কলমের খোঁচা

মার্কসের জীবনে জেনির ভূমিকা -দেবমিতা চট্টোপাধ্যায় সরকার ।


চিন্তন নিউজ: ৫ই মে :- আদিম পৃথিবী সংগ্রামের শুরু করেছিল পাকস্থলী দিয়ে ।তারপর সমাজ শ্রেণী ধর্ম বর্ণ অর্থের বৈচিত্র্য নিয়ে এলো বিভিন্ন বিভেদ, সামাজিক মূল্যবোধের অবমূল্যায়ন । স্বীকৃত সভ্যতার ১৮১৮বছর পর জার্মানিতে জন্মেছিলেন শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার কালপুরুষ কার্ল হাইনরিখ মার্কস । কিন্তু মানবজীবনের ধ্রুব সত্যের মতোই মানবজমিন আবাদ করতে সঙ্গে প্রয়োজন হয়, আরো অর্ধেক আকাশ ।কার্ল হাইনরিখ মার্কসের সেই অর্ধেক আকাশের নাম জেনি ভন ভেস্তফালেন অথবা বিশ্ব বন্দিত জেনী কার্ল মার্কস ।
” শব্দরা মিথ্যে আর অগভীর ছায়া ছাড়া আর কী!
চারপাশে জাগছে জীবন ….তোমার ভিতর মৃত ক্লান্ত এই আমি বইয়ে দেব আমার ভিতরের সবটুকু শক্তি ।…”
জেনির প্রতি–কার্ল মার্কস । অনুবাদ–ইমন জুবায়ের।
কবি মার্কস, প্রেমিক মার্কস । হ্যাঁ, বিপ্লব ঘুমিয়ে ছিল প্রেমের কবিতায়। প্রেমিকাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন কে নিয়ে লেখা প্রেমের কবিতা গুলো পড়লে আজও অনুভূত হয় সেদিনের সেই প্যাশন! মার্কস এর ছিল একমাথা ঘন কালো চুল আর কৌতুহলী আকর্ষণীয় দুটো চোখ আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধু বলতে এডগার ভন ভেস্তফালেন। যোগাযোগের নেপথ্যে মুখ্য ভূমিকা ছিল বন্ধুর বোন জেনির। চার বছরের বড় জেনির সাথে মার্কস এর প্রনয়ের সূত্রপাত তখন থেকে। জেনির বাবা ছিলেন তৎকালীন ক্রোশিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ।জেনির বিয়ে ঠিক হয়েছিল এক লেফটেন্যান্টের সাথে। কিন্তু জেনি লুকিয়ে১৮৩৬ সালে মার্কস এর কাছে চলে এসেছিলেন এবং শুধুমাত্র ভালোবাসার টানে অভিজাত ও সমৃদ্ধ সচ্ছল জীবনযাত্রা ত্যাগ করে মার্কস এর মত সংসারী বেকার যুবককে গোপনে বিয়ে করেন। কিন্তু অর্থের অভাব সারাজীবন তাড়া করে নিয়ে গেছে তাদের। জেনির স্থির, সংযমী ও সংগ্রামী মানসিকতা মার্কসের মতে দার্শনিক এর দর্শন চর্চার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল।জেনি ছিলেন মার্কস এর সংগ্রামী জীবনের সুযোগ্য সহযোদ্ধা । তার বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠিতে কি গভীর বেদনা ও মর্মস্পর্শী ভাষায় তাদের জীবন সংগ্রামের কথা ব্যক্ত করেন জেনি।গভীর রাত্রে একদিন জনা দুই লোক দুমদাম করে তাদের বাড়িতে পৌঁছায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে। আর জেরার জন্য তারা কার্ল কে নিয়ে যেতে চায় রাতের অন্ধকারে। বাড়ি বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতে লাগল জেনি ।একজন রক্ষী জেনিকে গ্রেপ্তার করে অন্ধকার হাজতে পুরে দিল। অন্ধকার একটা খুপরি ঘরে বুক চাপা কান্না নিয়ে রইল জেনি। ঘন্টা দুই জিজ্ঞাসাবাদের পর জেনির পেট থেকে বিশেষ কোনো কথা বের করতে না পেরে জনৈক পাহারাওয়ালা একখানা গাড়ির কাছে জেনিকে নিয়ে গেল। একেবারে সন্ধ্যের দিকে অসহায় তিনটি বাচ্চাকে আবার বুকের কাছে ফিরে পেল জেনি। ১৮৫০ সালে চেলসিয়ার বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তারা। কোলের ছোট্ট ছেলে বেচারা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। দৈনন্দিন জীবন কিভাবে চলবে এই দুশ্চিন্তায় জেনিরো স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। চারদিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পাওনাদারদের উৎপাতে অস্থির হয়ে লিস্টার স্কোয়ারের এক জার্মান হোটেলে সপ্তাহ খানেক কাটান তারা ।এই রকম বিভিন্ন ছোট বড় ঘটনার ছবি দিয়ে জীবন সংগ্রামের কোলাজ এঁকেছেন জেনি।অথচ চাইলে অনায়াসে এক সুখী জীবন কাটাতে পারতেন জেনি। শুধুমাত্র মার্কস কে ভালবেসে সব যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন তিনি।তবে সবচেয়ে চরম আঘাত নেমে আসে প্রিয় সন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় ।