দেশ বিদেশ

কোভিড মহামারীর দমন নীতিতে তৃতীয় প্লেগের প্রতিচ্ছবি।।


চৈতালি নন্দী: চিন্তন নিউজ:৩রা জুন:- উনিশ শতকের শেষ ভাগে একান্ত বাধ‍্য হয়েই ১৮৯৭ সালে ভারতে রচিত হয়েছিল মহামারী আইনটি। ইউরোপীয় ভাষায় সেটি ছিল তৃতীয় প্লেগ অতিমারী। সম্ভবত চীনের বাণিজ‍্য জাহাজ থেকেই ইঁদুরের মাধ‍্যমে তা এসে পৌঁছোয় তৎকালীন বম্বে বন্দরে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন‍্য শহরগুলোতে। কমবেশী ২৫ বছরের মধ‍্যেই প্লেগ মহামারী প্রাণ নিয়েছিল এক কোটি মানুষের।

বণিকরাজ ব্রিটিশ শাসকদের কাছে ভারতবাসীর প্রাণের চেয়েও বাণিজ‍্যের অগ্রাধিকার অনেক বেশী থাকায় তারা বাণিজ‍্য জাহাজ আটকানোর চেষ্টা করেনি। তার ফলে প্লেগ-মহামারীটি অতিদ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। এই সময়েই ত্বড়িৎ গতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ও গৃহীত হয় ‘এপিডেমিক ডিজিজ এ্যাক্ট অব ১৮৯৭। এই আইনে শাসক ও শাসকশ্রেণী পায় যথেচ্ছাচারের অবাধ স্বাধীনতা। বর্তমান অতিমারীর মতো দূরত্ব বজায় থেকে মেলামেশার ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছিল চরম দমননীতি। কিন্তু সেই ব‍্যবস্থা আইনী সীলমোহর পাওয়ার ফলে তা বাস্তবায়িত করতে শাসকশ্রেণী পেয়েছিল দমনপীড়নের অবাধ স্বাধীনতা। কিন্তু বর্তমানে সময় অনেকটা এগিয়ে গেছে, বেড়েছে শিক্ষা ও মানুষের সচেতনতা। ফলে সেযুগের মতো দমননীতি চালানো এখন সার্বভৌম রাষ্ট্রে আর সম্ভব নয়।

জাতিগত ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্তমানে রোগ ছড়ানোর দায়ভার বারে বারে চাপানো হচ্ছে সংখ‍্যালঘু, দলিত এবং অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর কাঁধে। যদিও তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। বলপূর্বক রোগীকে তুলে নিয়ে যাওয়া, পৃথকীকরণ, নিকটজনেদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তাদের রোগী হিসেবে দেগে দেওয়া থেকে বিভিন্ন বিভেদমূলক আচরণ এখনো হচ্ছে, তখনও হোতো। মৃত‍্যুর পর অথবা অসুস্থ অবস্থায় রোগীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এখনও।
যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটেছে
প্রতিক্রিয়ার ধরণে। বাল গঙ্গাধর তিলকের ‘কেশরী’ সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ভিনজাতের হাতে মৃতদেহের ব‍্যবচ্ছেদেও ছিল চরম ক্ষোভ। শূদ্রের ছোঁয়া খাবার-এ ছিল প্রবল আপত্তি। বিশেষতঃ ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে ইঁদুর মারাতেও ছিল আপত্তি। যদিও পরিস্থিতি পাল্টেছে তবুও হিন্দত্বের ধ্বজাধারীরা পিছনে টানছে আমাদের শিক্ষা ,রুচি ও সংস্কৃতিকে।

সেসময় শাসকশ্রেণীর বলপ্রয়োগের ফলে বেড়েছিল বিক্ষোভ, বাসস্থান ভেঙে দেবার প্রতিবাদে শ্রমিকরা দুবার ধর্মঘটে সামিল হন। আজ ভারতের মত স্বাধীন দেশে সুরক্ষা নেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের। সাধারণ মানুষকে বাধ‍্য করা হচ্ছে কোয়ারান্টাইন নামক নরককুন্ডে থাকতে, যেখানে রোগী ও মৃতদেহের সহাবস্থান। পরিযায়ী নামধারী দেশীয় শ্রমিকরা, যারা কাজের খোঁজে গিয়েছিল ভিনরাজ‍্যে তাদের মর্মান্তিক পরিণতি মনে করিয়ে দিচ্ছে পরাধীনতার যুগের বৃটিশ শাসকদের অবাধ দমনপীড়নের কথা, যা ভারতের স্বাধীনতার লজ্জা, মনুষ‍্যত্বের অপমান।

ঔপনিবেশিক যুগে সমাজের যে অংশ অতিমারীর শিকার হয়েছিল, বর্তমান অতিমারীতেও তারাই মূলত ভুক্তভোগী।সেটা সাধারণের পক্ষে আদৌ সুখকর নয়। যদিও সেসময় ছিল ঔপনিবেশিক যুগ আর এখন ভারত সার্বভৌম রাষ্ট্র ,তবুও শাসক ও শাসিতের তফাৎ খুব একটা চোখে পড়েনা। শাসক ও শোষিতের অবস্থান প্রায় অপরিবর্তিত।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।