অরূপ সেনগুপ্ত: চিন্তন নিউজ:২৭ শে নভেম্বর:– আপত্তিঃ
স্থানীয় অধিবাসীরা, বিশেষ আদিবাসীরা আপত্তি তুলেছেন, বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তাঁদের অনেক বাস্তব আশঙ্কা রয়েছে, অনেক ন্যায্য দাবি আছে। আদিবাসীদের সংগঠন বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা এই প্রকল্পের বিরোধিতা না করেও এর বিপদগুলির যথাযথ নিরসন চেয়ে আন্দোলন করে আসছে।
আর তার পরিপ্রেক্ষিতে শাসক দলের পরিচিত খেলার ছকই সামনে আসছে- পাহাড়ে গোর্খা দল ভাঙ্গানোর খেলা, দলদাসদের নিয়ে সুরক্ষাবৃত্ত তৈরি করা, মিথ্যা প্রচারের বন্যা- বাকি নেই কিছুই। সম্প্রতি ২০১৯ সালে বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা ভেঙে পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী গাঁওতা তৈরি করা হয়েছে- তাদের সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসানো হয়েছে। প্রশাসনিক স্তরে যতগুলি আলোচনা হয়েছে তার বেশিটাই শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মানুষদের নিয়ে হয়েছে। বহু সমস্যার সমাধান এখনও বহুদূর, কিন্তু সম্প্রতি এলাকায় খনি প্রকল্প নিয়ে রাজনৈতিক প্রচার অভিযান চালানো হচ্ছে।
বিরোধিতা না কি আলোচনাঃ সমস্যা সত্যিই অনেক।
অনেকেই বলবেন, তাহলে কি কয়লার দরকার নেই, উন্নয়ন কি হবে না?
খুব স্পষ্ট আর দৃঢ় অবস্থান, হ্যাঁ, অবশ্যই আছে, অবশ্যই হবে।
কিন্তু উন্নয়ন করতে গেলে তার আগে অনেক প্রশ্নের সমাধান করতে হবে।
সুসংবদ্ধ উন্নয়নঃ
প্রথমেই প্রশ্ন আসে, এই উন্নয়ন, এই কর্মকাণ্ড কী পদ্ধতিতে হবে- দেশের উন্নয়ন আর কর্মসংস্থানের লোভ দেখিয়ে পরিবেশ যথেচ্ছ সংহার করে শুধু মুনাফার পথ ধরে?
উন্নয়ন হবে, কিন্তু তা করতে হবে সুসংবদ্ধ (sustainable) পদ্ধতিতে, প্রকৃতি আর মানব সম্পদের ভারসাম্যের ন্যূনতম পরিবর্তন করে।
প্রাকৃতিক সম্পদের পুনর্নবীকরণ
খনি হবে ১২.৩ বর্গ কি মি- ৩৪০০ একর জমি জুড়ে। খনি এলাকায় দেড় বর্গ কিলোমিটার বা ৩০৭ একর জুড়ে রয়েছে বনভূমি, বাকি এলাকায় রয়েছে চাষের জমি আর ডাঙ্গা জমি। দু একটি স্থানীয় ছোট নদী আর জলাশয় রয়েছে। এই বাস্তুতান্ত্রিক ইউনিটে রয়েছে স্থানীয় উদ্ভিদ আর প্রাণী জীববৈচিত্র্য, আজকের বিলীয়মান জীববৈচিত্র্যের পটভুমিকায় যার গুরুত্ব অপরিসীম।বীরভূম জেলার সরকারী সার্ভেতে তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। খনির কাজ আরম্ভ হলে এই সবই সম্পূর্ণ বিনষ্ট হবে। তা হলে খনি আরম্ভ হবার আগে বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ওই জীববৈচিত্র্যকে কতো তাড়াতাড়ি বিকল্প জায়গায় পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব, আর কতোটা সম্ভব তার পর্যালোচনা দরকার।
খনি হলে ওপরের সব মাটি সরিয়ে ফেলা হবে, যা থাকবে তার সঙ্গে কয়লা-তেল-সিমেন্ট-রাবিশ মিলে এক আবর্জনা তৈরি হবে। দূর ভবিষ্যতে হলেও খনি একসময়ে ফুরোবে। তখন ওই জমিকে এক আবর্জনাময় নিষ্কর্মা ধ্বংসস্তূপ (সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানা ধ্বংসের পরে পরিকল্পনাবিহীন কংক্রিট-আবাদ জমির কথা মনে রেখে) হিসেবে ফেলে না রেখে ওই জমিকে আবার ব্যবহার যোগ্য করে তোলার পরিকল্পনা করে রাখা দরকার।
তাছাড়া, এলাকায় জলস্তর সাধারণভাবেই মাটির অনেক নিচে। সেই কারণে এলাকায় আগে থেকেই তীব্র জলসঙ্কট রয়েছে; খনির কাজ আরম্ভ হলে তা আরও বাড়বে। জলস্তর আরও নিচে নেমে যাবে। সেই সমস্যা প্রতিকারের অগ্রিম পরিকল্পনাও দরকার।
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা
আর তা করতে গেলে প্রথমেই দরকার বিস্তৃত, সার্বিক পরিকল্পনা। সরকার একা, বা তার একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি তা তিনি যতোই গুরুত্বপূর্ণ হোন, আর তার কিছু নতমেরুমস্তক দুর্বলস্কন্ধ আমলা দিয়ে সে পরিকল্পনা সম্ভব নয়- ওই পরিকল্পনায় যুক্ত করতে হবে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ভূমি, অর্থ, বাণিজ্য ইত্যাদি সকল দপ্তর বাদেও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ,বাস্তুতন্ত্র বিজ্ঞানী, ভূবিজ্ঞানী, হাইড্রোলজিস্ট, চিকিৎসক, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, সমাজকর্মী, সকল রাজনৈতিক সংগঠন এবং সর্বোপরি ভুক্তভোগী অধিবাসীদের সকল প্রকৃত প্রতিনিধিকে(প্রশাসনিক প্রতিনিধি নয়)।
কোন প্রযুক্তি, কোথা থেকে, কেন?
কোল ইন্ডিয়া, বেঙ্গল বীরভূম কোল কোম্পানি সহ বিভিন্ন দায়ভাগী পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়েছে যে এই খনি থেকে কয়লা তোলার জন্য যে উন্নত প্রযুক্তি দরকার তা ভারতীয় সরকারী সংস্থাগুলি সহ কোনো ভারতীয় সংস্থারই নেই, সুতরাং এমন কোনো বিদেশী সংস্থার সঙ্গে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চুক্তি করতে হবে, যাদের দরকারী প্রযুক্তি রয়েছে। আমাদের মনে দেশীয় কারখানায় ফরাসি দ্যাসো কোম্পানির যুদ্ধবিমান রাফালে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পূর্ণ পরিচয়হীন অনিল অম্বানির সংস্থাকে বরাত দেবার কেলেঙ্কারি এখনও জ্বলজ্বল করছে। দুধের গুণমান উন্নত করার অজুহাতে মাদার ডেয়ারিকে মায়াংক জালানের হাতে তুলে দেবার ঘটনা সবে ঘটেছে। তাই দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হওয়া দরকার কী ধরণের প্রযুক্তি এক্ষেত্রে কাজে লাগছে, আর তা কোন সংস্থার কাছ থেকে নিতে হচ্ছে, কেনই বা নিতে হচ্ছে।
চুক্তিবদ্ধ সংস্থা, চুক্তির শর্ত
প্রশ্ন তাহলে, বিদেশী সংস্থার সঙ্গে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চুক্তি করতে হবে। তাহলে কোন গ্লোবাল টেন্ডারের ভিত্তিতে কোন সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, কতোটা দায়িত্ব আর কী ধরণের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, বাণিজ্যিক চুক্তির শর্তগুলি কী কী তা বিস্তারিত জানাতে হবে। আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে, বোফর্স-রাফালে চুক্তির দেশে গোপনীয়তার আড়ালে অনেক সম্পদের বেনিয়মী হাতবদল হবে অনেক ব্যক্তি আর সংস্থার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ফুলেফেঁপে উঠবে।
ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসন
এই একটি বিষয় বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে।
সরকার কিছু ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেছেন- আশ্চর্যজনকভাবে আদিবাসী মানুষ আর প্রাকৃতিক সম্পদগুলি বাদ রেখেই তা করেছেন। প্রশ্ন সেখানেও। ক্ষতিপুরণের অঙ্ক কোন হিসেবে, আর কী কী উপাদান ধরে স্থির করা হচ্ছে- বসত, শালি আর বাণিজ্যিক জমি সহ সম্পদের অধি- বা অবমূল্যায়ন ধরে বাজার দর? মজুরির বিকল্পে সম্ভাব্য আয়বৃদ্ধি আর মুল্যবৃদ্ধিসহ জীবনধারণের খরচের হিসেব ধরে মাসিক ভাতা বা এককালীন অর্থ? ফসলের কতো বছরের সম্ভাব্য গড় উৎপাদন আর তার মূল্য- সার, বীজ, সেচ, বিষ, মনিষ, পরিবহণ আদি সব খরচ আর তার অধিমূল্যায়ন হিসেব করে? খেতমজুরদের ক্ষতিপূরণ কোন মজুরিহার কতো বছরের গড় হিসেবে আর জীবনধারণের কোন মানের নিরিখে নির্ধারণ করা হবে?