গুরুতর ব্রংকাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় মেয়ে ফ্রান্সিস্কার। তাদের প্রিয় সন্তানের মৃত্যু ঘটল তখন যখন তাদের কঠিনতম দুর্দশার সময় চলেছে। আর তাদের বন্ধুরাও তখন তাদের সাহায্য করতে অসমর্থ হয়ে পড়েছেন। একজন ফরাসি শরণার্থীর কাছে সাহায্য ভিক্ষা করলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি 2 পাউন্ড দেন জেনিকে। ঐ টাকা খরচ করা হলো কফিন কেনার জন্য । তাদের মেয়ে যখন শান্তিতে শায়িত, তখন জেনি বলছেন” এই কফিনে আমার মেয়ে এখন শান্তিতে শায়িত ,মেয়ে আমার যখন পৃথিবীতে এসেছিল তখন তার একটা দোলনা পর্যন্ত ছিল না আর মারা যাওয়ার পর বহুক্ষণ পর্যন্ত তার শেষ বিশ্রামের শয্যা টুকু ও জুটলো না ।”এত যন্ত্রণা এত অভাব কষ্ট সহ্য করেও মার্কস এর প্রতি তার ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল অবিচল।শত অভাবের মধ্যেও বারে বারে কলম ধরেছেন তিনি। লিখেছেন, তাদের সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয় এবং বিশেষ করে জেনি নিজেকে মনে করতেন তিনি হলেন সুখী ভাগ্যবতীদের একজন কারণ তার জীবনের প্রধান অবলম্বন তার স্বামী এখনো তার পাশে আছেন। সত্যি সত্যি যদি কোন কিছু তার হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে তা হলো এই চিন্তা যে, ছোটখাট ব্যাপার এর জন্য তার স্বামীকে কতই না কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে ।আর তার পক্ষে কত সামান্য পরিমাণে না তাকে সাহায্য করা সম্ভব হয়েছে এবং যে মানুষ টা স্বেচ্ছায় সানন্দে অসংখ্য লোকের উপকারে এসেছেন তিনি নিজে কত অসহায়। এ প্রসঙ্গে জেনি বলছেন কিন্তু তাই বলে একথা ভাববেন না যে “আমরা কারো কৃপাপ্রার্থী”। তার স্বামীর মতাদর্শ ভাবনা-চিন্তা নিয়ে তার অহংকার এর অন্ত ছিল না। তিনি মনে করতেন তার স্বামী তার ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন এবং তা যাদের উত্সাহ সমর্থন যুগিয়েছেন তাদের কাছে একটি মাত্র বস্তুই তাঁর কাম্য আর তা হল কাজকর্মে আরো বেশি প্রাণের লক্ষণ প্রকাশ করা ও মার্কস এর গবেষণা কে আরো বেশি করে সমর্থন জানানো ।এইটুকু দাবি করার মত অহংকার আর অধিকার বোধ আজীবন সে বয়ে নিয়ে গেছে। এই হলো জেনি। জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মুহূর্তগুলোকে অতিক্রম করে গেছেন সহযোদ্ধার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখে ।মার্কসের সারা জীবনের সকল কাজ, সকল দারিদ্র্যের সঙ্গী ছিলেন তিনি, ছিলে ভরসাস্থল। বিয়ের সময় পাওয়া সমস্ত উপহার বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। কখনোই কোন স্থায়ী রোজগার ছিল না মার্কসের। মেনে নিয়েছিলেন তিনি আর কখনো কোনো অনুরোধ করেননি অভিযোগ করেননি। একজন স্ত্রী হিসেবে আজীবন দুর্ভোগকে সমান করে ভাগ করে বয়ে নিয়ে গেছেন ।এই মহীয়সী নারী মার্কসের সাথে যাযাবরের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন জার্মান ,প্যারিস, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড। সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া জেনি ভুলে গিয়েছিলেন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। স্যাঁতসেঁতে ঘরে চার চারটি বাচ্চা নিয়ে শীতের দিনেও মেঝেতে রাত কাটিয়েছেন। কিন্তু মার্কস এর সাথে এই জীবনকে কখনোই তিনি অভিশাপ মনে করেননি। তিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন মানুষের মুক্তির জন্য লড়ে যাওয়া এক দার্শনিকের সহ যোদ্ধা। নিজের এবং বাচ্চাদের কষ্টের কথা ভুলে গিয়ে বরং আফশোস করেছেন এ কথা ভেবে যে, লেখালেখির জন্য মার্কস উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছেন না বলে। দুশো বছরের কর্পোরেট পুঁজির বিস্তারিত স্যাটেলাইট দুনিয়ায় এলইডি টিভির পর্দা নিরন্তর যখন বোঝায় ,আত্মসুখ এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ইহজন্মের পরম প্রাপ্তি তখন জেনি কার্ল মার্কস এমন একটি উদাহরণ যা বিশ্বের মহিলা সমাজের কাছে পরস্পরের মধ্যে আন্তরিক বন্ধনে নারী-পুরুষের সার্বজনীন সাফল্য সাংসারিক ভূমিকায় কিভাবে রচিত হয় তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ।তাই বিশ্ব ইতিহাসে সমাজ সভ্যতার গতিপথ যতদিন পুঁজিবাদের আঘাতে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হবে ততদিন মানব মুক্তির লক্ষ্যে অনির্বাণ ধ্রুব তারা হয়ে ঠিক যেমন পথ দেখাবেন মার্কস ঠিক তেমনি ,তার সহযোদ্ধা এবং সুযোগ্য জীবন সঙক হিসাবে সমমর্যাদায় স্বগরিমায় চিরকাল জায়গা করে নেবে জেনি কার্ল মার্কস ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।