রাজ্য

লুম্পেনদের বর্ষবরণ


সুপর্ণা রায়, চিন্তন নিউজ, ২২ জুলাই: তিনি বলছিলেন আর তার দলের কর্মী, সমর্থক দাঁড়িয়ে, বসে হাত-পা নেড়ে চিৎকার করছিলেন আর ‘বিগ্রেড’ কেঁপে উঠছিল সেদিন। “পাগলু ডান্স” থেকে সেটা কোন অংশে কম না। আঙ্গুল নেড়ে, হাত জোরে জোরে নেড়ে গোটা মঞ্চ পায়চারী করতে করতে মঞ্চের এপাশ ওপাশ করতে করতে তিনি বলছিলেন তার দামাল ভাইদের, “বলুন চুরি করবেন না, কেউ অন্যায় করলে আটকান”- যেন মন্ত্রগুপ্তির পাঠ চলছিল। আর তার অতি সভ্য ভাইরা বলছিল, “না না আমরা চুরি করব না, অন্যায় দেখলে আটকাব।”

মানতেই হবে দূরদৃষ্টি আছে মমতা ব্যানার্জীর। ২০১১ সালের ২১শে জুলাই সেই দুপুরেই প্রমান হয়ে গেছে। আজ আট বছর পরে মিলিয়ে নেওয়ার পালা। এটা কি তিনি জানতেন না যে তার দল কতরকম ভাবে চুরি করতে পারে? তাদের চুরি করার পদ্ধতি একটি এনসাইক্লোপিডিয়া হওয়ার যোগ্যতা রাখে। নাহলে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম শহীদ দিবসেই তিনি চুরির কথা বললেন কেন? তার দূরদৃষ্টি এখানেই। আজ তার সরকার চালনার আট বছর পার। দলের নেতা-মন্ত্রী-বিধায়ক থেকে পাড়ার রিক্সাওয়ালা, মানে দশ পয়সার নেতারা -সবার বিরুদ্ধেই চুরির অভিযোগ। এমনকি তার আদরের ভাইপোর বিরুদ্ধেও অভিযোগ। ভাইপো -বৌ সোনাপাচারে অভিযুক্ত। এই মমতা ব্যানার্জীই তো কথা দিয়েছিলেন বামফ্রন্টের সব দূর্নীতি তিনি নাকি প্রকাশ করবেন। আজ আট বছর কেটে গেছে। সরকার সবরকম চেষ্টা চালিয়েও একজন বামফ্রন্ট নেতাকেও চোর বলে প্রমান করতে পারে নি। তার মতো এতো মিথ্যাভাষণে অভিজ্ঞ লোক – তাও পারলেন না।

তিনি ২০১১ সালের ২১শে জুলাই বলেছিলেন, “বলুন আপনারা বদলা নেবেন না।” সারা ভারত জানে তিনি কি ভীষন দাঙ্গা মারামারি ভাঙচুরের বিরোধী। কিন্তু তার ছেলেমানুষ – খুব ভাল – দামাল ভাইয়েরা গত আট বছরে অন্তত তিনশো বিরোধী কর্মী সমর্থককে খুন করেছে। কোটি কোটি টাকা জরিমানা বাবদ তুলেছে। এমনকি নিজেরা নিজেদেরকেও ছাড়েনি। এক গোষ্ঠীর নেতা আর এক গোষ্ঠীর নেতাকে মারধোর করেছে, খুন করতেও ছাড়েনি। কুপিয়ে, বোমায়, ঝাঁঝরা করে দিয়েছে গুলিতে বা কেবল স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

কিন্ত এমন কথা কি ছিল? তার নির্দেশ অতি মধুর ছিল। বলেছিলেন, “কর্মীদের ভদ্র হয়ে চলতে হবে।” ছাত্রনেতাদের বলেছিলেন তারা যেমন নিজেদের বাড়ী ঘর পরিস্কার করে তেমন করে হাসপাতাল, রাস্তাঘাট অপরিস্কার থাকলে তা পরিস্কার করতে হবে। কি করেছে এই ছাত্রনেতারা? কলেজে কলেজে ছাত্র ভর্তির নামে ঘুষ নিয়েছে। ইট-বালি-সিমেন্টের বস্তা থেকে টাকা নিয়েছে দলের তাবড় নেতারা। সত্যিই ঝাট দেওয়ার মতো করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলেছে।