এখানকার খাদানগুলি কিছু অনুমোদিত, কিছু অননুমোদিত। খাদান মালিকদের বাড়ি আর ‘জমির’ (খাদান জমির?) দাম আর স্থানান্তরের খরচ ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবেন, আবার চর ময়না ব্যাসল্ট পার্কে জায়গা আর বিনামূল্যে ব্যাসল্ট পাবেন। অর্থাৎ দুদফা ক্ষতিপূরণ। সরকার বলেছেন, অননুমোদিত খাদান মালিকেরা ক্ষতিপুরণ পাবেন না- বেশ কথা। জমির দাম, বাড়ির দাম আর স্থানান্তরের খরচ কোন হিসেবে ঠিক হবে? কেউ বেশি বেশি আর কেউ কম পাবে না তো?
এই সব খাদানে আনুমানিক প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক কর্মরত। খনির কাজ আরম্ভ হলে এই সব খাদান স্থানান্তর করতে হবে, আর শ্রমিকদেরও কর্মচ্যুতি ঘটবে। ঘোষণা অনুসারে এঁদের প্রত্যেকে ৫০ হাজার টাকা পাবেন, মানে মাত্র একদফা, এটা কোন হিসেবে ঠিক হলো- মজুরির বিকল্পে সম্ভাব্য আয়বৃদ্ধি আর মুল্যবৃদ্ধিসহ জীবনধারণের কোন মানের আর কতোদিনের খরচের হিসেব ধরে? এঁরা ওই ব্যাসল্ট পার্কে বিকল্প কাজ নিশ্চিত করে পাবেন না কেন? আর অনুমোদিত-অননুমোদিত নির্বিশেষে সকল খাদান মজুরের ক্ষতিপূরণ আর কাজ নিশ্চিত করা দরকার; এঁরা কেউ কেউ যে অননুমোদিত খাদানে কাজ করছেন, তা এঁদের দোষ নয়।
খাদান বাদে অন্যান্য খনির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
এলাকার ৬০.৩২% মানুষ কৃষিতে নিযুক্ত, তার মধ্যে কৃষক ১৫.৪৩% আর কৃষি মজুর ৪৪.৮৯% । এলাকার জমি মূলতঃ একফসলী হলেও সেখানে ধান, গম, ছোলা, আখ আর তামাক চাষ হয়। সহায়ক পেশা হিসেবে পশুপালন। খনির কাজের প্রয়োজনে এই সব এলাকা অধিগৃহীত হলে কৃষকরা হারাবেন তাঁদের জমি আর ফসল, আর কৃষি মজুরেরা হারাবেন জীবিকা।
বলা হয়েছে, কৃষকদের অধিগৃহীত জমির চরিত্র অনুসারে বিঘা পিছু ১০ থেকে ১৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। উচ্ছেদ হওয়া কৃষক প্রত্যেককে এককালীন ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। গোয়াল ইত্যাদির জন্য ৫ লক্ষ টাকা আলাদা। এখানেও প্রশ্ন, এই হিসেবের ভিত্তি কী? কয়েক বছরের গড় ফসল উৎপাদনের পরিমাণ, তার কয়েক বছরের সার, বীজ, সেচ, বিষ, মনিষ, পরিবহণ আদি সব খরচ আর তার অধিমূল্যায়ন হিসেব করে
গড় দাম কী ভাবে নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণের হিসেব করা হবে, আর তা দেওয়া হবে কী ভাবে? এই হিসেবে ফসলের বিমা থাকলে তার হিসেব কী ভাবে করা হবে? পশুপালনের ক্ষেত্রেও তাই। তাছাড়া, এই হিসেব করার সময়ে পরিবারের কর্মরত অন্যান্যরা, যাদের পরিভাষায় লুক্কায়িত বেকার বলা হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে কী চিন্তা ভাবনা করা হয়েছে?
