উত্তম দে, বিশেষ প্রতিবেদন: চিন্তন নিউজ: ২১/০২/২০২৪:– আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।পৃথিবীর সমস্ত ভাষার সম্মান, মর্যাদা রক্ষার শপথ নেবার দিন। অবহেলার কারণে আজ পৃথিবী থেকে অনেক ভাষা হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি আগ্রাসনের ফলে বেশকিছু ভাষা বিলুপ্তির পথে। আমাদের দেশেও,কখনো রাষ্ট্রভাষার নামে বা কখনো হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থানের নামে আগ্রাসন ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এই যে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বা আগ্রাসন, তারই বিরুদ্ধে গর্জে উঠে মাতৃভাষার অধিকারের পক্ষে দুনিয়া কাঁপানো ভাষা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হলে, সে দেশের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও উর্দু ভাষী বুদ্ধিজীবীরা উর্দু ভাষার পক্ষে সওয়াল করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ, বাংলাভাষী বুদ্ধিজীবীরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়।তারা সম্মিলিতভাবে দাবীনামা প্রস্তুত করে। তারা দাবী জানান, বাংলা হোক পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ও সরকারি পরিচালনার ভাষা এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা ও রাষ্ট্রভাষা হোক উর্দু ও বাংলা।এই দাবী নিয়ে ধীরে ধীরে জনমত গড়ে উঠতে শুরু করে। অধ্যাপক আব্দুল কাসেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশের মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম আন্দোলন গড়ে ওঠে।
ক্রমশঃ বিভিন্ন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সংগঠন এই আন্দোলনে যোগ দিলে, তা গণআন্দোলনের চেহারা ধারণ করে। তবু শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকেই রাষ্ট্রীয় ভাষার পক্ষে লাগাতার সওয়াল করতে থাকে।১৯৪৭ এর ৬ই ডিসেম্বর ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিনই প্রথম ভাষার দাবী নিয়ে ছাত্র সমাজ পথে নামে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে সভা করে। এরপর,ভাষার দাবীতে মিছিল, প্রতিবাদ চলতে থাকে। এরই মধ্যে অধ্যাপক নুরুল হককে আহ্বায়ক করে গঠিত হয়, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ২৩শে ফেব্রুয়ারি করাচিতে গণপরিষদের সভায়,সদস্যদের শুধুমাত্র উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা রাখার প্রস্তাব রাখা হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলা ভাষাকেও পরিষদের ভাষা হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি ও পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বিরোধিতায় তা বাতিল হয়ে যায়। এর জেরে ঢাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। শামসুল আলমের নেতৃত্বে নতুন করে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে।এরই মাঝে বিভিন্ন জায়গায় বয়স্ক শিক্ষায় উর্দু হরফে বাংলা ভাষা পড়ানো হতে থাকে।
১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ, গণপরিষদের ভাষা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া, মুদ্রা ও ডাক টিকিটে বাংলা ব্যবহার না করা, নৌ বাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষায় বাংলাকে বাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে হরতাল ডাকা হয়। মুজিবর রহমান,শামসুল হক সহ বেশকিছু আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হলে ১২ থেকে ১৫ই মার্চ হরতাল চলে। বেগতিক দেখে মুখ্যমন্ত্রী শান্তি চুক্তি করেন ও রাজবন্দীদের মুক্তি দেন। কিন্ত গর্ভনর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্নার ঢাকা সফরের ফলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। রেসকোর্সের মাঠের সভায় এই আন্দোলনকে কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র বলেন, উর্দুই রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উর্দুর পক্ষে সওয়াল করলে আবদুল মতিনের নেতৃত্বে ছাত্ররা নো নো বলে ওঠেন। কিন্তু জিন্না ঢাকা প্রস্থানের আগে শান্তি চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করেন। এরই মাঝে খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, উর্দু হবে রাষ্ট্র ভাষা এবং পাকিস্তান হবে ইসলামিক রাষ্ট্র। উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা। কমিউনিস্ট দল এসময় কার্যত নিষিদ্ধ ছিলো। তবু কমিউনিস্টরা এই আন্দোলনকে পুর্ণ সমর্থন জানায়। এবং যুব লিগের মাধ্যমে লিফলেট বিলি করতে থাকেন।
১৯৫২ সালের ৩১ শে জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে আব্দুল ভাসানির সভাপতিত্বে যে সভা হয় সেখানে প্রগতিশীল ছাত্র যুব ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে কমিউনিস্টরাও অংশগ্রহণ করেন।এই সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল, মিছিল, সভা ডাকা হয়। কিন্তু,সরকার ১৪৪ ধারা লাগু করে। কিন্তূ আন্দোলনকারীরা ছোট ছোট দল করে আইন ভেঙে অ্যাসেম্বলির দিকে এগোতে থাকলে, বেশকিছু জনকে গ্রেফতার করা হয়। উত্তেজনা ছড়ালে পুলিশ গুলি চালায়। আব্দুল জব্বার, রফিকুদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালাম শহীদ হন এবং বহু মানুষ জখম হন। পরের দিন শহীদের দেহ নিয়ে মিছিল করতে চাইলে পুশিশ দেহ হেফাজতে নেয়। কিন্তু রক্তভেজা কাপড় নিয়ে মিছিল করার সময় আবার গুলি চলে। দূই কিশোর সহ চারজন শহীদ হন। ১৯৫৬ সালে চাপে পরে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। পরে ১৯৯৯ সালে জাতীসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০০০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে।
আজ যখন সরকারী সকল ক্ষেত্রে মাতৃভাষার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। বিভিন্নভাবে ভাষা আক্রান্ত হচ্ছে তখন বার বার আমাদের ভাষা শহীদের আত্মত্যাগের কথা মনে করায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মাতৃভাষা রক্ষা তথা সকল ভাষার প্রতি সম্মাণ করার পণই হোক ভাষা শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।