কলমের খোঁচা

মুক্তবুদ্ধির উপাসক কাজী মোতাহার হোসেন – গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ:১৪ই অক্টোবর:–বাংলার দ্বিতীয় জাগরণের অন্যতম অগ্রপথিক কাজী মোতাহার হোসেনের জন্ম অবিভক্ত নদীয়া জেলার কুমারখালী থানা লক্ষ্মীপুর গ্রামে তাঁর মামার বাড়িতে ১৮৯৭ সালের ৩০ শে জুলাই। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে ।এই পাংশায়( বর্তমানে রাজবাড়ি জেলা) ছিল দ্বিতীয় জাগরণের অন্যতম অগ্রপথিক মনীষী কাজী আবদুল ওদুদের জন্মস্থান।
মোতাহার হোসেনের পিতা কাজী মগহরউদ্দিন আহমেদ ছিলেন সেটেলমেন্টের আমিন ।মা তাসিরুন্নেসা ছিলেন ধর্মপ্রাণ অথচ অত্যন্ত মুক্ত মনের মানুষ ।মোতাহার হোসেন তাঁর শৈশবের স্মৃতি চারণাতে বলছেন ” আমার বয়স তখন ৩, ৪ বছর হবে। একবার নৌকায় করে মায়ের সঙ্গে মামা বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাচ্ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন বাপজান এবং বড় মামু ।মামাবাড়ি কুমারখালী খোকশার মাঝামাঝি তৎকালীন থানার অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর গ্রামে ।গোড়ই( গড়াই নদী, অন্নদাশঙ্করের ছড়া,’ যতোকাল রবে গৌরী মেঘনা বহমান’ এর গড়াই) নদীর উত্তর দিকে ২, ৩ মাইল দূরে আর আমাদের বাড়ী পাংশা থানার অন্তর্গত বাগমারা গ্রামে।

পদ্মা নদী থেকে আধ মাইল উত্তরে আর খোকসা রেলস্টেশন থেকে সাত মাইল দক্ষিণে ।গোড়ই দিয়ে আসবার সময় গোড়ই ব্রিজ টা আমার কাছে অতি সুন্দর ছবির মত মনে হয়েছিল। ওর ফুকটের ভিতর দিয়ে যখন নৌকা টা চলে গেল, তখন আরও অবাক হয়ে গেলাম ।এই ফুকট টা কত বড় আর কত সুন্দর ।এই যাত্রাতেই গোড় ই রব্রিজ পার হবার ২, ১ মাইল আগেই আর একটা আশ্চর্য জিনিস দেখেছিলাম । সে কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। আমাদের নৌকো থেকে দশ বারো হাত দূর দিয়ে একটা সাপের গলা ও মাথা চলে যেতে দেখলাম। গলাটা খুব মোটা, বড়ো বাঁশের চেয়েও আর একটু মোটা। মাথার ফনাটা টা আরো একটু চওড়া ।রং হলদে। ফনার কাছে হলুদ বরণ টা একটু ফিকে। আমার কাছে দৃশ্যটা বেশ ভালই লাগলো। কিন্তু মাঝিদের আতঙ্ক আর বাপজান যেমন আচমকা আমাকে বুকের সাথে সেঁটে রাখলেন ।মামু কাছে ঘেষে আমার গায়ে হাত দিয়ে রইলেন ।তাতে এবং এদের মুখের উদ্বিগ্ন ভাব দেখে আমারও মনে ভয় হলো। কিছুক্ষণ পরে সাপটা ডুব দিল তখন মাঝিরা আল্লাহ ধ্বনি দিল। আর কত বড় একটা বিপদ কেটে গেল তার জন্য আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। পরে শুনলাম ,ওই সাপ নাকি ইচ্ছে করলেই লেজের ঝাপটা দিয়ে নৌকো তল করে দিতে পারতো ।”( সাম্পান পত্রিকার প্রথম বর্ষ ,দ্বিতীয় সংখ্যা ,তৃতীয় সংখ্যা, চতুর্থ সংখ্যা ।সেপ্টেম্বর, অক্টোবর , নভেম্বর , ডিসেম্বর ১৯৭০ তে প্রকাশিত,রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে অন্তর্ভূক্ত)।

