রঘুনাথ ভট্টাচার্য: চিন্তন নিউজ:২৯শে মে:-করোনা ঘটিত লকডাউনে শিল্পোৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছে একথা অনস্বীকার্য। প্রশ্ন ওঠে, এই শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়ার একটি মূল অঙ্গ হিসাবে ‘ শ্রমের ‘ অর্থাৎ শ্রমিকের কি ক্ষতি হয় নি ? অবশ্যই হয়েছে । সেটাই তো স্বাভাবিক। উৎপাদন ব্যবস্থার চারটি স্তম্ভের একটি হচ্ছে ‘শ্রম’। সেই পরিপ্রেক্ষিতে যদি ‘শ্রম’-কে হেয় করে, বঞ্চিত করে, দ্রুততর অর্থনৈতিক সংস্কারের অছিলায় উৎপাদন ব্যবস্থার অন্য দুই অংশীদার ‘ মূলধন ‘ ও ‘ সংস্থা ‘ ( অর্থাৎ উদ্যোগপতি ) উভয়কেই বরাসন দিয়ে তাদের পাওনাগন্ডার সম্বর্ধনার পাকা ব্যবস্থা করার জন্য উদ্বেগজনক ত্বরার উদ্যোগ ন্যায় সরকার, তবে তা ভস্মে ঘি ঢালারই সমান। কারণ তাতে শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি দুরাশা, বরং সেটা শিল্পক্ষেত্রে এক বিষম বিপত্তি ডেকে আনবে শ্রমিকশ্রেণীকে এক অনভিপ্রেত মরিয়া বিক্ষোভের মুখে ঠেলে দিয়ে। শ্রমিকদের পূর্ণ ও আন্তরিক অংশগ্রহণের বিষয়টিকে অবহেলা করে শুধু মূলধন আকর্ষণ করতে শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের অর্জিত প্রাপ্য , তার ও তার পারিবারিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শিকার করে দেওয়া যদি অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলশ্রুতি হয়, তবে কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রেই তা কোনো যুক্তিতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
এত গৌরচন্দ্রিকার দরকার পড়তো না যদি প্রস্তাবিত প্রক্রিয়াটি বর্তমান আইনের আমূল পরিবর্তন না হয়ে প্রকৃত অর্থেই ‘ সংশোধনী ‘ হোতো। বস্তুতঃ যে শ্রম- আইন আছে তা তুলে দিয়ে নতুন শ্রম-আইন গ্রহণ করার প্রস্তুতি প্রায় শেষের পথে বলে খবরে প্রকাশ। একটি কেন্দ্রীয় আইন চালু করাই কেন্দ্রের লক্ষ্য। রাজ্যগুলির কোনো পৃথক শ্রম-আইন থাকবে না। আলোচনা এখন যে স্তরে আছে সরকারি ভাষ্যে তাকে শেষ পর্যায় বলা হয়। বলা হচ্ছে, লকডাউন শেষে দেশের অর্থনীতি তলানীতে পৌঁছে যাবে। সেখান থেকে তাকে গণ্য অবস্থানে তুলে আনতে হলে বিনিয়োগ দরকার । আর কর্পোরেট ছাড়া বিনিয়োগ অসম্ভব। আর, সেই কর্পোরেট গোষ্ঠীর উৎসাহ সঞ্চারের জন্য অবিলম্বে একটি ‘নরম’ শ্রম-আইন একান্ত প্রয়োজন।কিমাশ্চর্যম ! তাহলে, এতদিন অর্থনৈতিক উন্নয়নের একমাত্র বাধা ছিল বর্তমান শ্রম-আইন।বহু আলোচনা, বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে বহু বর্ষব্যাপী অভিজ্ঞতার ফসল হিসাবে যে আইনটি
শ্রমিক-মালিক উভয়পক্ষের মতামত ভিত্তিতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল, যাতে অন্যান্য বিবেচনার সাথে আঞ্চলিক শ্রমচরিত্র বিন্যাস স্বীকৃতি পেয়েছিল, সেটা উৎপাটিত করে একটি একদেশদর্শী নতুন শ্রম আইন সেইজায়গায় পুঁতে দিলেই দেশের অর্থনীতির তরণী তরতর করে উন্নতির লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।
ঘটনা হলো, কোনো শ্রমিক সংগঠনের মতামত না নিয়ে, কোনো যৌথ আলোচনার প্রক্রিয়ার ধার না ধেরে, কেবল করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পরিণাম হিসাবে যে প্রতিক্রিয়া প্রসূত সুযোগ উপলব্ধ হয়েছে, তার সদ্ব্যবহার করে শ্রমিক শোষণের দ্বার খুলে দেওয়াই প্রস্তাবিত নতুন আইনটির মহান উদ্দেশ্য বলে প্রকাশ।
