চিন্তন নিউজ: ২৬শে এপ্রিল:–সকাল থেকেই লকডাউনের নেশা লেগেছে। মনে ভাসছে নানা ভাবনা। আমার দুই সারিকা কেমন আছেন কে জানে? ওরা তো দু’মাসের মাইনে নেয় নি! ওদের ব্যাঙ্কের পাত্তা দিতে বললাম ফোন করে, নেটে পাঠিয়ে দেওয়া যায়।পারল না। ছেলে-পিলে-পোষ্য নিয়ে কী যে করছে ? এই সব। ভাবছি , করোনা-মাসি আমাদের অনেককে কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটি : সময়।একেবারে নিজের করে এতটা নিভৃত-নির্জন সময় এই দীর্ঘ জীবনের কখনও পাই নি। শুধু একবার কৌশানি গিয়ে সারাদিনের বৃষ্টি এইরকম কিছু সময় মিলিয়ে দিয়েছিল। তবে তখন বয়েস কম। ‘ শুধু দুজনে কুহু কুজনে ‘ । এই একাকী নির্জনতা একেবারেই অপরিচিত। কেমন একটা অমোঘ বিষন্নতা ঘিরে আছে। না না, কাব্য নয় ! চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ভূখা মানুষের মিছিল। কী অসহায় ! কী অসহ দুর্দশার রাহু গ্রাস করেছে সারা পৃথিবীর মানুষকে।একদল মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে কষ্টের বোঝা যদি কিছুটা লাঘব করা যায়। গর্ব হয়। আবার, অন্যদিকে শুনি কিছু মানুষ ত্রাণ সম্ভার লুট করার ধান্দায় মরিয়া। তবে, গ্রামের মানুষ তার প্রাপ্য কড়ায় গন্ডায় মেপে নিতে তৎপর। খুশী লাগে। ভাবি মনুষ্যত্বের মূল্যবোধগুলি পাল্টে যাবার সন্ধিক্ষণ কি এসে গেল? সেই বিপন্নতার অগ্রদূতের বাহন কি এই করোনা?
দেখছি তো, কোনো কোনো চিন্তাবিদ বলছেন অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কিছু একটা ব্যাপার আছেই। নইলে বেশী দিন নয়,
অধুনা কালে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রনেতাদের চিন্তার মধ্যে একটা অস্বস্তিকর অস্থিরতা,চিন্তা ও বোধের অবনমনের, একটা বিপরীত ধ্যানের প্রবাহ লক্ষ্য করা গেছে, সব দেশে, একথা কি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় ? কিছুটা বোঝা, কিছুটা অজানা। দারিদ্রসীমার মাপকাঠি যে পাল্টে যাবার চিহ্ন ফুটে উঠেছে সেকথা বলাই যায়। কতদিন পিছিয়ে গেল পৃথিবীর প্রচলিত পরিচিত নীতিগুলি নিজেদের কক্ষপথ থেকে, একে একে। ফিরে আসতে কতদিন লাগবে? আদৌ ফিরে আসে কি? নাকি প্রকৃতি ডেকে আনছে এক নীরব অথচ অমোঘ বিপ্লব !
কানে এলো পাশের বাড়ির এক জানালার গলা।
‘ পরী,ও পরী ! শোনো না মুখটা একটু বাইরে কর তোমার বারান্দায়।’ পরীর আওয়াজও শোনা গেল,’ কেন রে, কী হয়েছে? ‘ জানালায় গানের কলি, ‘ ভেঙে মোর ঘরের চাবি , নিয়ে যাবি কে আমারে?’ সুমিতা ছদ্ম রাগে বাজলো,
‘ আহা হা, কী হয়েছে বলো না সুমিতা, হাতে কাজ আছেতো নাকি।’ ওহ্ আগের জানালায় তা হলে সুমিতা।সবে বিয়ে হয়ে এসেছে এপাড়ায়, খুব মিশুকে। সবে ব্রেকফাস্ট শেষ হয়েছে এদের। পড়ে পাওয়া ছুটির লাঞ্চের ফাঁকে করোনা-আড্ডার মত মুখোরোচক আর কী হতে পারে।।
পরী বললো,’ শুনিস নি ? লকডাউন উঠে যাচ্ছে। এ তো কী সব ঘেঁটে ঘুটে বললো, মোদী নাকি লকডাউনের নিয়মকানুন পাল্টেছে।এবার থেকে ২০ শে এপ্রিলের আগের অবস্থার আরও একটু ঢিলে দেবে।’ সুমিতা শুধলো ‘ কেমন ঢিলে লকডাউন তো আর উঠে যাচ্ছে না! হ্যারে, শপিং মলে যেতে পারব ?’ ব্যগ্র প্রশ্ন।পরী বললো চোখ মটকে,’ উঃ, কী সখ ! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি? দাঁড়া, ওকে ডাকি। সব বলে দেবে।’
