রাজনৈতিক

পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি গঠনের পটভূমিকা:- শ্বেতা চন্দ


চিন্তন নিউজ:৮ই মে :– পূর্বে ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। বিভিন্ন পর্যায়ের মধ‍্য দিয়ে সেই সমিতির ঐতিহ্য বহন করে চলেছে আজকের গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি।
আমাদের দেশে নারী প্রগতির আন্দোলন বিগত ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই শুরু হয়েছে। রাজা রামমোহন রায় , ঈশ্বর চন্দ্র বিদ‍্যাসাগরের মত মনীষীরা এই আন্দোলনের অগ্রণী ছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনেও মহিলারা যুক্ত ছিলেন। জাতীয় আন্দোলনে সব কটি ধারার সাথে মহিলারা যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তখন মহিলাদের উদ্যোগে কোন ব‍্যাপক মহিলা সংগঠন গড়ে ওঠেনি।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের উপর নেমে এল জাপানি বোমার আক্রমণ। রেঙ্গুন,মাদ্রাজ,সিংহল, চট্টগ্রাম নোয়াখালী, আসাম , মনিপুরের পর অবশেষে কলকাতায় শুরু হলো আক্রমন। এই সময় একদিকে জাপানি বোমার আক্রমন আর অন‍্য দিকে ব্রিটিশ সরকার আর মজুতদারদের চক্রান্তে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে ,দেশের মানুষকে রক্ষা করার তাগিদে দেশব‍্যাপী প্রচন্ড আলোড়ন শুরু হলো। গড়ে উঠলো জনরক্ষা কমিটি, আত্মরক্ষা কমিটি, রিলিফ কমিটি ।এই সময় গ্রাম ছেড়ে কাতারে -কাতারে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ কলকাতার ফুটপাতে এসে আশ্রয় নিল। খাবারের জন‍্য হাজার হাজার নারী ও শিশুর ক‍রুণ আর্তনাদে শহরের আকাশ বাতাস ভরে উঠলো। অসহায় অনাহার ক্লিষ্ট দেশবাসীকে বাঁচাবার জন‍্য মানুষ এগিয়ে এলো। এই প্রেক্ষাপটে বাঙলার মা-বোনেরা ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন‌।

বিভিন্ন ত্রাণের কাজের মধ‍্য দিয়ে প্রথমে গড়ে উঠলো কলকাতা জেলা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ।পরবর্তীতে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়লো এর কাজ ।পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালের ৭ এবং ৮ই মে কলকাতার ওভারটুন হলে প্রথম সম্মেলনের মধ‍্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। এই সমিতির প্রথম সভানেত্রী হলেন ইন্দিরা দেবী চৌধু্রাণী এবং সম্পাদিকা হন এলারীড।। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট সর্বনাশা দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে আমদের দেশের স্বাধীনতা হল। দেশভাগের ফলে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিও দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল।

সমিতির বৃহৎ সদস‍্য ও নেত্রীরা রয়ে গেলেন পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন জেলায় ।স্বাধীনতা পর দেশের জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা এল না ।ক্ষমতা এল দেশের পুজিপতি আর ভূস্বামীদের হাতে। তাই আবার নূতন করে জনগণের সংগ্রাম শুরু হলো। এই সংগ্রামের পথ বেয়ে এসেছিলো ১৯৪৯ সালের ২৭শে এপ্রিল‌। ঐ দিন বন্দি কমিউনিস্ট নেতাদের রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে স্বীকৃতির দাবি ও মুক্তির দাবিতে মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন লতিকা ,প্রতিভা , অমিয়া ,গীতা । তাঁরা আমাদের কাছে চিরদিন সংগ্রামী প্রেরনার উৎস হয়ে থাকবে।

১৯৫০ সালে এই প্রতিষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির নেতা কর্মীদের কারাগারে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে।। ১৯৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে এই মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ‍্য হয়। ১৯৫৯ সালে সংঠণের নামের ক্ষেত্রে আত্মরক্ষা শব্দটি বাদ দিয়ে পশ্চিম বঙ্গ মহিলা সমিতি নাম গ্রহণ করা হয়।পরবর্তীতে মতাদর্শগত পার্থক‍্যের কারণে সমিতির অভ‍্যন্তরেও মতানৈক‍্য দেখা দেয় ।। অবশেষে ১৯৭০ সা‌লে ত্রয়োদশ সম্মেলনে সমিতি ভাগ হয়ে যায়। সমিতির বড় অংশটি ১৯৭১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ গণ‌তান্ত্রিক মহিলা সমিতি নাম গ্রহণ করে এবং নূতন গঠণতন্ত্র গ্রহণ করে। গণতন্ত্র , সমান অধিকার, নারী মুক্তির আদর্শবাণী সম্বলিত পতাকা গ্রহণ করে এগিয়ে চলেছে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি ।অপর শাখাটি পূর্বতন নামেই চলেছে।

দুটি সংগঠণ আলাদা হলেও কোন বৈরিতার মনোভাব নেই। যৌথ কর্মসূচীর ভিত্তিতে পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে। অন‍্যান‍্য মহিলা সংগঠণও প্রগতিশীল স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠণগুলির সঙ্গে এক যোগে পশ্চিম বাঙলার গণতান্ত্রিক নির্ভরশীল শক্তি হিসাবে এই সংগঠণ কাজ করে চলেছে। সারা ভারতেও নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে।বর্তমানে সাম্প্রদায়িক চর্চা ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই সংগঠন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। গণতন্ত্র ,সমান অধিকার ও নারীমুক্তির জন‍্য লড়াই চলছে চলবে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।