প্রতিবেদনে তুলসী কুমার সিনহা: চিন্তন নিউজ:২২শে আগস্ট:– “কে বলিবে এ ব্রহ্মাণ্ড কার রচিত? কে জানে এ ব্রহ্মাণ্ড কী?
এই পরিদৃশ্যমান অনন্ত জগৎ সীমাহীন, পরিধিহীন অনন্ত
আকাশে অনন্তকাল ভ্রাম্যমান—কে আমাকে বলিবে উহা কী ?
প্রাচীন বৈদান্তিক বলেছেন, ইহা মায়া; আধুনিক বৈজ্ঞানিক
বলেন, ইহা অজ্ঞেয়। বিজ্ঞান ও দর্শনের একমাত্র উত্তর আমি
জানি না—–রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী(”মহাশক্তি’ প্রবন্ধের কিছুটা অংশ)
বাংলা নবজাগরণের মর্মবাণী যে সকল মণীষীর মাধ্যমে বাঙালির মানসপটে প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁদের মধ্যে সাহিত্যিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী অন্যতম। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও দর্শনবিষয়ক প্রবন্ধ রচনার পথিকৃৎ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। ১৮৬৪ সালের ২২ আগস্ট, বাংলার ৫ই ভাদ্র পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দির জেমোতে তাঁর জন্ম। বাড়িতে তাঁর পিতা, পিতৃব্য, পিতামহ সকলেই শিক্ষানুরাগী ছিলেন। ফলে শৈশব থেকেই তিনি বঙ্গদর্শন, আর্য্যদর্শন, নবজীবন, ভারতী, সাধনা প্রভৃতি পত্রিকার দেখা পেয়েছেন। আর তাই লেখালেখির প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রবল ছিল। নবজীবন পত্রিকায় ‘মহাশক্তি’ নামে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে তার লেখক জীবনের যাত্রা শুরু। এরপর দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, পরিভাষা এবং প্রধানত বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা ছিল তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল।
রামেন্দ্রসুন্দরের শিক্ষাজীবন ছিল অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ। প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি অসাধারণ ফলাফল অর্জন করেন।১৮৮২সালে তিনি কান্দি ইংরেজি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ , ১৮৮৬ সালে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্রে অনার্সসহ বিএ পাশ করেন। এরপর পদার্থবিদ্যায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৮৮ সালে তিনি প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি অর্জন করেন। সাধনা, নবজীবন ও ভারতী পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশের মধ্য দিয়ে রামেন্দ্রসুন্দরের সাহিত্যিক জীবনের সূচনা হয়। তিনি ১৮৯৪সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করার পর রামেন্দ্রসুন্দর ১৮৯২ সালে কলকাতা রিপন কলেজের বিজ্ঞান শাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং ১৯০৩ সালে কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ পদেই কর্মরত ছিলেন।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সম্পর্কে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলেন –
“যৌবনের প্রারম্ভেই তুমি যেরূপ বিদ্যাবত্তা ও গুণবত্তা প্রকাশ করিয়াছিলে, তুমি যে পথেই যাইতে, তাহাতেই প্রভূত ধন-সম্পদ ও যশঃ উপার্জন করিতে পারিতে, কিন্তু তুমি সে সকল পদই ত্যাগ করিয়া দারিদ্র্যমণ্ডিত অধ্যাপনা ও মাতৃভাষার সেবাই জীবনের ব্রত করিয়াছ এবং আত্মত্যাগ ও আদর্শ চরিত্রের পরমোজ্জ্বল ও মহিমময় দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছ। তুমি বিজ্ঞানকে স্বর্গ হইতে মর্ত্ত্যে নামাইয়া আনিয়াছ এবং যাঁহারা বিজ্ঞানজ্যোতিঃ বিকীর্ণ করিয়া দেশের অশেষ কল্যাণ সাধন করিয়াছেন, তাঁহাদের একজন অগ্রণী হইয়াছ।”
রামেন্দ্রসুন্দর ছিলেন একজন উগ্র স্বদেশপ্রেমিক এবং জাতিভেদ প্রথার বিরোধী। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় সে বছর তাঁর আহবানে একদিন সমগ্র বাংলাদেশে অরন্ধন দিবস পালিত হয়। বঙ্গভঙ্গের বিরোধী প্রতিক্রিয়ায় এ সময় তিনি রচনা করেন বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা গ্রন্থখানি।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী চিন্তায় ছিলেন দার্শনিক, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ছিলেন বৈজ্ঞানিক আর এই দুইয়ের প্রকাশ ঘটাতেন সৌন্দর্যময় সাহিত্যরচনা শিল্পের নিপুণ কারুকার্যে। তাঁর প্রতিটি রচনা প্রাঞ্জল ভাষায় কৌতুকরসে জারিত ও তাত্ত্বিক যুক্তিতে শাণিত। রচনার সৃজনশীলতা ও উপস্থাপনের মৌলিকত্বের কারণে তিনি সকল শ্রেণীর পাঠকের কাছে ছিলেন সমানভাবে সমাদৃত। ১৯১৯সালের ৬ই জুন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রয়াত হন। আজ প্রণম্য ব্যক্তির জন্মদিবসে চিন্তনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।