কলমের খোঁচা

ভারতের কনিষ্ঠ বিপ্লবী শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর জন্মদিনে চিন্তনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য।


কল্পনা গুপ্ত: চিন্তন নিউজ: ৩রা ডিসেম্বর,২০২০– ক্ষুদিরাম বসু জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর থানার কাছে মৌবনি গ্রামে। মা লক্ষীপ্রিয়া দেবীর চতুর্থ সন্তান তিনি। পুত্রের দীর্ঘ জীবন কামনায় মা তাঁকে খুদের বিনিময়ে বড় কন্যা অপরূপার কাছে বিক্রি করে দেন। তাই তাঁর নাম হয় ক্ষুদিরাম। খুব শিশু বয়সেই তিনি বাবা- মা কে হারান। শেষে বড়দির বাড়িতেই তিনি থাকেন এবং বিদ্যালাভের জন্য তাঁকে তমলুকের হ্যামিল্টন স্কুলে ও পরে কলিজিয়েট স্কুলে ভর্তি করা হয়।

ক্ষুদিরাম ছোটবেলা থেকেই দেশকে ভালোবেসে দেশের কাজে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন নিজের মনে। দৃঢ চরিত্র, অটুট মনোবলে তিনি সমস্তরকম অন্যায় অত্যাচারের মোকাবিলা করতে চাইতেন সরাসরি। ১৯০২ ও ১৯০৩ সালে শ্রী অরবিন্দ ও সিস্টার নিবেদিতা স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশবাসীকে উদবুদ্ধ করতে ধারাবাহিকভাবে বক্তব্য রাখতে থাকেন। ক্ষুদিরাম এতে প্রভাবিত ও উদবুদ্ধ হন। এরপর তিনি অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিয়ে বারীন্দ্র কুমার ঘোষের সংস্পর্শে আসেন এবং ১৫ বছর বয়েসেই সমিতির উল্লেখযোগ্য স্বেচ্ছাসেবী রূপে ভারতের ব্রিটিশ শাসন বিরোধী পুস্তিকা বিতরণের দায়ে গ্রেফতার হন। তিনি ১৯০২ এ জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, রাজনারায়ণ বসু, হেমচন্দ্র দাস কানুনগো ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রভাবে ও নির্দেশে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। এই সময়ে আলিপুর প্রেসিডেন্সি বিচারালয়ের মুখ্য হাকিম কিংসফোর্ড কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন সুশীল সেনকে সাজা দিয়ে, নবীন রাজনৈতিক কর্মীদের কঠোর ও নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগে, তাদের শারীরিক নির্যাতনের জন্য ও বিচারে অনিরপেক্ষতার জন্য।

কুখ্যাত বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার দায়িত্ব ছিলো প্রফুল্ল চাকি ও ক্ষুদিরাম বসুর ওপরে। ৩০ শে এপ্রিল ১৯০৮, বিহারের মুজাফফরপুরে রাত সাড়ে ৮ টায় ইউরোপীয়ান ক্লাবের সামনে তাঁরা বোমা নিক্ষেপ করেন কিংসফোর্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে। কিন্তু সেদিন তিনি সেই গাড়িতে ছিলেন না, ছিলেন মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা। তারা নিহত হলে ক্ষুদিরাম গ্রেফতার হন বিহারের এক গ্রাম থেকে পলাতক অবস্থায়। প্রফুল্ল চাকি নিজেকে রিভলবারের গুলিতে হত্যা করেন। এই মামলা ২১ শে মে ১৯০৮ এ আলিপুর বোমা মামলা নামে পরিচিত। মামলায় চুড়ান্ত রায়ে ক্ষুদিরামের ফাঁসির আদেশ হয়। ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় মাত্র ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন বয়েসে। ক্ষুদিরামের এই কাজকে গান্ধীজি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। কিন্তু বাল গঙ্গাধর তিলক তাঁর কেশরী পত্রিকায় এই দুজন নবীন যুবককে সমর্থনের আওয়াজ তোলেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে।

১৯০৮ সালের ১১ ই আগষ্ট ফাঁসি হয় ক্ষুদিরামের। জেলে শেষ কটা দিন কারাগারে বসে মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি, রবীন্দ্রনাথের লেখা চেয়েছিলেন। আইনজীবী সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘ রাজপুত নারীর জওহর ব্রত পালনের মত আমিও নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দেবো।’ ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ার আগে তাঁর বিস্ময়কর প্রশ্ন ছিলো, ‘ ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন? ‘আজ তাঁর জন্মের ১৩০ বছর পরে স্বাধীন ভারতের স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী, অতীত বিস্মৃত, ইতিহাস বিকৃতকারী স্বদেশবাসী অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসে ‘ বিপ্লব ও সন্ত্রাসবাদী ‘অধ্যায়ে তাঁর স্থান করেছে। এইভাবেই নতুন প্রজন্মকে ভুল পথে চালিত করার এক ঘৃন্য চক্রান্ত দেশকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যা ব্রিটিশ শাসনের সময়কেও হার মানায়। মেদিনীপুর কলিজিয়েট স্কুলের ছাত্ররা কিন্তু এর প্রতিবাদে মাধ্যমিক পর্ষদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে বিক্ষোভ দেখিছে ও স্মারকলিপি জমা দিয়েছে।

ভয়ঙ্কর স্বার্থপরতার অন্ধকার যখন সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে, ঠিক তখনই আমাদের খুব প্রয়োজন এই মনীষীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস আরো গভীরভাবে জানা ও অনুধাবন করা আর সেটাই হবে সঠিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।