প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র কাজী মোতাহার হোসেন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কে। ঢাকা কলেজে তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন ভূপতি মোহন সেন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পরিসংখ্যান নিয়ে ডিপ্লোমা লাভের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এম এ ডিগ্রী অর্জন করেন ।পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।বিজ্ঞান, রাশিবিজ্ঞান, সংখ্যাতত্ত্ব চর্চার পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও শিখা গোষ্ঠীর যে কর্মধারা প্রসারিত হয়েছিল তার সঙ্গে কাজী মোতাহার হোসেনের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।বস্তুত ‘২৬ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের তিনি ও অন্যতম সংগঠক ছিলেন।

তাঁর লেখা প্রবন্ধ ” সঙ্গীতে মুসলমানের অবদান “একদিকে যেমন গভীর ইতিহাস বোধের পরিচায়ক, অপর দিক থেকে বলতে হয় ,মুসলিম মানসে বিচ্ছিন্নতার চিন্তাকে উস্কে দিয়ে যে বিভাজনের ভূগোল রচনা করা হচ্ছিল, সেই ভূগোলের পরিধিকে বিস্তৃত করবার ক্ষেত্রে ধর্মের রাজনৈতিক কারবারিরা মোতাহার হোসেনের এই প্রবন্ধটিকে টার্গেট করে সে যুগে মুসলমান সমাজের ভেতরে আধুনিকতা মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে প্রতিহত করার অনেক রকম চেষ্টা করেছিলেন।

আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ব্যক্তিগত স্তরের বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন কিন্তু ওদুদ , অন্নদাশঙ্করের ভাবনার দ্বারা ও খুব বেশি রকমের প্রভাবিত ছিলেন। তাই কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী শক্তির চাপের কাছে এতোটুকু মাথা নত করেননি তিনি।পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে ঐতিহাসিক সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলন ঘটে সেই আন্দোলনের সঙ্গে কাজী মোতাহার হোসেনের ছিল অন্তরের যোগাযোগ ।তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা মুসলিম মৌলবাদকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্বপাকিস্তানে ই একদল মানুষদের দ্বারা ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ পালনে চরম বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। সেই সময় মুক্তবুদ্ধির যে সমস্ত মানুষেরা রবীন্দ্রনাথকে কোনোরকম সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার আবরণে আবদ্ধ রাখার তীব্র বিরোধী হয়ে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, সুফিয়া কামাল ,কলিম শরাফী প্রমুখের সঙ্গে কাজী মোতাহার হোসেনের ও ছিল বলিষ্ঠ ভূমিকা।

১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সুফিয়া কামাল , কলিম শরাফী , কন্যা সানজিদা খাতুন প্রমুখ কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন ।কাজী নজরুল থেকে মুজফফর আহমেদ – প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল কাজী মোতাহার হোসেনের অত্যন্ত ব্যক্তিগত স্তরের বন্ধুত্ব ।নজরুল তাঁকে পরম আদরে “মোতিহার “বলে ডাকতেন। বাংলা ভাষায় গণিত চর্চার ইতিহাস রচনা কাজী মোতাহার হোসেনের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ।তাছাড়াও’ সঞ্চায়ন’ , ‘নজরুল কাব্য পরিচিতি’ , ‘ সেই পথ লক্ষ্য করে’ , ‘ সিমফোজিয়াম ‘ , ‘আলোকবিজ্ঞান’ , প্লেটোর সিম্পোজিয়ামের অনুবাদ– এগুলি কাজী মোতাহার হোসেনের অমর সৃষ্টি।

বিজ্ঞান চর্চা , মুক্তবুদ্ধির চর্চার পাশাপাশি কাজী মোতাহার হোসেন আন্তর্জাতিক স্তরের একজন দাবা খেলোয়াড় ছিলেন। বাঙালি জীবনে দাবাকে জনপ্রিয় করবার ক্ষেত্রে কাজী মোতাহার হোসেনের বিশেষ অবদান রয়েছে। এই দাবা খেলার সুবাদেই কার্যত মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন ।১৯৮১ সালের ৯ ই অক্টোবর মনীষী কাজী মোতাহার হোসেনের জীবনাবসান হয় ঢাকাতে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।