বিদেশ রাজনৈতিক

জর্জ ফ্লয়েড…..


অমিতাভ সিং : চিন্তন নিউজ: ১লা জুন:- “আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। পা টা তুলুন। আহ্ অফিসার……. আপনি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন….. আহ্ আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না! মাম্মা মাম্মা!..” করুন আর্তি। বাঁচার আর্তি। ৯ মিনিট ধরে বলতে বলতে ছটফট করে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের পায়ের চাপে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। হ্যাঁ, এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা আপনি/আপনারা জানেন।

ঘটনাটি গত ২৫ মে, ২০২০, আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গ রাজ্যের মিনোপোলিশ শহরে ঘটে। বর্বরতার নিদর্শন, নারকীয়ভাবে। জর্জ ফ্লয়েড নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে সারা আমেরিকা উত্তাল হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার নারীপুরুষ পথে নেমে প্রতিবাদ করছে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা কেবল প্রতিবাদ করছে এমন নয়,অসংখ্য শ্বেতাঙ্গ মানুষ এই প্রতিবাদে অংশ গ্রহণ করছে। শুধু আমেরিকায় নয়, ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদে মুখর হয়ে মানুষ পথে নেমেছে। । শহরে আগুন জ্বলছে ভাঙচুর চলছে। বলা বাহুল্য জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের সাথে যে বিষয়টা উঠে এসেছে তা হল বর্ণপ্রথা। বর্ণবৈষম্য নতুন কিছু নয়। 

আমেরিকায় একটা সময় ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গরা চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করত। শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে মিশত না। এমনকি, শ্বেতাঙ্গ মানুষ বাসে উঠলে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে সিট ছেড়ে দিতে হতো, একই সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাবার খেত না। অতীতে বর্ণ বৈষম্য ছিল প্রকট। আপনারা জানেন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রই প্রথম মানুষ, যিনি আমেরিকায় কালো মানুষের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ শুরু করেন।

মূলত ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর আনুষ্ঠানিক সিভিল রাইটস মুভমেন্ট শুরু হয়। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে রোসা পার্কস নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। পার্কসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি অফিস থেকে বাসে করে ফেরার সময় আরেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান যাত্রীকে কেন নিজের আসন ছেড়ে দেননি। তখন মার্টিন লুথার কিং এবং সোসাইটির সবাই মিলে এর প্রতিবাদ স্বরূপ আন্দোলন শুরু করেন। বাস সার্ভিস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন, কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ নিজের গাড়ি চালিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে থাকেন।

এই আন্দোলন অনেক দিন চলার পর অ্যালাবামা রাজ্যে যানবাহনে শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গদের ভেদাভেদকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসির লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক মুক্তি, চাকরির ক্ষেত্রসহ সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের দাবিতে এক বিশাল সমাবেশ করেন। এই সমাবেশ ছিল আমেরিকার ইতিহাসে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ। ওয়াশিংটন থেকে লিঙ্কন মেমোরিয়াল পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ মানুষের উপস্থিতিতে তাঁর দেওয়া বিখ্যাত ভাষণ ‘অ্যাই হেভ অ্যা ড্রিম’—জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক স্মরণীয় ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি তাঁর ভাষণে তুলে ধরেন কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণ, বিদ্বেষ, নির্যাতনের কথা। বলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো প্রাপ্তি নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত কালোরা নির্যাতনের শিকার হবে, হোটেলে থাকার অধিকার না পাবে, কেবল শ্বেতাঙ্গদের জন্য—‘এমন সাইন বোর্ড থাকবে’।

আমি জানি, আজ বা কাল আমাদের সময় সংকটময়। তবুও আমি স্বপ্ন দেখি, এ জাতি জাগ্রত হবে, মানুষের বিশ্বাসের মূল্যায়ন হবে। জাতিগত বৈষম্যের অবসান হবে। সব মানুষ জন্মসূত্রে সমান। আলোড়ন তোলা ‘আই হেভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণের প্রভাবেই ১৯৬৪ সালে আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়।

ফিরে আসা যাক, যেদিন জর্জ ফ্লয়েডকে পায়ে পিষে হত্যা করা হচ্ছে, সেদিন আমেরিকায় করোনাভাইরাসে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা এক লক্ষ পূর্ণ হয়েছে।করোনাভাইরাসে মৃত্যুর কারণে মানুষ পথে নামেনি কোনও দিন। কিন্তু সেদিন লকডাউন কার্ফু সব বাধা ভেঙে, মাস্ক খুলে ফেলে দিয়ে, সামাজিক দূরত্ব দূর করে দিয়ে, করোনা ভয়কে তুচ্ছ করে পথে নেমে এসেছে প্রতিবাদী মানুষ কেবল মাত্র একজন মানুষের মৃত্যুর জন্যে।কারণ করোনাভাইরাসে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুতে শোক আছে, দুঃখ আছে কিন্তু অপমান নেই। অপমান আছে জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করার মধ্যে। কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার নৃশংসতা নয় শুধু, তাঁকে মানুষ হিসাবে গণ্য না করার মধ্যে নিহিত আছে প্রতিবাদের বীজ। তথাকথিত পৃথিবীর সব থেকে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন জঘন্য ঘটনা নিয়ে ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছে গোটা বিশ্বে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদীজির প্রিয় বন্ধু আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প সাহেব জনগনের বিক্ষোভের কারনে বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন।

বলতে কোন দ্বিমত থাকার কথা নয় যে, আমাদের সভ্যতায় আদিম যুগের কিছু বর্বরতা এখনও আমরা লুকিয়ে রেখেছি, প্রতিহিংসা মূলক বিকারগ্রস্ত মানসিকতা সযত্নে মনের মধ্যে পোষণ করে চলেছি। সেই পাশবিক চিন্তা আমরা এখনও প্রয়োগ করে চলেছি। তাই ধর্ম বর্ণ ভাষা খাদ্যাভ্যাস পোষাক মতাদর্শ এমন হাজারো ছুতোয় আমরা পিটিয়ে পিষে মানুষ মারতে দ্বিধা করি না ।

করোনাভাইরাসে,কলেরায়, বন্যায়, ঝড়ঝঞ্ছায়, ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে , কিন্তু নির্যাতন খুন ধর্ষণ হয় মানুষের নৈতিক অধঃপতনের কারণে। অখ্যাত অবহেলিত জর্জ ফ্লয়েডরা মাঝে মাঝে দেশে দেশে শহিদ হয়ে দেখিয়ে দিয়ে যান মানুষ ধর্মবিদ্বেষ বা বর্ণবিদ্বেষের কবলে পড়ে মনুষ্যত্ব হারিয়ে কতটা পশুত্ব অর্জন করেছে। লেখা শেষ করার আগে একটা প্রশ্ন রেখে যাচ্ছি, ৫৬” ছাতির বন্ধু আজ জনগনের তারা খেয়ে বাঙ্কারে আশ্রয় নিলো। ভারতে কবে ?

তথ্য সংগ্রহ/সূত্র :- দূর পরবাস – লেখক এম আর ফারজানা, মার্কিন বৈসম্যের ইতিহাস, মার্টিন লুথার কিংয়ের জীবনী ও অন্যান্য পুস্তক।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।