কলমের খোঁচা

গান্ধী হত্যা থেকে আজকের ওয়ান নেশন তত্ত্ব


উত্তম দে: চিন্তন নিউজ:৩০/০১/২০২৪:– আজ যেভাবে দেশকে ধর্মীয় মেরুকরণের পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে, উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মান্ধতার মধ‍্য দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব, অখন্ডতা, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর কুঠারাঘাত করে, ওয়ান নেশনের নাম করে পরোক্ষভাবে ফ‍্যাসিস্ট হিটলারের একজাতীতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার ঘ‍ৃণ‍্য চক্রান্ত চলছে, তখন এটা যদি আমরা মনে করি, এর সূচনা বাবরী ধ্বংস বা গুজরাট গণহত্যা দিয়ে করা হয়েছিল,তবে ভুল হবে। এই বিষবৃক্ষ স্বাধীনতার পুর্বেই আর এস এস,হিন্দু মহাসভা,সর্বোপরি সাভারকাররা দেশের মাটিতে বপন করে গিয়েছিলেন,যার উগ্র আস্ফালন,১৯৪৮ এর ৩০শে জানুয়ারী,অহিংস তথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির অন‍্যতম কান্ডারী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী হত‍্যা।

এই হত‍্যাকান্ডের ব্লুপ্রিন্ট ২রা জানুয়ারী মহারাষ্ট্রে হিন্দু মহাসভার এক গুপ্ত সভায় করা হয়। সভায় উপস্হিত নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তে, রামকৃষ্ণ কারকারে প্রথমে গান্ধী হত‍্যার মুল দায়িত্ব নাথুরামকে দিলেও,পরে কারকারের পরামর্শে এই দায়িত্ব কারকারের পরিচিত মদনলাল পাওয়াকে দেওয়া হয়। গান্ধীহত‍্যার দশদিন পুর্বে এক প্রার্থনা সভায় মদনলাল গান্ধীজীকে হত‍্যার উদ্দেশ‍্যে বোমা নিক্ষেপ করে।লক্ষভ্রষ্ট হলে বাপুর প্রাণ রক্ষা হয়। মদনলাল গ্রেফতার হলে নাথুর ওপর দায়িত্ব এসে পড়ে। এবং ৩০শে জানুয়ারী, দিল্লীর বিড়লা হাউসে প্রার্থনা যাওয়ার সময় নাথুর ব‍্যারোটো পিস্তল থেকে তিনটি শেলে বিদ্ধ হয়ে ম‍ৃত‍্যু হয় জাতীর জনকের।