সুবোধ পরীর বর, এসে দাঁড়িয়েছে জানালায়। ‘না না সুমিতা, শপিং মল বা কম্প্লেক্স তো খুলবে না। তবে ধাপে ধাপে ওটাও হবে।চিন্তা কোরোনা।কেন্দ্রীয় সরকারের অর্ডারে সব পরিস্কার বলেছে।এর মধ্যে অন্যান্য জানালায় আরও কেউ কেউ মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে। সুবোধ উৎসাহিত। বলে চলে। – সব দোকান পাট, ছোটো বড়, খুলে যাবে।পৌরসভা বাজারে সব দোকান, জরুরি বা মামুলি,সব খোলা হবে।পাড়ার যে কোনো দোকান।অবশ্য অর্ধেক কর্মী নিয়ে চালাতে হবে। কিন্তু তাই ব’লে হুঁ হুঁ, মদের দোকান, বিউটি পার্লার বা চুল কাটার সেলুন কিন্তু খুলবেনা।কিন্তু যাই হোক বাজার দোকান-পাটে যারা কাজ করবেন বা ক্রেতারা মাস্ক পরা ও দূরত্ব বজায় রাখার যে নিয়ম আছে সেটা পুরো মেনে
চলবেন।’ সুবোধ দম ফেলার আগেই কোনো জানালার প্রশ্ন ভেসে আসে, ‘ আচ্ছা সুবোধদা, গাড়ী নিয়ে বেড়নো যাবে ?’ উল্টে ঝামটা,’ কত সুখ! শোনো, গাড়ি- ঘোড়ার মধ্যে যাত্রী ট্রেন, অটো , ক্যাব, ট্যাক্সির মত সব যেমন বন্ধ আছে তেমনি বন্ধ। অবশ্য শর্ত বজায় রেখে প্রাইভেটে চার চাকা ড্রাইভার ছাড়া আর দুজন, আর ,২ চাকার গাড়িতে কেবল ১ জন যাতায়াত করতে পারবে। তবে পণ্য-পরিবহনের গাড়ি ছাড়, ট্রেন বা ট্রাক বা বিমানে।জানালায় হতাশা। ‘যাহ্। তাহলে বিমলা, সুলতারা আসতে পারবে না ?’
সুবোধের বড় ছেলে এসে বাবার পেছনে দাঁড়িয়েছে কখন।সে বললো,’ আমাদের আই টি অফিস খুলবে। তবে অর্ধেক কর্মী নিয়ে। দেখি আমার ডিউটি কবে পড়ে। কিন্তু বাস চলবে কিনা তা তো কিছু বলে নি। আমার বাইকটা তো খারাপ হয়ে পড়ে আছে।’ওর বাবা বলল,’ দ্যাখ গ্যারেজ খোলা থাকতেও পারে, মনে হচ্ছে।’
সুবোধের ছোট ছেলে অমল এতক্ষণ শুনছিল।এবার বলে উঠলো,’ হুঁ, আমি এবার কুলি সেজে মাল বইবার কাজে লাগব। ট্রাকে করে উঠে যেখানে দরকার নেমে যাব।’ ওর দাদা মারল মাথায় এক চাঁটি : দু’নম্বরি শেখা হচ্ছে পাড়ায়। যা না ! পুলিশ দেবে ধরে আচ্ছামত।’ অমল বাবার দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায়।
অমলের ঠাকুমার গলা শোনা গেল।’ এবার কি করোনাসুরগুলো সব উধাও হয়ে যাবে নাকি? যাও না, বাইরে যাও, সব ঘাপটি মেরে বসে আছে। বেড়োলেই ঘ্যাক করে ধরবে।’ পরীর মনে পড়লো কোথায় যেন পড়েছিল কোনো বিজ্ঞানী বলেছেন সামনের শীতে করোনার প্রকোপ আরো অনেক গুণ বাড়বে। ভ্যাকসিন তৈরী জরুরি বোঝাতে এই কথা উঠে এসেছে।
রীতা একটু আধটু লেখে টেখে। বয়েস সবার চেয়ে কম বলে অমলের সাথে খুব ভাব।বলে : ‘করোনাসুরগুলো এবার কোথায় যাবে?’ অমল হিহি করে হেসে উঠলো:’ কাকী ওদের তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। আদর করে পুষে রেখো।’ রীতাও হাসছে।
পরী ওর নিজের ভাবনায়। বলে : ‘ এবার তাহলে বিমলা,সুলতারা চলে আসতে পারবে,বল সুমিতা! ‘ সুমিতার গান পায়,” ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে?’ পরী বলে ,’ ওরা যা চালু, ঠিক মালের গাড়িতে উঠে চলে আসবে , দেখিস !’
সুবোধ সরে আসছিল। পরী বলে উঠলো,’ হ্যাগো ! লকডাউন তো থাকছেই, না? শুধু একটু আলগা হবে এই যা!’ সুবোধ জানাল চলে যেতে যেতে,’ তাই তো বলছে।’পরী ছেলেকে বোঝায়,’ হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার লাগানো মুখোশ পড়া, সব কিন্তু যেমন চলছে চালিয়ে যাবে। একটুও ঢিলে দেবে না।’ অমল মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো:’ আচ্ছা মা ! তুমি মুখোশ বলছ কেন, মাস্ক বলতে পার না !’ পরী ছেলের দিকে চেয়ে হেসে ভাবল, ‘ আমার ছোট্টোছেলেটাও বড় হয়ে যাচ্ছে !’
আমি ভাবি, মানুষ কত সহজেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চায়। সময়ের সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে ভাবে এবার তীরে পৌঁছে যাবে। কখন যে সন্ধ্যা নেমে আসে খেয়াল থাকেনা।এই তো পূজো এল,গেল। করোনা ভাইরাস তখন কোথায় ছিল? কে যেন বলে, ‘ সব প্রশ্নের কি জবাব হয়?’