আর এই মমতা ব্যানার্জী যিনি এত বড় বড় কথা বলেছিলেন তিনি কি তার কথা রেখেছেন? ২০১১ সালের ২১শে জুলাই বলেছিলেন কলকাতাকে লন্ডন বানাবেন, উত্তরবঙ্গকে সুইজারল্যান্ড বানাবেন, দীঘাকে গোয়া বানাবেন। বলেছিলেন, “দেখবেন কি ভাবে সুন্দরবন কে সাজাতে হয়?” দেখতে দেখতে আট বছর পার। মানুষ দেখেছেন কোথায় কি হয়েছে? সেই আশার বহু প্রতিক্ষিত সুইজারল্যান্ড হয়নি, লন্ডন হয়নি এমনকি গোয়াও হয়নি। সুন্দরবন থেকে দিনের পর দিন নারী-শিশু পাচার হয়েছে প্রায় স্রোতের মতো। সেদিন তিনি আরও ভাল ভাল ফিরিস্থি দিয়েছিলেন দার্জিলিং, জঙ্গল মহল নাকি হাসবে। সিঙ্গুরের সব জমি ফেরত দেওয়া হবে। কি হয়েছে? দার্জিলিং আরও অশান্ত। জঙ্গল মহল অনাহারে ভুগছে দিনের পর দিন। আর সিঙ্গুর? বিধানসভায় মমতা ব্যানার্জী নিজে বলেছেন, “সিঙ্গুরে চাষও হল না শিল্পও হল না।” প্রতারণার এক জলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে রইল সিঙ্গুর।

আরও একটি ঘোষনা করেছিলেন, “আগামী দুবছর মেন কাজ হবে পরিকাঠামোর উন্নয়ন করা আর কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করা।” তিনি বলেছিলেন, “এত কারখানা করব যে এই রাজ্যের আর কাউকে বাইরে যেতে হবে না।” মমতা ব্যানার্জীর দাবী তিনি নাকি বুথ পিছু ১২৯ জনের চাকরীর ব্যাবস্থা করেছেন। তার দলের কাটমানি খোর, ঘুষখোর নেতা মন্ত্রীরাই এই হিসেব মেলাতে পারছে না।

পুলিশের গুলিতে ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মী নিহত হয়েছিল। ২১শে জুলাই-এর ঘটনা বলতে এটাই জানে রাজ্যবাসী। যদিও তাদের পরিচয় এখনও দিতে পারেনি তৃনমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা ব্যানার্জী একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। এই কমিশনে বিমান বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কমিশন মমতা ব্যানার্জীকে ডাকেনি। এই কমিশনের চেয়ারম্যান সুশান্ত চ্যাটার্জী জানিয়েছিলেন যে ১৩ জনের কথা বলা হচ্ছে তাদের একজনের গায়ে গুলির আঘাত দেখা যায় নি। তার মারা যাওয়ার কারণ “সিরোসিস অফ লিভার”। তখন কংগ্রেস নেতা গনি খান চৌধুরী জানিয়েছিলেন গুন্ডামি বন্ধ করতে জ্যোতি বসু যেন শক্ত হাতে হাল ধরেন। আর তিনিও এই কাজে তাকে সাহায্য করবেন। এই অসভ্য ধরণের গুন্ডামি কোনমতেই বরদাস্ত করা হবে না। এই বেপরোয়া ঘটনার সমালোচনা করেছিলেন গনি খান চৌধুরী।

“ফেরেববাজ” কথার মানে কি? ঠগ – জোচ্চর। তাই এদের ফেরেববাজ বলাই ভাল। কি চক্রান্ত হয়েছিল ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই? তার একসময় একনিষ্ঠ কর্মী সোনালী গুহ বলেছিলেন ওইদিন তাদের একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তা হল জ্যোতি বসুর গাড়ী আটকে দিতে হবে। তাই তারা সটান চলে গেছিলেন রেডরোডে। কারণ ওই রাস্তা দিয়ে যায় জ্যোতি বসুর কনভয়। বোরখা পরে তারা রাস্তাতে অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু শ্যামলী মিত্রের শাঁখাপলা বেরিয়ে যাওয়ার ফলে পুলিশ তাদের ধরে ফেলে আর রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়। জ্যোতি বসুর গাড়ী আটকে তাকে প্রনাম করার ইচ্ছে নিশ্চয় ছিল না এই মহিলা বাহিনীর এটা নিশ্চিত। তখনকার সরাষ্ট্র সচিব এবং বর্তমানে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মনীষ গুপ্ত বলেছিলেন সেদিন যারা জড়ো হয়েছিল তারা প্রত্যেকেই নেশাগ্রস্থ ছিল। মনীষ গুপ্তর হলফনামায় বলা হয়েছে সেদিন তিনটি বাস পোড়ান হয়েছিল, ৩৫টি গাড়ী ভাংচুর করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে জখম হয়েছিল ২১৫ জন। অনেকেরই গুলি আর বোমার স্পিন্টার লেগেছিল। মমতার সেদিনের বেনজির তান্ডবে এক সাংবাদিক সাংঘাতিক ভাবে আহত হয়েছিলেন। আরও অনেক পুলিশ গুরুতর আহত হয়েছিলেন। পুলিশ বাধ্য হয়েছিল গুলি চালাতে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।