চিন্তন নিউজ:-১৫ ই সেপ্টেম্বর:- প্রতিবছর ১৫ই সেপ্টেম্বর , আমাদের দেশে, শ্রীলঙ্কায়, তানজানিয়ায় “ইঞ্জিনিয়ার দিবস” হিসাবে পালন করা হয়। কর্ণাটকে জন্ম নেওয়া ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তিবিদ ও পরবর্তী জীবনে রাজনীতিবিদ মোকশাগুন্ডাম বিশ্বেশ্বরায়ার ( ১৫/৯/১৮৬০ — ১৪/৪/১৯৬২) জন্মদিন। সেই উপলক্ষে এই দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের কাছে ‘নাইট’ এবং স্বাধীন ভারতে “ভারতরত্ন” উপাধিপ্রাপ্ত বিশ্বেশ্বরায়া মূলত জলসম্পদ অর্থাৎ ‘ওয়াটার সেক্টর’ এর সঙ্গে যুক্ত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। প্রায়ই দুর্ভিক্ষপীড়িত পরাধীন ভারতে বাঁধ দিয়ে নদী নিয়ন্ত্রণ করে জলসেচের পরিকল্পনা করেন তিনি। পুণে শহরের কাছে খড়গওয়াসলাতে “ন্যশনাল ওয়াটার আকাডেমি”তে একটি সপ্তাহব্যাপী পেশাগত ট্রেনিংয়ে গিয়ে দেখেছিলাম । তার উদ্যোগেই প্রথম ” Automatic Weir Water Floodgate” তৈরী হয় ১৯০৩ সালে খড়গ ওয়াসলাতে। বহু মানুষ বন্যার দুর্দশা থেকে অনেকটাই মুক্তি পান। দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে বৃহৎ সেচের জটিল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলায় তাঁর প্রধান ভূমিকা ছিল।
প্রায়ই বন্যা আক্রান্ত হায়দ্রাবাদ শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তিনি সবার নজরে আসেন। বিশাখাপত্তনমে সেসময় এশিয়ার বৃহত্তম জলাধার গড়ে তোলেন এবং সেখানে বন্দরটিকে সমুদ্র-জলোচ্ছ্বাসজনিত ক্ষয় থেকে বাঁচানোর কারিগরী পরিকল্পনা করেন। কৃষ্ণরাজসাগর বাঁধটি নির্মাণে নেতৃত্ব তিনিই দেন। এছাড়াও , মহীশূরের ভদ্রাবতীতে লৌহ ইস্পাত শিল্পের মত ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প (যা পরে তার নামে নামাঙ্কিত হয়), বিখ্যাত মহীশূর সোপ ফ্যাক্টরি, ব্যাঙ্গালোর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় , ব্যাঙ্ক অফ মাইসোর, ব্যাঙ্গালোরে জয়চমরাজেন্দ্র পলিটেকনিক কলেজ প্রভৃতি বহু প্রতিষ্ঠান স্থাপনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র জল এখন বহু নতুন সমস্যা ও বিতর্কের মুখোমুখি। শুরুর উচ্ছ্বাস পেরিয়ে বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ আজ পৃথিবী জুড়েই প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন-দেশে দেশে গড়ে উঠেছে বৃহৎবাঁধ বিরোধী আন্দোলন। বিপুল সংখ্যক মানুষের বাস্তচ্যুতি, অরণ্য ধ্বংস, জলমগ্নতা ও নানা অসুখের প্রাদুর্ভাব , বৃহৎ জলাশয়ের জমা জল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মশা সহ বিভিন্ন ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের বিস্তার, জমির অপচয়, বন্য ও এমনকি ভূমিকম্পের কারণ -ইত্যাদি বহু অভিযোগ বৃহৎ বাঁধের বিরুদ্ধে। ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থা বিকল্প হিসাবে এসেছে। ভারতসহ প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে ক্ষুদ্র সেচের ব্যবহার ছিল। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তি গড়ে তোলায় যে উৎসাহ, তার কিয়দংশও নেই ক্ষুদ্র সেচ প্রযুক্তির উদ্ভাবনে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে ভারত স্বয়ম্ভর বলা হয় বটে, কিন্তু ভারতের সব মানুষ যদি দু’বেলা পেট ভরে খাদ্য পেত তবে এই স্বয়ম্ভরতার গর্ব সম্ভবত থাকত না। অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার পর ভারতে দুর্ভিক্ষকে বিদায়ের সাফল্য যেমন আছে , তেমনি স্থায়ী অপুষ্টিতে সাবসাহারান আফ্রিকারও পিছনে পড়ে থাকার ব্যর্থতা আছে। ব্যবহৃত জলের ৭০% যেহেতু লাগে সেচে তাই ক্ষুদ্র সেচের প্রযুক্তি দ্রুত উদ্ভাবন ও প্রয়োগের দরকার। ড্রিপ ও স্প্রিঙ্কলার সেচব্যবস্থার আরো পরিকাঠামো অর্থবরাদ্দ দরকার। দরকার জলবিভাজিকা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে গড়ে তোলা।
