রাজ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

প্রসঙ্গ :- শিক্ষক শিক্ষিকাদের বিষ পান !


একটি বিশেষ প্রতিবেদন: মৈত্রেয়ী সান্যাল, রায়গঞ্জ:চিন্তন নিউজ:২৫শে আগস্ট:– গতকাল দুপুর থেকেই সমস্ত বৈদ্যুতিন ও সামাজিক মাধ্যমে প্রবল শোরগোল ফেলে দিয়েছে যে খবর তা ইতিমধ্যেই সকলে জেনে গেছেন। জেনে গেছেন যে, ভর দুপুরে শিক্ষা দফতরের সামনে অগণিত পুলিশ, সংবাদমাধ্যমের কর্মী ও পথচলতি মানুষের সামনেই প্রশাসনের কাছে নিজেদের বক্তব্য/ দাবি জানানোর বারংবার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় প্রকাশ্যে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন পাঁচজন শিক্ষিকা !

স্বভাবতই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সর্বত্র। এবিপিটিএ, এবিটিএ সহ বামপন্থী শিক্ষক সংগঠনগুলি এবং বহু সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যেই এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাঁদের উদ্বেগ এবং সুষ্ঠু সমাধান দাবি করেছেন। বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক সম্প্রদায়ের ওপর দীর্ঘদিন ধরে ঘটে চলা অবিচারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি ২০১১ উত্তর পশ্চিমবঙ্গে একদিকে যেমন নিয়মিত তেমনি অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য সংগঠিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর বর্বরোচিত প্রশাসনিক আক্রমনের চিত্র ও আকছারই দেখতে পাওয়া যায়।

অনেকেই শিক্ষিকাদের এইধরণের চেষ্টা সমর্থন করছেন না, প্রবল কটাক্ষ আর সমালোচনার মুখেও পড়তে হচ্ছে তাঁদের। বিশেষত বিগত দশ বছরে রাজ্যের কর্মসংস্থানের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তাতে শিক্ষিত কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্যচ্যুত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু গতকালের ঘটনা এবং তারই সূত্র ধরে বিগত বেশ কিছু ধারাবাহিক শিক্ষক বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটও এই প্রসঙ্গে একটু সামনে আসা দরকার। আমাদের রাজ্য প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর। একদিকে পুরুলিয়া বাঁকুড়ার ঊষর ক্ষেত্র থেকে উত্তরের বনভূমি বা পাহাড়ি অঞ্চল — সবই রয়েছে এই রাজ্যে। এর সাথে রয়েছে বিস্তীর্ণ সীমান্তবর্তী এলাকা এবং ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’। সব মিলিয়ে প্রথাগত প্রাথমিক বা উচ্চ প্রাথমিক কিংবা সেকেন্ডারি ইস্কুলগুলোতেও রাজ্যের সমস্ত অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীর সমস্ত শিশুদের নিরবচ্ছিন্ন পাঠের সুযোগ সুনিশ্চিত নয়। এর সাথে রয়েছে আবার ভাষার ক্ষেত্রে বিভিন্নতা।

মূলত এই সমস্ত সমস্যার সমাধানের জন্যই আমাদের রাজ্য সহ সারা দেশেই অল্টারনেটিভ স্কুলিং বা বিকল্প বিদ্যালয়ের ভাবনা। সকলের নাগালের মধ্যে অন্তত প্রারম্ভিক স্তরের শিক্ষার মৌলিক সুবিধাটুকু পৌঁছে দিতে সরকারও রীতিমত বাধ্য। ফলতঃ এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্র,মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র গুলি কাজ শুরু করে। স্থানীয় এলাকার শিক্ষিত ছেলেমেয়েরাই এক্ষেত্রে শিক্ষা সহায়ক বা সম্প্রসারক হিসেবে কাজ শুরু করেন মাসিক আর্থিক চুক্তিতে। প্রাথমিক ভাবে প্রকল্পটির অগোছালো অবস্থা সামলে রাজ্যের শিক্ষা মানচিত্রে এক অভূতপূর্ব গতির সঞ্চালনাও হয় এর ফলে। আর এরই ফলশ্রুতিতে আমাদের রাজ্যের বিদ্যালয় ছুট শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমতে থাকে প্রায় শূন্যের স্তরে। পরবর্তীতে এনসিটিই(NCTE) র নিয়ম মেনে বিগত বাম সরকারের সময়েই এই বিদ্যালয়গুলোর পরিকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে সহায়িকা ও সম্প্রসারকদের শিক্ষাগত মানের উন্নয়নের প্রক্রিয়াও শুরু হয়। সব মিলিয়ে রাজ্যের শিক্ষা মানচিত্রে প্রায় অপরিহার্য হয়ে ওঠা এই শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকেও মূল শিক্ষা স্রোতের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। প্রতিটি শিক্ষা সহায়িকা/ সম্প্রসারকদের D.-Ed/ B. Ed সম্পুর্ন হয়। স্বভাবতই আশার আলো দেখেন দীর্ঘদিন ধরে একনিষ্ঠ ভাবে রাজ্যের প্রারম্ভিক শিক্ষা উন্নয়নে কাজ করে চলা বঞ্চিত এই স্তম্ভরা।

কিন্তু গোল বাধে এখানেই। ২০১১ সালের পর থেকে তাঁদের বঞ্চনার মাত্রা ক্রমশই বাড়তে বাড়তে আজ তা মাথার ওপরে। সমাজে- এলাকায় ‘চাকুরীরত’ হিসেবে পরিচিত এইসব মানুষদের জন্য এখনো মাসান্তে সামান্য থেকে অতিসামান্য ভাতাই বরাদ্দ, বর্তমান বাজারে জীবনধারণের জন্য যা শুধুমাত্র অপ্রতুলই নয় বরং শোষণেরই নামান্তর। অথচ জনমানসে সরকারি চাকুরীরত হিসেবে ‘প্রিভিলেজড’ হিসেবেই তো তাঁরা পরিচিত ! স্বাভাবিকভাবেই এই অসহিষ্ণুতা, এই বিক্ষোভ, এই হতাশার বহিঃপ্রকাশ। তার ওপরে যদি আবার ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শাস্তিমূলক বদলির খাঁড়া নেমে আসে এঁদের ওপর ! আসলে যে সামান্য ভাতায় নিজ এলাকায়ই পরিবার পরিজন নিয়ে জীবনধারণ কার্যত অসম্ভব, সেখানে বাড়ি থেকে ৭০০/ ৮০০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে কাজ করা কি আদৌ সম্ভব ? সে তো আদতে না খেয়ে মরারই সামিল? আত্মহত্যা সমর্থনযোগ্য না হলেও এঁদের অসহায়তা একবার আমাদের সকলের ভেবে দেখা কি বিচার্য হওয়া উচিত নয় এক্ষেত্রে ?

শেষে, সমস্ত এস‌এসকে (SSK),এম‌এসকে (MSK) সহায়ক/ সম্প্রসারক, পার্শ্বশিক্ষক সহ সমস্ত চুক্তিভিত্তিক সহযোদ্ধা, সহকর্মী সাথীদের সম্মানজনক কাজের পরিবেশ, বেতন ও অন্যান্য ন্যায্য দাবির লড়াইয়ে সকলকে পাশে থাকার আহ্বান করছি। তাঁদের চোখের জল, হাহাকার মানব সমাজের লজ্জার।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।