চৈতালী নন্দী:চিন্তন নিউজ:২২শে এপ্রিল:– প্যারি কমিউন (১৮৭১,১৮ই মার্চ থেকে ২৮শে মে) ছিল পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্র যা টিকে ছিল ৭২ দিন।অপরদিকে রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লব প্রতিষ্ঠিত করেছিল শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র, প্যারি কমিউনের ৪৬ বছর পর। মার্কস কিন্তু প্যারি কমিউনের শ্রষ্টাও নন, নেতাও নন। অন্যদিকে লেনিন সরসরি অক্টোবর বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৮৭১ সালে অপ্রস্তুত অবস্থায় বুর্জোয়া সরকার কে উচ্ছেদ ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল না করার জন্যে মার্কস ফরাসি শ্রমিকদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেলে তিনি এগিয়ে আসেন অভ্যুত্থানকারী শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে। প্যারি কমিউন ব্যার্থ হলে মার্কস ব্যার্থতার কারণগুলি চিহ্নিত করেছিলেন ‘ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ’ নামক পুস্তিকায়।
প্যারি কমিউন সম্পর্কে মার্কস যে শিক্ষা তুলে ধরেন, সেটাই কাজে লাগিয়ে ছিলেন লেনিন অক্টোবর বিপ্লবের ক্ষেত্রে। প্যারি কমিউনের প্রধান দূর্বলতা ছিল এই যে, প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণীর সামনে কোনো বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না, রাজনৈতিক লক্ষ্য সম্পর্কে স্বচ্ছতা ছিল না এবং তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক পার্টি ছিলনা। মার্কসবাদ কখনও শ্রমিক শ্রেণী এমনকি শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী নেতাদের কাছেও খুব বেশী পরিচিত ছিল না। অন্যদিকে লেনিন ও অন্যান্য বলশেভিক নেতারা মার্কসবাদ ভালোভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তে স্বচ্ছতা ছিল। আর ছিল সুস্পষ্ট কর্মসূচি, যার অধিকাংশ লেনিন প্রণয়ন করেছিলেন।
প্যারি কমিউনের বেশ কয়েকবছর আগেই (১৮৬৪) ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ গঠিত হলেও এবং সেখানে প্রুধোবাদ, ব্লাঙ্কিবাদ ও বাকুনিনবাদ কে পরাজিত করে মার্কসবাদ বিজয় লাভ করলেও, তখনও পর্যন্ত মার্কসবাদ শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে তেমন কোনো ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি। অপরদিকে অক্টোবর বিপ্লবের আগেই বলশেভিকরা কেবল মার্কসবাদ কে ভালোভাবে আত্মস্থই করেননি, মার্কসবাদ কে বিকৃত করার যে সংশোধনবাদী প্রবণতা দেখা দিয়েছিল তাকে প্রত্যাখ্যান ও পরাজিত করে বলশেভিকরা বিপ্লবী মার্কসবাদ-এর প্রয়োগ করেছেন। বিপ্লবী সংগ্রামের জন্য তাঁরা তাত্ত্বিক, মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক দিক থেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। এই ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেনিন।
প্যারি কমিউনের সময়ে বিপ্লবী শ্রমিকদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল ছিলনা। কিন্তু লেনিন মার্কসবাদী বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলেন। এক্ষেত্রে তিনি যে সকল সাংগঠনিক নীতি তৈরী করেছিলেন তা আজও কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টির জন্য প্রাসঙ্গিক।
প্যারি কমিউন বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে ভেঙে শ্রমিকশ্রেণীর উপযোগী নতুন ধরণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল ঠিকই, কিন্তু সমাজতন্ত্রের জন্যে যা একান্ত প্রয়োজনীয় সেই অর্থনৈতিক কর্মসূচী কমিউনের বিপ্লবীরা নিতে পারেননি। বস্তুত, তখনও পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য কোনো উন্নত পুঁজিবাদী দেশ বস্তুগত ভাবে প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি। ১৮৪৮ সালে জার্মানিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব (যাতে মার্কস -এঙ্গেলস সরাসরি অংশ নেন) ব্যার্থ হবার পর,১৮৫০ সালে মার্কস -এঙ্গেলস লিখেছিলেন, “বিপ্লব শুধু সেই পর্বেই সম্ভব, যখন আধুনিক উৎপাদন শক্তি ও বুর্জোয়া উৎপাদন কাঠামো, এই দুয়ের মধ্যে পারষ্পরিক সংঘাত উপস্থিত হয়”।
বস্তুত উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিশ্ব পুঁজিবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদে পরিনত হলো, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, পুঁজির একচেটিয়াত্ত ও ফিনান্স পুঁজির প্রধান্য, সেই কালপর্বটি ছিল পুঁজিবাদের অবক্ষয়ের যুগ এবং একই সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের যুগ। তার আগেই মার্কস মৃত্যু বরণ করেছেন। এইযুগেই বাস করছিলেন লেনিন। তিনি সেযুগের পুঁজিবাদের নতুন স্তরের, সাম্রাজ্যবাদী স্তরের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছিলেন বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর বইটিতে।এই বইতে তিনি এটাও দেখালেন যে, ‘সাম্রাজ্যবাদ হলো সর্বহারা শ্রেণীর সমাজ বিপ্লবের পূর্বাহ্ন’। লেনিন সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবের রণনীতি, রণকৌশল ও অন্যান্য বিষয় তুলে ধরেন।এর মধ্যে ছিল বিপ্লবী পার্টি সম্পর্কিত ধারণা ।এছাড়াও শ্রমিক -কৃষক মৈত্রীর দিকটিও লেনিন বিকশিত করেন। স্টালিনের সংজ্ঞা অনুযায়ী লেনিনবাদ হলো ‘সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারার বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ।’