জললভ্যতায় ধনী ও গরীবের পার্থক্য এখন ক্রমবর্দ্ধমান। ভারতের ক্রিকেট ক্যাপ্তেন বিরাট কোহলিকে সামান্য ৫০০টাকা জরিমানা করেছিল স্থানীয় পৌরসভা তার অনেকগুলি গাড়ি রোজ বিপুল পরিমাণ পানীয় জল ব্যবহার করে ধোয়ার জন্য। ভূগর্ভস্থ জলের উৎস কমে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীনতা এর বড় কারণ। যে ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার আ্যক্ট ‘ তৈরী হয়েছে তাকে নানা রাজনৈতিক সংকীর্ণ কারণে শিথিল করা হচ্ছে। ফলে অত্যাধিক ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন জলে আর্সেনিক, ফ্লোরাইড দূষণেরও মাত্রা বাড়াচ্ছে।
জল এখন বিপুল মুনাফার ক্ষেত্রও। ভারতে জল ব্যবসা বার্ষিক ৭০% হারে বাড়ছে। নদীর অংশ লিজ দেওয়া হচ্ছে। জলব্যবস্থা বেসরকারীকরণ হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের নিদান হল উন্নয়নশীল দেশগুলির টাকা নেই-তাই বেসরকারীকরণ দরকার। বাস্তবে, বেসরকারীকরণের লক্ষ্যে তারা যে ঋণ দেয় সেই ঋণের টাকাই প্রকল্পের কাজে কোম্পানিদের দেওয়া হয়। মাছের তেলে মাছ ভাজা। লগ্নী হয় আসলে জনগণের অর্থ ,সুদও মেটে তা থেকে, মুনাফা নেয় বেসরকারী কোম্পানী।
আসলে, ইঞ্জিনিয়ারদের এখনো এদেশে সর্বোচ্চ কারিগরী সিদ্ধান্তের জন্য বহু ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। তা ইদানীং আরো বাড়ছে। আবার, কিছু ক্ষেত্রে তাদেরও দোষ আছে। ফলে ব্যুরোক্রাসীর সঙ্গে টেকনোক্রাসীও যথেষ্ট। বিশ্বেশ্বরায়া প্রকল্পের কাজে ও রক্ষণাবেক্ষণে গুণমানের ওপর খুব গুরুত্ব দিতেন। একজন ডাক্তারের চিকিৎসার ভুলে সাধারণভাবে একজন রোগীর মৃত্যু হয়। কিন্তু বিশেষত পরিকাঠামোর কাজে যুক্ত একজন ইঞ্জিনিয়ারের ভুলে যদি সেতু, বাঁধ, জলাধার, ভবন, কোন কাঠামো, কোন যন্ত্র, বা বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়, তাহলে শত-হাজার মানুষ বিপন্ন হতে পারে। কলকাতায় কয়েক বছর আগে পোস্তায় উড়াল-পুল ভেঙে পড়ে প্রায় তিরিশ জনের মৃত্যু , প্রায় আশি জন আহত-তার মধ্যে চিরপঙ্গু হয়েছেন অনেকে। তারপর মাঝেরহাট সেতু ভেঙেও মৃত্যু হয়েছে। এসব যেমন সত্য , আবার এও অনস্বীকার্য , প্রযুক্তিবিদরা নীরবে তাদের কাজ করে চলেছেন। তাদের সেই সাফল্যের কথা পর্দার আড়ালেই থেকে যায়। তাই নতুন নির্মাণ হচ্ছে, হয়ে যাওয়া নির্মাণ জনগণ বছরের পর বছর ব্যবহার করতে পারছেন। বস্তুত , সকালে ঘুম থেকে উঠে টুথব্রাশ থেকে শুরু করে রাতে শুতে যাবার সময় মাথার ওপরে চালানো ফ্যানটি , যে বাড়ীতে থাকছি -তা পর্যন্ত দৈনন্দিন জীবনের প্রতি মূহুর্তে ইঞ্জিনিয়ারের স্পর্শ থাকে।
বিশ্বেশ্বরায়ার সময় থেকে আজ প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়েছে। কম্পিউটার প্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা , রোবটিক্স, লেসার প্রযুক্তি,প্লাজমা প্রযুক্তি ইত্যাদি। এগুলি যেমন তাদের কৃতিত্ব ,তেমন মুনাফার স্বার্থে পরিবেশের যে লুন্ঠন চলছে তার বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রযুক্তিবিদদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে। তাদের এখন অনেক বেশী সোচ্চার হওয়ার দরকার। যে কোভিড-১৯ ভাইরাস এই অত্যুচ্চ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উন্নয়নের যুগেও মহামারী রূপে দেখা দিয়েছে তা অবশ্যই বৈজ্ঞানিক ভাবে নিয়ন্ত্রনের প্রয়াসের কারণে , বিজ্ঞানপ্রযুক্তির সাহায্যে ভাইরাস-চরিত্রবিশ্লেষণ করে সতর্ক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে –নাহলে