বিনোদন

নাটক রিভিউ–দাবানল


মল্লিকা গাঙ্গুলি:চিন্তন নিউজ:১৭ই জুন:–

*নাটক পর্যালোচনা- দাবানল*                            ভারতবর্ষের দুটি অমোঘ মহাকাব্য রামায়ণ এবং মহাভারত কে মূলত ধর্মগ্রন্থ হিসাবেই পুজো করা হয়। এই মহাকব্যিক ঘটনা বা চরিত্র গুলি যে কোনো মানব সৃষ্ট এ কথা আমরা ভুলে যায়, বা মানতে অভ্যস্ত নই, এমন কি ভারতীয় মজ্জাগত সংস্কার হলো মহাকবি বাল্মিকী বা বেদব্যাস ও মানব চরিত্র নন, তাঁরা দেবকল্প ঋষি। রামায়ণের রাম লক্ষণ সীতা স্বর্গের দেবতা, রাবণ তথা রাক্ষসকুল দানব আর মাঝের মর্তবাসী কায়মনে সর্ব গুন সম্পন্ন এই দেবকুলের উপাসক, দানব কুলের বিরোধী। ঠিক একই ভাবে মহাভারত কথা অমৃতসমান। সে ব্যাসদেব বলুন বা কাশীরাম দাশ, যিনি শ্রবণ করেন তিনিই পুণ্যবান! যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বাসের ব্যতিক্রম গ্রাহ্য নয়।               ঊনবিংশ শতাব্দীতে আধুনিকতার সূচনা লগ্নে গতানুগতিকতা বিরোধী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কলমে প্রথম আমরা রামায়ণের চিরাচরিত ভাবনা থেকে কয়েক ডিগ্রি ঘুরে ভাবতে শিখলাম। মেঘনাদবধ কাব্যে রাম লক্ষন নীচ পামর অধম মানব আর ঈন্দ্রজিত সেখানে Real Hero. আবার কবির কাব্যে কৌশল্যা নয় কৈকেয়ী যথার্থ মানবী, সীতা নয় উর্মিলাই আসলে দুঃখিনী কন্যা।     তেমনি বেদব্যাস বা কাশীরাম  কৃত মহাভারত মহাকাব্য থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে কাহিনী বিশ্লেষন করছেন রাজশেখর বসু, নৃসিংহ প্রাসাদ ভাদুড়ীর মতো প্রথিতযশা আধুনিক রচনাকার গন।               এখানে আমরা একেবারে হালফিলের নাট্যকার শিব শঙ্কর চক্রবর্তীর চোখে মহাভারতের এক খণ্ডচিত্র অবলম্বনে রচিত নাটক কে সম্পূর্ণ মানবিক মন নিয়ে পর্যালোচনা করবো।        নাটক – *দাবানল*!    প্রযোজনা আসানসোল রেপার্টরি থিয়েটার, নির্দেশনা স্বপন বিশ্বাস।

