চৈতালি নন্দী: চিন্তন নিউজ:২০শে মে:– আজ ‘চা শ্রমিক দিবস’, আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯২১ সালের ২০শে মে অধুনা বাংলাদেশের সিলেটে প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক আওয়াজ তুলেছিলেন “মুল্লুক চলো” স্লোগানে, চা বাগান মালিকদের অমানবিক নির্যাতনের প্রতিবাদে নিজভূমে ফেরার তাড়নায়। কিন্তু ব্রিটিশ চা বাগান মালিকদের বেতনভূক গোর্খা সৈন্যবাহিনীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ফলে মৃত্যু হয় শত শত চা শ্রমিকের। তাদের মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় মেঘনার জলে। সেই সময় থেকেই রক্তস্নাত এই দিনটিকে ‘চা শ্রমিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার দাবী জানিয়ে আসছেন চা বাগান শ্রমিকরা। যদিও এই দাবী এখনও আইনের স্বীকৃতি পায়নি। এই দিনটি তাদের অধিকার অর্জনের দিন, শ্রমিক ঐক্য উদযাপনের দিন, এটি একাধারে উত্তর বঙ্গের তরাই ডুয়ার্স ও পার্বত্য এলাকার চা বাগান শ্রমিকদেরও দিন।
উত্তর বঙ্গের পার্বত্য উপত্যকা সাধারণ কৃষিকাজের অনুকূল না হলেও এখানকার চা জগদ্বিখ্যাত। তরাই, ডুয়ার্সের পার্বত্য গিরিখাতে যে জনবসতি গড়ে উঠেছে, তা শ্রমিক শোষণের ইতিহাসে জারিত। চায়ের আবিষ্কার যে দেশেই হোকনা কেন এদেশে শ্রমিকদের বঞ্চনা আর শোষণ চলেছে ধারাবাহিক ভাবে। অতীতে ব্রিটিশ অধিকৃত বিভিন্ন দেশ থেকে প্রলোভন দেখিয়ে চা শ্রমিকদের নিয়ে আসা হতো এদেশের চা বাগান গুলিতে। ছোটনাগপুর, সিংভূম, আসাম, উড়িষ্যা উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও শ্রমিকদের নিয়ে আসা হতো তরাই ডুয়ার্স ও দার্জিলিংয়ের চা বাগান গুলিতে।
চা শিল্পের জন্মলগ্ন থেকেই এই চা শ্রমিকরা ছিল মালিকপক্ষের শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। পরবর্তীতে চা বাগান গুলি দেশীয় মালিকদের হাতে এলেও অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি, কোন উন্নয়ন ঘটেনি জীবনযাত্রার মানেও। বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা থেকে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরির গ্রাফ নেমেছে প্রতিনিয়ত, বেড়েছে শ্রমিক শোষণ। রয়েছে চরম খাদ্যাভাব, সরকারী রেশনের দৈন্য। নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা ব্যাবস্থা যা শ্রমিক সন্তান দের মানোন্নয়ন ঘটাবে। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু এখানে প্রতিনিয়ত ঘটছে, যা তারা এখন নিয়তি বলে মেনে নিয়েছেন। বাসস্থানে স্থানাভাব তাদের পশুর জীবনযাপনে বাধ্য করছে। বর্তমানে ২০১৯ এর শ্রম আইন অনুযায়ী একজন চা শ্রমিকের মজুরী দৈনিক ১২০ টাকা যা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে অসামঞ্জস্য পূর্ণ।
পরবর্তীকালে বামপন্থীদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় শ্রমিকরা, তৈরী হয় ট্রেড ইউনিয়ন। গড়ে ওঠে আন্দোলন।কিন্তু বিভেদকামী শক্তি শ্রমিক ঐক্যে বার বার ফাটল ধরানোয় তা সবক্ষেত্রে সফল হয়নি। প্রকৃতপক্ষে অনেকক্ষেত্রে চা শ্রমিকদের মূল সমস্যার গভীরে পৌছনো যায়নি। মজুরি, প্রতিনিয়ত চাকরীর অনিশ্চয়তা ছাড়াও উঠেছে এদের ভূমির অধিকারের দাবী, যা মান্যতা পায়নি। এখনও মালিকপক্ষ চাইলেই চাকরী থেকে বহিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে ভূমি থেকেও উৎখাত হতে হয়। সঠিক শ্রমনীতি প্রণয়ন ও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে শ্রমিক কল্যাণমুখী নীতিগুলো সঠিক দিশা পায়নি। চা বাগান গুলির অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশকে মাথায় রেখে বিকল্প শিল্পের প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। চা শিল্প ও পর্যটন শিল্প এখানে সমান্তরাল ভাবে চলতে পারে যা আদতে উন্নয়ন ঘটাবে মূল শিল্পটির।