এই সকল খেতে খেতমজুরদের কথা তো বলাই হয় নি। চাষের কাজে এঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ এঁদের আদৌ কী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, দিলে তার হিসেব কী ভাবে হবে, অবমূল্যায়ন ধরে কতো বছরের গড় মজুরীর পূঞ্জীভূত পরিমাণের হিসেবে তা নির্ধারিত হবে, তা কিছুই বলা নেই।
এলাকার আদিবাসীরা ওই ৩০৭ একর জমির ওপরে চিরায়ত সংস্কার, সংস্কৃতি আর জীবিকার অধিকারে অভ্যস্ত। বনসম্পদ তাঁদের জীবনের সঙ্গে জীবিকা, আশ্রয় আর সংস্কৃতির সূত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানে তাঁরা গরু-মোষ-ছাগল চরান, খাবার আর ওষুধ খোঁজেন, এখান থেকে তাঁরা তেল, কাপড়ের রঙ আর মহুয়া সংগ্রহ করেন, এখানেই তাঁদের দেবতার আসন, এখানে শিকার করা তাঁদের পরব।চিরাচরিত এই জীবনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাধারণ আদিবাসী বাঁচতে পারেন না। খনির কাজ আরম্ভ হলে এরা শুধু তাঁদের বসতভিটা নয়, তাঁদের চিরায়ত চারণভূমি আর জীবিকা থেকেও উচ্ছেদ হবেন।
এর আগেই তাঁদের চিরাচরিত এই জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করার ফন্দি আঁটা হয়েছে- বনজ সম্পদ সংগ্রহ আর বিপণনের একচেটিয়া অধিকার তাঁদের তো দেওয়াই হয় নি; আগে তাও বা যে সরকারী সংস্থা NSTFDC (National Scheduled Tribes Finance and Development Corporation) এর উদ্যোগে সরকারী প্রকল্প ল্যাম্পসের (Large Area Multipurpose Societies বা LAMPS Scheme) মাধ্যমে আদিবাসী মানুষদের, বিশেষতঃ মহিলাদের বনজ সম্পদ উপযুক্ত মূল্যে কিনে তাঁদের স্বনির্ভরতায় সহায়তা করার ব্যবস্থা ছিলো, এখন ধীরে ধীরে তা-ও সঙ্কুচিত করা হচ্ছে; ঠিকাদারের হাতে বন ইজারা দিয়ে বনজ সম্পদ একচেটিয়া লুঠের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।এখন তো প্রশাসনের পক্ষে তাঁদের এই অধিকার স্বীকারই করার কোনো উদ্যোগ নেই; তাহলে তাঁদের স্থানান্তরের পরে এই কারণে ক্ষতিপূরণের কোনো দায়িত্বই কোনো পক্ষ নেবে না! খনির কাজ আরম্ভ হবার আগে এঁদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। নির্ধারণ করা দরকার, আদিবাসী মানুষদের বনজ সম্পদ থেকে আয়ের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের পদ্ধতি কী, আর তাঁদের বিকল্প আয়ের প্রকৃতি কী?
তা ছাড়া কুটির শিল্প ও অন্যান্য জীবিকায় নিযুক্ত যথাক্রমে ২.৪৪% এবং ৩৭.২৪% মানুষ। কিছু রয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এই সকল মানুষের ক্ষতিপূরণ ও বিকল্প আয়ের ধারণা কী?