শিল্পাঞ্চলের স্বনামখ্যাত গ্রুপ থিয়েটার যারা নিজেদের বামপন্থী শিক্ষায় শিক্ষিত একটি নাট্যদল বলে পরিচয় দিয়ে গর্বিত সেই দিশারী নাট্যগোষ্ঠীর অনুপ্রেরণায় মঞ্চস্থ আধুনিক মহাভারতীয় নাটক দাবানল।  বিষয়বস্তু   ্ বা আঙ্গিকে পঞ্চাঙ্ক নাটকের ব্যাপ্তি এখানে নেই। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সমাপ্ত। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির রাজ্য রাজাসন লাভ করেছেন। এখন প্রাজ্ঞ প্রবীণ হিসেবে জীবিত আছেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, মহারানী গান্ধারী, রাজমাতা কুন্তী, আর তাত বিদুর। এই চারটি চরিত্র কুরুপান্ডব মহাসমরে ছিলেন নেপথ্যচারি তাই যুদ্ধ পরবর্তী শেষ দশা ভোগের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য এঁদের উপরেই বর্তায়। এখন তাঁরা চান না যুধিষ্ঠিরের স্বর্গরাজ্য রাজধানীর বিলাস ব্যসন। তাঁরা চতুরাশ্রম মেনে চতুর্থাশ্রমের পর্ণকুটিরে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, কিন্তু ধর্মাচারী যুধিষ্ঠির তার অতি প্রিয় অভিভাবক দের ত্যাগ করতে রাজী নন, কিন্তু কোনো ভাবেই ধৃতরাষ্ট্র কে সম্মত করতে ব্যর্থ হলে এই বনবাসে যথাসম্ভব আয়োজনের আবেদন করেন। এই হলো দাবানল নাটকের পটভূমি। এখানে থেকেই এক এক করে খুলে পরেছে চরিত্র গুলির অন্তরভাবনা।               মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, মহিষী গান্ধারী, মাতা কুন্তী এমন কি স্থিতধী বিদুরের মধ্যে জাগ্রত এক অনুতাপ দগ্ধ মানব সত্তা!  বিশেষ করে ধৃতরাষ্ট্র,তিনি যেমন রাষ্ট্রকে ধারন করে রাখতে পারেন নি, তেমনি নিজের মর্ম বেদনাকে ও রাজাসুলভ দৃঢ়তায় আয়ত্তে রাখেন নি। তিনি এখানে একজন আত্মদংশন দগ্ধ স্বামী, পুত্র শোকসন্তপ্ত পিতা, সর্বোপরি ক্রোধন্মত্ত অথচ প্রেম পিপাসু এক পুরুষ! জন্মান্ধ বলেই কান দিয়ে, ঘ্রাণ দিয়ে তার কাছে সমস্ত দৃশ্যমান! তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এতটাই প্রখর যে তার পরিবার পরিজন এমন কি মহিষী গান্ধারী ও তাকে বিকলাঙ্গ অর্ধমানব বলে করুনা করলেও এই মুহুর্তে বুঝিয়ে দিয়েছেন আর পাঁচ জন থেকে তিনি কতটা বেশি বুঝতে পারেন। গান্ধারীর চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে একদিকে গান্ধারীকে মুক্তি দিয়ে নিজেও অনুকম্পা মুক্ত হয়েছেন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের পিতৃ পরিচয়ের পর্দা টেনে ছিঁড়ে দিয়ে বিদুর বা কুন্তীর বিরাগভাজন হলেও আজ তার কাছে সত্য ই প্রধান অবলম্বন।                     গান্ধারী লোকচক্ষে পতিব্রতা পতি অনুগামিনী বলেই অন্ধ স্বামীর কষ্ট ভাগ নিতে চোখে কাপড় বেঁধে রাখলেও তার মধ্যে এক আত্মগরিমা আর ক্ষোভ পোষা ছিল, যা ধৃতরাষ্ট্র এক লহমায় খুলে দিয়েছেন। একই সঙ্গে পাটরানী বা রাজমাতার পরিচয়ের আবরণ খুলে গান্ধারী ও কুন্তী দুজন পৃথক নারী। দুই রমনী যখন সম্পর্ক ভুলে একে অপরের নাম ধরে ডাকে তখন সেই ব্যক্তি মানব তথা নারীসত্তার জয়গান ধ্বনিত হয়। ধর্মপুত্র বলে খ্যাত যুধিষ্ঠির তাঁর ও যেনতেন ভাবে নিষ্কণ্টক রাজ সিংহাসন ই লক্ষ্য। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাছে হার মেনেছে ন্যায় নীতি ভাতৃত্ব। বৃদ্ধ প্রহরী এই ধর্মপুত্রের  রাজাদেশ পালন করতে যে কু কর্ম করতে বাধ্য হয়েছেন জীবনোপান্তে এসে তা স্বীকার করে গ্লানি মুক্ত হয়েছেন। নাট্যকার চরিত্র গুলির জটিল অন্তর দ্বন্দ ফুটিয়ে তুলতে নাটকের নাম টি ও যথেষ্ট তাৎপর্যবাহী। চরিত্র গুলির ভিতরের আগুন তাদের মর্ম যন্ত্রণা কে পুড়িয়ে দিয়েছে। ধৃতরাষ্ট্রের মনের আগুন দাবানলের মতই ছড়িয়ে পরেছে প্রত্যেক টি চরিত্রের অন্দরে।আবার আচম্বিতে বনের দাবানলে আত্ম বিসর্জন যেন পবিত্র পাবকে পাপস্খালন, এ যেন তপ্ত কাঞ্চনের খাদ নিষ্কাশন!      ক্ষুদ্র পরিসরে নির্দেশক খুব সুচারু রুপে মূল বক্তব্য তুলে ধরেছেন। মাত্র কয়েকটি চরিত্র প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয়। বিশেষ করে ধৃতরাষ্ট্র (নির্দেশক স্বপন বিশ্বাস) এবং গান্ধারীর অভিনয় অনবদ্য। নতুনত্ব আনতে শকুনক্রান্তি কাল নির্দেশক শকুন নৃত্য খুব সুন্দর।                            ছোটখাটো ঘাটতি , যেমন বৃদ্ধ প্রহরীর উচ্চারণে কিছু ফাঁক মাতা কুন্তীর বার্ধক্য রেখা অভাব, শকুন পোষাকে পা ঢাকা কালো স্ন্যাকস এগুলো দিকে একটু সজাগ থাকলে উপস্থাপনা নিখুঁত।        বলতেই হয় বৃদ্ধ প্রহরীর সাথে যুবক প্রহরীর সমন্বয়ে মহাভারতের গোপন কু কর্ম গুলি ধরা যেন নতুন প্রজন্মের কাছে ব্যাস কৃত মহাভারতের নব রূপায়ণ। নব প্রজন্ম ধর্ম গ্রন্থ বলে নয় মহাভারত কে চিনবে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে,দোষে গুনে রক্তে মাংসের মানব চরিত্র হিসেবে কুরু পাণ্ডবদের বিচার করবে এই যেন নাট্যকারের অভিপ্রায়।                      দর্শক হিসেবে আমরাও নাট্যকার ও নির্দেশকের কাছে এই রকম আধুনিক ভাবনার মহাকাব্যিক নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আবেদন রাখি। প্রাচীন নবীনের মেলবন্ধনে ভারতীয় মহাকাব্যের কাহিনী আধুনিক সমাজে ছড়িয়ে পড়ুক।  সব শেষে বলতেই হয়, *দাবানল* নাটক রচনা নির্দেশনা গ্রন্থনা অভিনয় আলোকসজ্জা মঞ্চসজ্জা সব মিলিয়ে একটি সফল নাটক উপহার।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।