মিতা দত্ত: চিন্তন নিউজ:১৬ই জুন:– কোনো কোনো মৃত্যু জীবনাবসান হলেও তাঁর জীবদ্দশায় কাজ দিয়ে মানুযের মনে স্থায়ী আসন পাতা থাকে। তিনি বেঁচে থাকেন চিন্তনে, মননে ,কর্মে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সেইরকমই একজন ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রথম পরিচয় একজন যথার্থ শিক্ষক হলেও জীবনটাকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নানাবিধ কর্মযজ্ঞে । ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালি সমাজের পশ্চাদপদতা তাঁকে ব্যথিত করতো। তাই সমাজের উন্নতি বিধানে ও আত্মনির্ভরশীল দেশ গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্ররায়ের রচনা সম্বন্ধে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু যথার্থইবলেছেন:– “একজন মানুষের মধ্যে এমন সব গুণাবলীর সমাবেশ সত্যিই দূর্লভ… নতুন প্রজন্মের অনুকরণীয় এমন আদর্শ মানুষই তো দৃষ্টান্ত। “তাঁর সমগ্র রচনাতে উঠে এসেছে অচলায়তন সমাজের কথা, বিজ্ঞানের অনগ্রসরতার কথা, শিল্পহীনতার কথা কিন্তু তিনি শুধু সমস্যার মধ্যে তাঁর লেখনি সীমাবদ্ধ রাখেননি, সমাধানের পথ বাতলেছেন। স্বনির্ভর জাতি গঠন তাঁর আজীবনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে মায়াজালে আবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নের জন্য জীবনপাত করেছেন।
১৮৬১সালে তাঁর জন্ম।বালক প্রফুল্ল খুলনা জেলায় রাডুলী কাঠিপাড়া গ্রামে যে পাঠশালায় পড়েছেন সেখানকার গ্রাম্য প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁর মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তাঁর বিভিন্ন রেখায় তা জীবন্ত রূপ পেয়েছে।তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ,” হিন্দু কেমিস্ট্রির ইতিহাস “। এই গ্রন্থে একদিকে প্রাচীন কালে উন্নতির কথা যেমন বলেছেন তেমনি মনুবাদের প্রভাবে জাতিভেদ প্রথা যে সেই উন্নতির ধারাবাহিকতাকে বিঘ্নিত করেছে সেকথাও বলেছেন।
এই শতকে যে সব মণিষী বাংলার রেনেসাঁর জনক তার মধ্যে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রথমেই যাঁর নাম মনে স্বভাবতই আসে, তিনি নিঃসন্দেহে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। তিনি স্বদেশী শিল্পের বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন এর মাধ্যমেই একদিকে আমাদের আত্মশক্তির উদ্বোধন হবে, অন্যদিকে আমরা স্বনির্ভর হয়ে উঠবো। সেই বার্তা আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর স্বপ্নের ও বহু পরিশ্রমের বেঙ্গল ক্যামিক্যাল তাঁর সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। তিনি কর্মসংস্থানের জন্য নানাবিধ দেশজ উপায়ের ওপর জোর দিতেন। তিনি জৈবসারের ব্যবহারের ওপর জোর দেন এবং সেই সার তৈরীর উপায়ও বাতলে দেন। তিনি ভাগাড়ের ব্যবহারের কথা বলেন। ভাগাড়ের উপযুক্ত ব্যবহারের দ্বারা একদিকে দূযণ দূরীকরণের কথা বলেন, অন্যদিকে চর্মশিল্প ও হাড় থেকে সার তৈরির কথা বলেন। মানুষের নানাবিধ কাজের দরজা খুলে দেন।
বাঙালীর খাদ্যসমস্যা বিষয়ে বাঙালিকে চা, বিস্কুটের পরিবর্তে ঘরমুখী খাবার চিড়া, মুড়ি ,খই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ১০,১৫ বছর ধরে বক্তৃতা, পুস্তক ও প্রবন্ধ লিখেছেন। ঘরের জিনিসের উপকারিতা সম্বন্ধে বাঙালিকে সচেতন করেছেন। কিন্তু আজও আমরা অন্ধকারে আমাদের সকালে চা বিস্কুটে সীমাবদ্ধ।
রাজনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সংস্কারের ওপর জোর দেন। তাঁর মতে একটি ছাড়িয়া অন্যটি অসম্ভব। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে বিরাট সামাজিক ব্যবধান তা দূরীকরণের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন শুধু ব্রিটিশদের দোষ দিয়ে লাভ নিয়ে আমাদের মধ্যে গলদ উপস্থিত তা দূরকরা প্রয়োজন। তাঁর কথার সত্যতা আজও আমরা মর্মে উপলব্ধি করছি। আমাদের বন্ধনের অভাব দেশীয় শাসক নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে।
আচার্য প্রফুম্লচন্দ্র রায় তাঁর আত্মজীবনীর শেষে লিখেছেন,… বাঙালী আমারই স্বজাতি এবং তাহাদের দোষত্রুটির আমিও অংশভাগী। তাহাদের যেসব গুণ আছে,তাহার জন্য আমি গর্বিত,সুতরাং বাঙালীদের দোষকীর্তন করার অধিকার আমার আছে।
আসুন তাঁর দেখানো পথে আমরা আমাদের দোষগুলিকে খুঁজে বার করে তা দূরীকরণে সচেষ্ট হই। তবেই আমরা মানুষ হতে পারবো।