বলা হয়েছে, স্থানান্তরিত পরিবারদের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রতি পরিবারে এক জনের পুলিশে চাকুরি দেওয়া হবে, আর তাঁদের বছরে ২২৫০০ টাকা দেওয়া হবে। ভুমি হারা যাদের চাকরি হবে সে চাকুরির ধরণ কি, স্থায়ী বা অস্থায়ী চাকুরি কি না, যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন পদে চাকুরি কি না, পরিবারের আয়ের প্রকৃতি নির্বিশেষে একই প্রকার চাকুরি কি না, সামাজিক কোন সুরক্ষা থাকবে কি না, বেতন কত- এই সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দরকার। টাকা দেওয়া হলে তার পরিমাণ কোন হিসাব অনুযায়ী নির্ধারণ করা হলো, তা কী ভাবে দেওয়া হবে, প্রতি বছরে দেওয়া হবে নাকি একবারই মাত্র দেওয়া হবে, তা নির্দিষ্টভাবে বলতে হবে।
খনির কাজ আরম্ভ হলে সরকারী বক্তব্য অনুসারে প্রারম্ভিকভাবে খনি অঞ্চলে ১২টি গ্রামের ১০ থেকে ১৫ হাজার অধিবাসীকে স্থানান্তরিত করা হতে পারে। পরে খনি অঞ্চলে সব মিলিয়ে ৩৪টি গ্রামের ১৮ হাজার মানুষকে স্থানান্তরিত করতে হতে পারে।
বলা হচ্ছে, এঁদের জন্য পুনর্বাসন কলোনি গড়ে সেখানে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে। পুনর্বাসন কলোনির অধিবাসীরা প্রতি পরিবারের জন্য ৬০০ বর্গফুটের বাড়ি আর সংশ্লিষ্ট জায়গা পাবেন। পুনর্বাসন কলোনি ধারণাটা খুব স্পষ্ট নয়- কোন অঞ্চলে এই কলোনি হবে, তার জমি কী ভাবে পাওয়া যাবে বলা হয় নি। স্থানান্তরিত অধিবাসীদের বর্তমান গৃহসম্পত্তির মূল্যায়ন নির্বিশেষে সকলকে কী ভাবে একই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বোঝা সম্ভব নয়। আবাসিক পূনর্বাসন ছাড়াও আনুষঙ্গিক সুবিধা- পানীয় জল, নিকাশী ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, চিকিৎসাকেন্দ্র ইত্যাদি কীভাবে কোথায় ব্যবস্থা করা হবে, তা প্রশাসনকে স্পষ্ট করে জানাতে হবে।
স্থানীয় অনেক আদিবাসীর পাট্টা নেই, যাঁদের পাট্টা রয়েছে তারও অনেকের পাট্টার সাম্প্রতিক তথ্য আপডেট করা নেই। এঁদের স্থানান্তরের সময়ে আর ক্ষতিপূরণ দেবার সময়ে আইনী জটিলতার ফাঁকে তাঁদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ না মেলার আশঙ্কা রয়েছে। প্রশাসনকে তা-ও সুনিশ্চিত করতে হবে।
সব মিলিয়ে একথা বলা চলে, ডেউচা পাচামি খনিশিল্পের উদ্যোগ দীর্ঘকাল শিল্পরিক্ত পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে আশার আলো- কর্মসংস্থানের নিরিখেও বটে, আর শিল্প উৎপাদনের বৃদ্ধি, ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্য জি ডি পি বৃদ্ধির নিরিখেও বটে।
সাম্প্রতিক অতীতে বর্তমান শাসক দলের রাজ্যের শিল্প-পরিস্থিতি সম্পর্কে সামগ্রিক উপলব্ধির অভাব আর অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে শিল্পবিকাশ একরকম থমকে রয়েছে; অর্থনৈতিক বাস্তবতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা অনতিক্রম্য বাধা হয়ে রয়েছে। জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হলো সিঙ্গুরের জমির হাল।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিস্থিতির পর্যালোচনায় ও সমাধানের দিশায় অযৌক্তিক বাগাড়ম্বর আর পরিকল্পনার অস্বচ্ছতা ও ত্রুটির কারণে প্রায় প্রতিটি প্রকল্প সমস্যায় পড়ছে, ভুগছেন সাধারণ মানুষ।
তাই এই ডেউচা পাচামী প্রকল্পেও সরকারের কাছ থেকে প্রকৃত জনমুখী উন্নয়ন আদায় করতে, আর প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা পেতে আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর এই বিকল্পের পথ দেখাতে হবে বামপন্থীদেরই।