উৎসাহ এতই তীব্র যে, বিজেপি শাসিত তিনটি রাজ্য ইতিমধ্যে শ্রম আইন তুলে দিয়েছে ( বলা হয়েছে ,তিন বছরের জন্য)। কোনো কোনো রাজ্যে কাজের সময় আট ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে বারো ঘন্টা করা হয়েছে। লকডাউনের মধ্যেই অর্ডিন্যান্স জারির সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের সরকার।
কর্পোরেট সংগঠনের কাছ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হয় নতুন আইনের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। ভাবখানা যেন ‘ঠিক আছে আপনারাই বলুন, কী পেলে আপনারা ভারতের ডুবে যাওয়া অর্থনীতি টেনে তুলতে পারেন?’ যাই হোক, কর্পোরেট
সংস্থার চাহিদাটা একবার দেখা যাক ! দেশে সমস্ত শ্রম আইন আগামী তিন বছরের জন্য উঠিয়ে দিতে হবে। শিল্প-শ্রমিকদের জন্য সামাজিক ব্যয়বাবদ কর্পোরেটের দায় কমাতে হবে। কাজের সময় দিনে ৮ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘন্টা করতে হবে। অর্থাৎ সপ্তাহে ৭২ ঘন্টা। পরিযায়ী শিল্পশ্রমিকদের যাতায়াত খরচ, খাওয়ার খরচ সব সরকারের দায়িত্ব হবে। শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের ক্ষমতা অবাধ হতে হবে এই সময়ে।শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা ৩৩% – ৫০% কমিয়ে দেবার ক্ষমতা থাকতে হবে কর্পোরেট সংস্থার হাতে। উৎপাদন-সংস্থার হাতে বিনিয়োগ ক্ষমতার কথা বিবেচনা করে শ্রমিকদের মজুরি আলাদা করে হিসেব না করে , কর্পোরেট সামাজিক সাহায্য তহবিল থেকেই দেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে কর্পোরেটের হাতে।
একেবারে প্রাক্-দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কালীন জার্মানিতে স্বৈরতন্ত্রের উত্থান-র মত লাগছে না? কয়েকদিন আগে সুইডেনের গোটেনবারগ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত সমীক্ষা -সংস্থা ‘ ভি – ডেম ‘ তাঁদের সমীক্ষা রিপোর্টে বিশ্বে তথা ভারতে স্বৈরতন্ত্রের প্রসার সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ভারতের এই সিদ্ধান্ত বিশ্ব স্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এইধরনের একপেশে নতুন শ্রম-আইনের প্রবর্তনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, যে ভারত- সরকারের এই পদক্ষেপ তার সঙ্গে আইএলও-য়ের সাথে যে চুক্তি তার সরাসরি বিরোধী। লকডাউনের অছিলায় শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার খর্ব করাই এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য। শ্রমিক সংগঠনের স্মারকলিপি পাওয়ার পর আইএলও অধিকর্তা গাই রাইডার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছেন। এছাড়াও আইএলও ফ্রিডম ফর আ্যসোসিয়েশনের প্রধান কারেন কুর্টিস সিআইটিইউ, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, এআইইউটিইউসি, এইচ- এমএস, প্রভৃতি নানা কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনের কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে তাঁরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে বলেছেন দেশের শ্রম আইন বহাল রাখার বাধ্যবাধকতা এইভাবে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তাঁরা উভয়েই জানান যে প্রধানমন্ত্রীর থেকে তাঁরা কোনো উত্তর পান নি। সংশ্লিষ্ট সকলেই অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখছেন বলে খবরে প্রকাশ।