সমাজ ও সাহিত্য জীবনে এক অসামান্য, অবিস্মরণীয় প্রতিভা” বলে উল্লেখ করেছেন কমিউনিষ্ট নেতা, বামপন্থী বুদ্ধিজীবি,লেখক, যশস্বী অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মাত্র ১৭ থেকে ২১ বছরের মধ্যে ‘শিশু তপন’, ‘স্বপ্ন’, ‘মুখোশ’ ,‘অমিল’,‘পথবর্তী’ , ‘রাত্রিশেষ’,“দাঙ্গা” ‘বনস্পতি’, ‘সংকেত’, ‘ইঁদুর’ এই সমস্ত অসাধারণ সব কালজয়ী গল্পের রচয়িতা সেই সোমেন চন্দ কতখানি সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন ? পরম শ্রদ্ধাভাজন সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায় মহাশয় ঠিক এইভাবে তার প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা আমাদের দিয়েছেন,“জন্ম সাহিত্যিকরা ভূমিষ্ঠ হন হাতে চাঁদ কপালে সূয্যি নিয়ে। হাতে কলম, কপালে যশ তার পরের কথা। মনে হয় সোমেন চন্দেরও ছিল হাতে চাঁদ কপালে সূয্যি। হাতে চাঁদ আর কপালে সূয্যি নিয়ে যারা জন্মান তাদের আয়ু একুশ বছর হলে ক্ষতি নেই যদি চন্দ্র সূর্য অম্লান থাকে।” সোমেন চন্দর সহজাত সাহিত্য প্রতিভা বিশেষ করে ছোটো গল্পকার হিসাবে তাঁর অসামান্য প্রতিভার এর থেকে অসাধারণ স্বীকৃতি আর কি হতে পারে। নিষ্ঠুর শোষণের শিকার নিদারুণ দারিদ্র লাঞ্ছিত অসহায় মানুষের অসহনীয় জীবন যন্ত্রণার চির মুক্তির অনুসন্ধিৎসু পর্যবেক্ষক সোমেন চন্দ, সুচেতনার শাশ্বত স্বচ্ছতায় উদ্বেলিত আত্মবিশ্বাসী সোমেন চন্দ “তার কাহিনী এবং চরিত্র নিয়েছিলেন জীবন থেকে।” জীবন যন্ত্রণার প্রতি তাঁর দৃঢ় অথচ সংবেদনশীল দৃষ্টি কিভাবে তাঁর সৃষ্টিকে প্রভাবিত করেছিল সারা বিশ্বে সমাদৃত এবং অসংখ্য ভাষায় অনুদিত তাঁর অসামান্য সৃষ্টি “ইঁদুর” গল্পটি থেকে কিছু অংশ উল্লেখ করলে তা বোধকরি অতি সহজেই বোঝা যাবে, “জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আঠার বছর বয়স অবধি এ নিয়ে আবোল তাবোল অনেক ভেবেছি, কিন্তু আবোল তাবোল ভাবনা মস্তিষ্কের হাটে কখনো বিক্রী হয় না। ঈশ্বরের প্রতি সন্দেহ এবং বিশ্বাস দুই-ই প্রচুর ছিল, তাই ঈশ্বরকে কৃষ্ণ বলে নামকরণ করে ডেকেছি হে কৃষ্ণ এ পৃথিবীর সবাইকে যাতে একবারে বড়লোক করে দিতে পারি তেমন বর আমাকে দাও। রবীন্দ্রনাথের পরশমণি কবিতা পড়ে ভেবেছি, ইস একটা পরশমণি যদি পেতুম। …বুঝতে পারলুম এ জিনিস এড়াতে চাইলেও এড়াবার নয়,—ঘুরে ফিরে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়, পাশকাটাতে চাইলে হাত চেপে ধরে, কোন রকম এড়িয়ে গেলেও হাত তুলে ডাকতে থাকে।”একদিন নিশ্চয়ই হাতুড়ি আর কাস্তের যূথবদ্ধ রণহুংকারে কেঁপে উঠবে নির্দয় শোষণের ভীত, চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙে পড়বে নিষ্ঠুর অত্যাচারীর অহংকারের ঠুনকো প্রাসাদ, আর ফিরে পাওয়া আলোকোজ্জ্বল জীবনের বিচ্ছুরণে ঝলমল করে উঠবে শ্রমিকের বস্তি আর কৃষকের পর্ণকুটির এই এক বুক স্বপ্ন নিয়েই সেই সোমেন চন্দই আবার বলে ওঠেন “আমি ফিরে এলুম। সাম্যবাদের গর্ব আর ইস্পাতের মতো আশা, তার সোনার মতো ফসল বুকে করে আমি ফিরে এলাম।” কিন্তু দুর্বার, দুর্জয় রাণার সোমেন চন্দর পরিচয় কী শুধু এই যে, তিনি কালজয়ী গল্পকার ? তাতো নয়। ইতিহাস সাক্ষী সোমেন চন্দ নিজেকে শুধু তার সাহিত্যিক সত্তার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাননি, নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তির দুর্নিবার আকাঙ্খায় চেতনার অনিরুদ্ধ আলোড়ন তৈরিতে সক্রিয় কমিউনিষ্ট কর্মী সত্তাই ছিল তাঁর কাছে অগ্রাধিকার। সুতরাং একথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় কমিউনিষ্ট কর্মী জীবনই তার লেখক সত্তাকে সূচীশুদ্ধ উপাদানে সমৃদ্ধ করেছিল। “ তিনি কর্মী ছিলেন বলেই মধ্যযুগীয় বর্বর আক্রোশের শিকার হয়েছিলেন। কবিকে, লেখককে, শিল্পীকে নিযুক্ত হতে হবে, অন্যথা তাঁদের প্রতিভা অবান্তর। সোমেন চন্দ নিযুক্ত করেছিলেন নিজেকে। গল্প লিখতেন, প্রবন্ধ লিখতেন কিন্তু পাশাপাশি সূতাকলের কর্মীদের আন্দোলনে সামিল হয়ে তাদের আরো সুসংবদ্ধ করবার দায়িত্ব ঘাড়ে পেতে নিয়েছিলেন। এ পাড়ায় ও পাড়ায় রিকশাচালকদের, সামান্য মুটেমজুর দের জীবন জীবিকার লড়াইয়ের সঙ্গেও মিশিয়ে দিয়েছিলেন নিজেকে। লেখক, শিল্পী কিন্তু তার চেয়ে বড় পরিচয় কর্মী। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী, সমাজকে খোলনলচে পাল্টাবার প্রতিজ্ঞায় দীক্ষিত পদাতিক, চোখে স্বপ্নের অঞ্জন, আগামীকাল পৃথিবী অন্য চেহারা নেবে, আমরা সাম্যবাদী কর্মীরা নিজেদের সাহসের- সৃষ্টির-কর্মের আর ত্যাগের যাদুতে সৃষ্টির রূপান্তর ঘটাব।”( অশোক মিত্র )। তারুণ্যের প্রতীক, স্বল্পস্থায়ী জীবনেও এক কালোত্তীর্ণ কথাশিল্পী, সর্বগ্রাসী আঁধার বিদীর্ণ করে নতুন দিনের আলোর পথে এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী মৃত্যুঞ্জয়ী বিপ্লবী সোমেন চন্দর জন্ম শতবর্ষে আজ এই যুগসন্ধি ক্ষণে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হওয়ার প্রহর আমাদের,—“ আমরা করব জয় নিশ্চয়।”
—————————


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।