গৌরী সেনগুপ্ত, চিন্তন নিউজ, ২২ আগষ্ট: ২১১ নং কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে এক ভাদ্রোৎসবের অনুষ্ঠানে তাঁর প্রথম রবীন্দ্রনাথ দর্শন। অসুস্থ কবিকণ্ঠে ব্রহ্ম সংগীত শুনলেন। তারপর থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ও গুণমুগ্ধ হন তিনি, তিনি হলেন দেবব্রত বিশ্বাস। কিশোরগঞ্জে রক্ষণশীল ব্রাহ্ম পরিবারে ১৯১১ সালে জন্ম হয় অত্যন্ত জনপ্রিয় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের। তাঁর নিজের কথায় তাঁর সংগীতগুরু কেউ ছিলেন না। বাড়ির বড়দের মুখে শিখেছিলেন ব্রহ্ম সংগীত। কিশোর বয়স থেকেই তাঁর অভ্যাস হয়েছিল এই ব্রহ্মসংগীত গাইবার। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসংগীত হল তাঁর প্রাণের সম্পদ।
পড়াশোনার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন ময়মনসিংহের কলেজ ছেড়ে। কলকাতায় এসে ব্রাহ্মসমাজের নানা সাংস্কৃতিক কাজকর্মে যুক্ত হন। এ ছাড়াও হিমাংশু দত্ত, শচীনদেব বর্মন, কে এল সাইগলের গান গাইতেন বিভিন্ন সভাসমিতি বা ঘরোয়া আড্ডায়। ১৯৩৩ এ ইকোনমিক্সে এম এ পাশ করে হিন্দুস্তান ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে চাকুরী করেন। এই হিন্দুস্তান ইনসিওরেন্স পরে জীবনবিমা নিগম নামে পরিচিতি লাভ করে। অবসর নিয়েছিলেন তিনি ঐখান থেকেই। ১৯৪৪ সালে বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। সম্পূর্ণ নিজস্ব স্টাইলে গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান। এই গায়কী নিয়ে বিশ্বভারতীর সঙ্গে তাঁর মতভেদ শুরু হয়। বন্ধ হয়ে যায় তাঁর গানের রেকর্ডিং। ১৯৭১ সালের পর থেকে তিনি আর রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ডিং করেননি। এই ঘটনা রবীন্দ্রসংগীতপ্রেমী শিক্ষিত মহলকে আঘাত করেছিল। যদিও এই স্বাধীনভাবে গান গাওয়ার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আলোচনা করেছিলেন “গলা তো তোমার এবং তোমার গলায় তুমি তো গোচর হবেই। তোমার ঢঙের সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, তোমার একটা নিজস্ব ঢঙ গড়ে উঠেছে, এটা তো খুব বাঞ্ছনীয়। তাই তোমার স্বকীয় ঢঙে ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ গাইলে যেভাবে, আমার সুরের গঠনভঙ্গি রেখে এক্সপ্রেশনের যে স্বাধীনতা তুমি নিলে, তাতে আমি সত্যিই খুশি হয়েছি। এ গান তুমি গ্রামাফোনে দিতে চাইছো, দিয়ো, আমার আপত্তি নেই। তোমার একথা আমিও স্বীকার করি যে, সুরকারের সুর বজায় রেখেও এক্সপ্রেশনে কমবেশি স্বাধীনতা চাইবার এক্তিয়ার গায়কের আছে।” কবির এহেন নির্দেশ সত্ত্বেও বিশ্বভারতী দেবব্রত বিশ্বাসের গানে ফতোয়া জারি করেছিল।
কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ৪৬ ধর্মতলা স্ট্রিটে কোন একটি বাড়ির ৪তলা ঘরে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সভা বসতো। সেইখানে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৯ এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোপনে পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজকর্ম করতেন তিনি। সেইসঙ্গে গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গ্রামে গঞ্জে গণসংগীত গাইতেন। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ, ৪৬এর দাঙ্গা, সেই পরিবেশে বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন‘ নাটক মঞ্চস্থ হয়। আবার দেবব্রত গণনাট্য সংঘের হয়ে ‘নবজীবনের গান’ গাইছেন , হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘মাউন্টব্যাটেন মঙ্গল কাব্য’ গাইছেন; ‘রক্তকরবী’তে অভিনয় ও গান করছেন।
দেবব্রত বিশ্বাস কখনও নীতিহীনতার সঙ্গে আপস করেননি। শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রেণিসংগ্রামে যে কোন প্রতিকুল অবস্থায় শিরদাঁড়া সোজা রেখে রবীন্দ্র সঙ্গীতকে ব্যবহার করতেন অপরিহার্যভাবে।
১৯৫৩ সালে তিনি ভারতীয় শান্তি কমিটির প্রতিনিধি রূপে চিন ভ্রমণ করেন, ১৯৫৮ সালে ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে পুনরায় চিন যান। তারপর তিনি বর্মায় অনুষ্ঠিত বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতির অনুষ্ঠানে অংশ নেন সংগীতশিল্পী হিসেবে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সংগীত অনুষ্ঠানে যোগ দেন। উপাচার্য দেবীপদ ভট্টাচার্য এক জায়গায় লিখছেন “কলকাতায় আগত প্রজাতন্ত্রী চিনের প্রতিনিধি দলের প্রতি সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য একটি বড়ো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ‘সিনেট হল’-এ। সেই বিশাল সমাবেশে জর্জদা গেয়েছিলেন নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ যখন তিনি গাইলেন—লাথি মার্, ভাঙরে তালা যত সব বন্দীশালা আগুন জ্বালা মনে হচ্ছিল দুনিয়ার সব কারাগারের দরজা ভেঙে ভেঙে ঝরে পড়ছে ঝন্ ঝন্ করে। এ গান আমি বহু গায়কের বহুবার শুনেছি। কিন্তু জর্জদা সেদিন যা গেয়েছিলেন তা এক কথায় অবিস্মরণীয়।” দেবব্রত বিশ্বাস জর্জদা নামেই চেনে সংগীতজগৎ। তাঁকে পল রবসনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। রবসন নিগ্রো আধ্ম্যাতিকতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন, জর্জ চেয়েছিলেন ব্রাহ্ম রক্ষণশীলতা থেকে মুক্ত হতে।
দেবব্রত বিশ্বাস ৩০০ রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করেন। এছাড়া আরও অনেক অন্যান্য গানে সুরারোপ করে গান রেকর্ড করেন। বিভিন্ন ছায়াছবিতে গান করেছেন যা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবে তাঁর সংগীতক্ষেত্র ছিল রবীন্দ্রসংগীত। বাংলা সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন দেবব্রত বিশ্বাস ওরফে জর্জদা। রবীন্দ্র সংগীতের অবশ্যই একজন জনপ্রিয় শিল্পী। মানুষ হিসেবে তিনি ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব্। রবীন্দ্র সংগীতের মাধুর্য ও সম্ভ্রমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে তাঁর স্বকীয় বলিষ্ঠতায় শ্রোতার কাছে পরিবেশন করেছেন। তাই তিনি তাঁকে নিয়ে বিতর্ককে ছাড়িয়ে প্রকৃত জনমানসের শিল্পী হতে পেরেছিলেন। তিনি অবশ্যই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে একজন প্রতিবাদী শিল্পী ছিলেন। তাঁর এই মানসিকতা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তাকে সংগীতের মাধ্যমে মূর্ত করে তুলেছিলেন। তাই কালজয়ী হতে পেরেছে তাঁর গায়কী এবং তাঁর সংগীতের বিশিষ্টধারা।