দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO)এর রিপোর্ট ও আজকের পৃথিবী


মিতা দত্ত:চিন্তন নিউজ:৩০শে মে:- ” শুধু করোনা নয়, আদতে ভাইরাসের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ওপর বসে রয়েছে মানুষ। যে কোন মুহূর্তে তার বিস্ফোরণ হতে পারে। জানাচ্ছেন বিজ্ঞানী – গবেষকরা। তাঁরা বলছেন, মানুষের স্বাস্থ্যকে অন্য প্রাণী জগত বা সামগ্রিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সময় চলে গিয়েছে। বরং এই চারটি বিন্দুর মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে না পারলে ভবিষ্যতে ভাইরাস সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।” WHO- এর বিজ্ঞানীদের এই রিপোর্টটি গতকাল আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়। যার মানে মানুষের স্বাস্থ্যকে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না। এর আগে ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে একই কথা বলা হয়েছে।

এখানে এটাই বলার চেষ্টা করা হয়েছে, প্রকৃতির মধ্যে গাছপালা, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসসহ মানুষকে সহনাগরিক হিসেবে দেখতে হবে। প্রত্যেকের ক্ষেত্রকে সম্মান দিয়ে চলতে হবে। প্রকৃতির উপর ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানা কোনোটিই চলবে না। জমিকে প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। মানুষ, প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদজগৎকে ‘ওয়ান হেলথ’ নীতির মাধ্যমে দেখতে হবে। তাহলেই রোগকে চিহ্নিত করা যাবে এবং সংক্রমণের শুরুতেই আটকানো যাবে। না হলে বন্য জন্তুর মধ্যে এরকম আরও অনেক করোনাভাইরাস রয়েছে, যেগুলির থেকে যেকোনো সময় বড় ধরনের সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এটাই আজকের বিজ্ঞানীদের অভিমত। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, গত চার দশকের সার্স – কোভ, মার্স, এভিয়ান ফ্লু, কেরলের নিপা ভাইরাস সার্স – কোভ-2 সবই প্রানীবাহিত রোগ। সংক্রমণের প্রথম ধাপে সংশ্লিষ্ট ভাইরাসকে চিহ্নিত করার ব্যর্থতাই – সংক্রমণের মাত্রা বাড়িয়েছে। আজকে আমাদের জানা মাত্র ২৬০ টি-ভাইরাস কিন্তু আছে দশ লক্ষ ভাইরাস। ভাইরাস জানার পথে প্রতিবন্ধকতা কি? Human Genome Project(HGP) একটি আন্তর্জাতিক গবেষণার সংগঠন হিসাবে গড়ে উঠেছিল, লক্ষ্য ছিল – “determining the base pairs that make up human DNA, and of identifying and mapping all the genes of the human genome.” উদ্দেশ্য পরিষ্কার – মানুষের শরীরে অবস্থিত একটি জিনের ম্যাপ তৈরি করা। 1984 সালে মার্কিন সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়। 1990 সালে কাজ শুরু হয়। 14এপ্রিল 2003 সালে এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়, কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে বলে। প্রথমে এর অর্থ সরবরাহ করেছিল মার্কিন সরকার ” National Institute of Health ” (NIH) এর মাধ্যমে, এছাড়াও পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হয় সরকারের বাইরে। যেমন ‘Celera Corporation’ কাজ শুরু করেছিল 1998 সালে। পাশাপাশি কুড়িটি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগার সহ মার্কিন দেশ, ব্রিটেন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি এবং চীন এই কাজে নিয়োজিত হল। আজকে WHO-র বিজ্ঞানীরা যে কথা বলছেন সেটাকে বুঝতে গেলে – শুধু মানুষের নয় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর, ব্যাকটেরিয়ার ও ভাইরাসের আরএনএ, ডিএনএ -র সিকোয়েন্স গুলিও জানা দরকার। তাহলে কাজটি আটকে গেল কেন? তার মূল কারণ এই ফলটিকে যখনই ব্যবসায়ীকরণ করতে যাওয়া হলো। প্রথম থেকেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে দুটি ভাগ ছিল। একদল আত্মত্যাগ করেছিল গবেষণাটিকে পৃথিবীর মানুষের জন্য এগিয়ে নিয়ে যেতে, আর একদল তাদের কর্পোরেট পার্টনারদের স্বার্থ এর দ্বারা কিভাবে লাভবান হবে সেটাই এগিয়ে নিয়ে গেছে। তাই তারা বারবার চেয়েছে কর্পোরেট পার্টনারদের স্বার্থে ডিএনএ-এর জিন সিকুয়েন্স গুলি পেটেন্ট করে নেওয়া। তারমানে সম্মিলিত প্রচেষ্টা কিন্তু ব্যক্তিগত ধান্দাবাজির জন্য ব্যর্থ হলো। Myriad genetics company যখন স্তন ক্যান্সারের দুটি জিন (BRCA1, BRCA2)পেটেন্ট করতে গেল তখনই একটা বিতর্ক সামনে এলো। দেখা গেল মার্কিন দেশের যে কম্পানি অর্থাৎ Myriad genetics পেটেন্ট করতে চাইছে সেটা আসলে তাদের আবিষ্কার নয়। সেটা আবিষ্কার করেছে Mike Stratton-এর নেতৃত্বে লন্ডনের ‘Institute of cancer research’ -র ল্যাব। আসলে myriad genetics research- এর যে lab Utah তে আছে তার নেতৃত্বে ছিল Mark skolnick, তিনি কিন্তু এটা আবিষ্কার করেন নি। দুটি lab একসাথে কাজ করলেও, যখনই আলাদা করে
Myrid genetics পেটেন্ট করতে গেল কার্যত সহযোগিতাকে অসম্মান করে তখনই সমস্যাটি হল। এবার মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রায় দিলো মানুষের ডিএনএ একটি প্রাকৃতিক সম্পদ এর উপরে পেটেন্ট করা যাবে না। তখনই সমস্ত কর্পোরেট সংস্থা উৎসাহ হারায় এবং জিনোম প্রজেক্ট ভেঙে যায়। অথচ দেখা যাচ্ছে এই ধরনের বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা ছাড়া আজকে ১০ লক্ষ ভাইরাস ও প্রকৃতিকে জানা সম্ভব নয়। যখন জিনোম প্রজেক্টের চেয়ে আরও বড় সহযোগিতামূলক প্রজেক্ট এর দরকার ছিল তখনই ভেঙে দেওয়া হলো কর্পোরেটদের স্বার্থে। কারণ ডিএনএ-এর উপর দখলদারি রাখতে পারবে না করপোরেটরা।
এবার ভাবুন লকডাউনকে কাজে লাগিয়ে সরকার সমস্ত সরকারি শিল্প, খনিজ অঞ্চল ও বনাঞ্চলকে চৈত্রসেলের দরে কর্পোরেটদের বিক্রি করে দিল। পাশাপাশি মানুষ ও প্রকৃতিকে যথেচ্ছ শোষণের জন্য সমস্ত আইনের থেকে কর্পোরেটদের ছাড় দিয়ে দেওয়া হলো। এর ভিতর দিয়ে মানুষকে ভাইরাসের আগ্নেয়গিরির ওপর ছুড়ে ফেলে দিল সরকার। এখনো কি মানুষের ঘুম ভাঙ্গবে না, এখনো কি ভাবার সময় হয়নি?


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।