হয়ত কয়েক কোটি মানুষ ইতিমধ্যে মারা যেত। কিন্তু একথা অস্বীকার করা যাবেনা দায়িত্বজ্ঞানহীন পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের ফলে বহু জীবাণু তাদের স্বাভাবিক পোষ্য বনের পশু জগত হারিয়ে লোকালয়ে মানুষের কাছে চলে আসছে। আঠাশ বছর আগে প্রথম বিশ্ব বসুন্ধরা সম্মেলনে কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো “Tomorrow IsToo Late” শীর্ষক বিখ্যাত ভাষণে বারবার বাজার সর্বস্ব বিশ্বায়নের বিপুল পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে সতর্ক করে আগামী প্রজন্মের জন্য সহনযোগ্য উন্নয়নের প্রতি জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এসব আজকের দিনে অবশ্যই ইঞ্জিনিয়ারদের ভাবনার বিষয়।
আজকের ভারতের পরিস্থিতিতে বিজ্ঞাননস্কতা ও যুক্তিবাদের ওপর বিশেষভাবে যে আক্রমণ শুরু হয়েছে তার বিরোধিতা আজকের ইঞ্জিনিয়ারদের কাছ থেকে সময়ের দাবী। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিতে উন্নত হতে গেলে আগে দরকার বৈজ্ঞানিক মনন। নিজেরা বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে উন্নত না হলে, শুধু অনুকরণ করে বেশিদূর এগোন যায় না। এবছর বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় কুমার দত্তের জন্মদ্বিশতবর্ষ। আপোষহীন মেদহীন আধুনিক বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের ক্ষেত্রে তারা ছিলেন এই দেশের পথিকৃৎ। আজকে খড়গপুরে বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যখন “বাস্তুশাস্ত্র” র মত অপবিজ্ঞানকে প্রযুক্তি বলে চালানোর চেষ্টা হয় –আমরা বেদনার্ত হই।
অনুসন্ধিৎসা থেকে আসে প্রশ্ন -আর প্রশ্ন থেকেই শুরু হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যাত্রা। তাই আজকের প্রযুক্তিবিদদের কাছে প্রশ্নের অভ্যাসও গড়ে তোলাও জরুরী বিষয়।
আমাদের পূর্বসূরী ইঞ্জিনিয়ার’রা স্বাধীনতার পর বহু পরিশ্রমে ও ভাবনায় যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি গড়ে তুলেছিলেন, আজ তার ওপর নির্বিচার আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। এটা তাদের অবদানের প্রতি অপমান এবং ভারতে স্বনির্ভর শিল্পোবিকাশ ও উন্নয়নের যে বনিয়াদ তারা তৈরী করে গেছেন তার বিনষ্ট করার প্রয়াস। আমরা যেন ভুলে না যাই, বিশ্বেশ্বরায়া তার ঔৎকর্ষতা ও উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন সরকারী ক্ষেত্রে কাজ করেই এবং তার মাধ্যমে জনকল্যানের উজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করে। আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত পরিচালন ব্যবস্থা এগুলিতে নিশ্চয় গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু তা না করে এগুলির নির্বিচার বিলগ্নীকরণ সমাজের বা দেশের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হতে পারেনা। এমনকি লাভজনক সরকারী সংস্থাগুলিকেও “জলের দরে” একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছ-যা বহু দুর্নীতিরও জন্ম দিচ্ছ বলে অভিযোগ। আজকের ইঞ্জিনিয়ারদের এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সামিল হওয়া উচিত।
বিশ্বেশ্বরায়া মানুষের কল্যাণে প্রযুক্তির ওপর তার সারাজীবন ধরে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাই কোন্ প্রযুক্তির অগ্রাধিকার তাও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিদ্যমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইঞ্জিনিয়ার দিবস হয়ে উঠুক প্রযুক্তিবিদদের কাছে সাধারণ মানুষের সার্বিক বাস্তবগত ও মননগত প্রয়োজন ও আস্থার ভূমি নির্মাণের দিন। সেখানেই তার প্রকৃত সার্থকতা । কোন যান্ত্রিক পালনে নয়।