দেশ রাজ্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ প্রেম


রঞ্জন মুখার্জী, চিন্তন নিউজ, ৯মে: রবীন্দ্রনাথ চিরদিনই সাধারণ মানুষের কবি হিসাবে পরিচিত হতে চাইতেন। তাই তিনি লিখেছিলেন “মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক, আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়। কবিকে সত্যি সত্যি খুব কাছের মানুষ বলে মনে হয়, যখন দেখি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কয়েকটি সংকটপূর্ণ মুহূর্তে তিনি কিভাবে কলম ছেড়ে পথে নেমে পড়েছিলেন দেশবাসীদের নেতৃত্ব দিতে, অনুপ্রাণিত করতে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দেশের পরাধীনতার গ্লানি কবিকে কতদূর ব্যাকুল ও বিচলিত করেছিল।

স্বাদেশিকতার সভা: জীবনস্মৃতিতে কবি লিখেছেন, জ্যোতি দাদার উদ্যোগে এক সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার নাম স্বাদেশিকতা সভা। শৈশবকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ এই স্বাদেশিকতা সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

হিন্দুমেলা: ১৮৬৭ তে ঠাকুরবাড়ির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দু মেলা। হিন্দু মেলায় দেশের স্তব গান, দেশানুরাগের কবিতা পাঠ, দেশীয় শিল্প ও ব্যায়াম প্রদর্শন ইত্যাদি হতো। কিশোর রবীন্দ্রনাথ প্রতি বছর বইমেলায় যোগ দিতেন, স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন এবং গান গাইতেন।

জাতীয় কংগ্রেস ও রবীন্দ্রনাথ: ২৮শে ডিসেম্বর ১৮৮৫, মুম্বাইতে শুরু হয়েছে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন। ২৪ বছরের যুবক রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ওই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। ১৮৮৬ তে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল কবি কন্ঠের গান দিয়ে। পরবর্তীকালেও কবি অনেক অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। যদিও জাতীয় কংগ্রেসের আবেদন – নিবেদনের নীতিকে বরাবরই তিনি ভিক্ষাবৃত্তি বলে মনে করতেন। তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কখনো ভিক্ষা করে পাওয়া যাবে না। তার জন্য দিতে হবে চরম মূল্য। সশস্ত্র বিপ্লবীদের প্রতি কবির ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। চরমপন্থীদের সঙ্গে ছিল তার অন্তরের যোগ। তাই রাজ দ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত লোকমান্য তিলকের জন্য বাংলা থেকে অর্থ সংগ্রহের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সুভাষ চন্দ্রের আপোষ বিরোধী মতবাদকে স্বীকৃতি জানাতে তাকেই দেশনায়কের পদে বরণ করে নিয়েছিলেন।

বঙ্গভঙ্গ ও রবীন্দ্রনাথ: ১৬ ই অক্টোবর ১৯০৫, এই দিন থেকেই সাম্রাজ্যবাদী বড়লাট লর্ড কার্জনের আদেশে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলো। এই দিনই বিকেলে এক বিশাল জনসমবেশ সংগঠিত হলো। যার পুরোভাগে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে গাইলেন “বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, তুমি কি এমনি শক্তিমান? আমাদের ভাঙ্গা গড়া তোমার হাতে, এমন অভিমান, তোমাদের এমনি অভিমান।” সমগ্র বাংলার অখন্ড প্রাণ সত্তাকে একসূত্রে গেঁথে দেওয়ার জন্য কবি রচনা করেছিলেন রাখি সংগীত: “বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পূণ্য হউক, পূণ্য হউক, পূণ্য হউক……।” বাস্তবিকই কবি সেদিন সারা বাংলায় এক অভাবনীয় প্রাণ সঞ্চার করে দিয়েছিলেন।

নাইটহুড বা স্যার উপাধি প্রত্যাখ্যান: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দমননীতি দিনদিন অসহ্য হয়ে উঠছিল। প্রতিবাদের ঢেউকে প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে পাস করানো হলো রাওলাট আইন। অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে ঘটে গেল জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড- ১৩ ই এপ্রিল, ১৯১৯। বেশ কিছুদিন তিনি শুধু ছটফট করে বেড়াতে লাগলেন। অবশেষে ৩০শে মে তারিখে সারারাত জেগে একটি চিঠি লিখলেন বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডকে। ওই চিঠিতেই কবি জানিয়ে দিলেন যে, জালিয়ানওয়ালাবাগের অমানবিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড উপাধি প্রত্যাখ্যান করলেন।

মৃত্যুশয্যা থেকে মিস রাথ বোনের অপমানকর খোলা চিঠির জবাব: কবির জীবনের শেষ জন্মদিন ১৩৪৮ এর ২৫শে বৈশাখ। কবি গুরুতর অসুস্থ। ওই সময় ভারতবাসী মাত্রই কবির জন্য দারুন উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। এমন সময় বজ্রপাতের মত এলো ইংরেজ মহিলা রাথবোনের অপমানকর খোলা চিঠি। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল, ভারতবাসী ইংরেজদের কাছ থেকে ইংরেজি শিক্ষা পেয়ে উন্নত হয়েছে অথচ আজ বিশ্বযুদ্ধে বিপন্ন ইংল্যান্ডকে তারা কোন রকম সহায়তা করছে না, যা অবশ্যই নিন্দনীয় কাজ। স্থির থাকতে পারলেন না কবি। গর্জে উঠলেন রোগ শয্যা থেকে। সেই দিনই অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস মারফত অপমানকর খোলা চিঠির প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়ে দিলেন। তিনি লিখলেন: “ইংরেজি ভাষা ও ব্রিটিশ শাসন ধারার যতটুকু পাশ্চাত্য শিক্ষা ধারার মহত্তম ঐতিহ্যের প্রতীক, তা থেকে অবশ্যই আমরা অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করেছি। তবে একথাও না বলে থাকতে পারছি না যে অন্য যে কোনো পাশ্চাত্য ভাষার মাধ্যমে আমরা পাশ্চাত্য শিক্ষা ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে পারতাম। কেউ কি অস্বীকার করতে পারেন যে ২০০ বছর ধরে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষকে শাসনের নামে শোষণ করেছে অনেক বেশি।”


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।