কে এই নাথুরাম গডসে? কি তার পরিচয়?লালকেল্লায় বিচার চলাকালীন যিনি নিজেকে আর এস এস কর্মী হিসেবে স্বীকার করেন নি বা, যার নামে গেরুয়া শাখার তরফ থেকে মধ‍্যপ্রদেশে মন্দির গঠনের উদ‍্যোগ নেওয়া হলেও ,নিজেদের দেশভক্ত প্রমাণের তাগিদে আর এস এস অদ‍্যবধি প্রকাশ‍্যে যার সংস্পর্শের কথা স্বীকার করার সাহস দেখান নি, সেই নাথু কি সত‍্যিই আর এস এস কর্মী ছিলেন?এর উত্তর নাথুর ভাই,গান্ধী হত‍্যার অন‍্যতম ষড়যন্ত্রকারী, যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রাপ্ত ও পরে কারামুক্ত গোপাল গডসে ২৪শে জুন,১৯৯৪, ফ্রন্টলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা সব ভাই,নাথু,আমি,দত্তাত্রেয়,গোবিন্দ আর এস এসের কর্মী ছিলাম।” নাথু ছিল আর এস এসের বৌদ্ধিক কার্যবাহক। কিন্তু আর এস এস ও গোয়ালকরকে বাঁচাতে নাথু আর এস এসের সাথে সম্পর্কের কথা স্বীকার করেনি।আবার সাভারকারের জীবনীকার ধনঞ্জয় কীর,তার লেখায় বললেন, RSS কে গণ‍্য করা হতো হিন্দু মহাসভার একটি জঙ্গী ঝটিকা বাহিনী হিসেবে।যৌবনকালে গডসে ছিলো RSS কর্মী এবং পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন হিন্দু মহাসভার সর্বভারতীয় শাখার বিশিষ্ট সদস‍্য।(বীর সাভারকার,ধনঞ্জয় কীর,পপুলার প্রকাশন,বোম্বে,১৯৮৮,প‍ৃঃ ৪০০)
সংঘ পরিবারের বীর সাভারকারও এই ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলেন। তিনি গ্রেফতার হয়ে মুক্ত হলেও দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সর্দার বল্লভভাই প‍্যাটেল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন,সাভারকার গান্ধী হত‍্যার ষড়যন্ত্রী ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি তিনি প্রধাণমন্ত্রী জহরলাল নেহুরুকে লেখা এক চিঠিতে সে কথা উল্লেখ করে জানান,”প্রত‍্যক্ষভাবে সাভারকারের অধীনে হিন্দু মহাসভার একটি ধর্মোন্মত্ত শাখা এই ষড়যন্ত্রটির পরিকল্পনা করেছিল এবং তাকে চুড়ান্ত রূপ দিয়েছিল।”
গান্ধীজীর নিধনের পর যখন সাড়া দেশ শোকে বিহ্বল, ঠিক তখনই গোয়ালিয়র, ভরতপুর, আলওয়ারের মত রাজণ‍্য শাসিত রাজ‍্যগুলিতে হিন্দু মহাসভা,RSS এবং রাজণ‍্যরা লাড্ডু বিতরন করে।
কালের কি পরিহাস! যে প‍্যাটেল ১৯৪৮ এর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি আর এস এস কে বেআইনি ও বিপদজ্জনক ঘোষণা করলেন, সেই প‍্যাটেলের স্ট‍্যাচু নির্মাণ করে বিজেপিকে দেশভক্ত সাজতে হচ্ছে। আসলে এরা ইতিহাসকে গুলিয়ে দিয়ে, বিকৃতি করে সত‍্যকে আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যে সাভারকার ব্রিটিশদের কাছে হলফনামা নিয়ে জেলমুক্ত হয়ে বশ‍্যতা স্বীকার করেছেন,তিনিই এদের বীর। আসলে যে কথা উহ‍্য রাখা হয়,তা হলো যেখানে সেলুলার জেলে যারা দেশের জন‍্য ব্রিটিশের নির্মম অত‍্যাচার সহ‍্য করেও দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার ব্রতে অবিচল ছিলেন তাদের অধিকাংশ ই ছিলেন,কমিউনিস্ট।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট সেলুলার জেলে পতাকা উত্তোলন করেন, প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা এ কে গোপালন। কমিউনিস্ট দলের প্রথম পলিটব‍্যুরোর ৭জন সদস‍্য ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী।আসলে গেরুয়া বাহিনী তার জন্মলগ্ন থেকেই,হিটলারের একজাতিতত্ত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভাজনের গরল ছড়িয়ে এসেছে। গুজরাট গণহত‍্যা,বাবরী ধ্বংস তারই অঙ্গ হিসেবে ফাইনাল শলিউশনের প্রয়োগ। অন‍্য ধর্মালম্বীদের মধ‍্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে বশ‍্যতায় আনার প্রয়াস। দেশের সংবিধানের মুল শক্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধুলিসাৎ করে,মনুবাদী পথে দেশকে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত। আর তাই যোগী আদিত‍্যনাথ,পুষ্কর সিং ধামীর ঘণিষ্ট হিন্দু রক্ষা সেনার সভাপতি উত্তরাখন্ডের হরিদ্বারে চলা ২০২১ সালের ১৭-১৯শে ডিসেম্বর চলা এক ধর্ম সংসদে হিন্দুদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে,মুসুলমান সাফাইয়ের আহ্বান জানান।
আজ,গান্ধীজীর প্রয়াণ দিবসে আমাদের ডারতের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব,ধর্মনিরপেেক্ষতা রক্ষার শপথ নেবার দিন। ১৯৪৮ সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারি বিধানসভায় শোক প্রস্তাবে ওপর বলতে গিয়ে প্রয়াত জ‍্যোতিবাবু তাই বলেছিলেন,”গান্ধীজীর মর্মর মুর্তি স্হাপন বা ফুল মালা দিলেই গান্ধীজীকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় না। গান্ধীজীর সম্প্রীতির পথে দেশকে নিয়ে যেতে পারলেই,বাপুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।”আসুন.আজকের দিনে,হাতে হাত মিলিয়ে,ঐক‍্য, সম্প্রীতির স্বদেশ গড়ার অঙ্গীকার করে গান্ধীজীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।