কলমের খোঁচা

রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান প্রসঙ্গে – সফল সেন


কোলকাতার,জোড়াসাঁকো অঞ্চলের আদি নাম ছিল মেছুয়াবাজার । ইতিহাসপ্রসিদ্ধ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল বাংলার নবজাগরণের অন্যতম মুখ্য ধারক ও বাহক। ঠাকুর পরিবার ছাড়াও নবজাগরণের অন্যান্য পৃষ্ঠপোষক কালীপ্রসন্ন সিংহের , কৃষ্ণদাস পালের, এবং দেওয়ান বানারসি ঘোষ ও চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার এই অঞ্চলে তাকতেন। জোড়াসাঁকো হয়ে উঠেছিল “বাংলার নবজাগরণের শিশুশয্যা।” ১৭৮৫ সালে কোলকাতা পৌর প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের জন্য যে ৩১টি থানা সৃষ্টি হয়েছিল,জোড়াসাঁকো তার অন্যতম।


★ রবীন্দ্রনাথের আঁতুড় ঘর থেকে শুরু করে যে ঘরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন সেটি সাজানো গোছানো। মোট ৪টি ভবনের ১৮টি গ্যালারি জুড়ে রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম। মূল বাড়িটি আয়তাকার। দোতলায় উঠেই হাতের বাম দিকে যে ঘরটি সেটি রবীন্দ্রনাথের খাবার ঘর, তার সাথেই লাগোয়া মৃণালিনী দেবীর হেঁসেল। পাশে সংগীতের ঘর, এর পর মহাপ্রয়াণের ঘর। ১৯৪১-এর ৩০ জুলাই এ ঘরেই কবিগুরু তাঁর শেষ কবিতা, ‘তোমার সৃষ্টির পথ’-এর ডিক্টেশন দিয়েছিলেন। এর মাত্র সাত দিন পর তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।


★বীরভূম জেলার, বোলপুরের রায়পুরে সিংহ ( ভুবন সিংহ………….. লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিনহা ) রাজবাড়ির তিনতলার চিলেকোঠায় আশ্রয় নিতেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই ঘর জুড়ে সই সহ কাঠ পেন্সিলে আধ্যাত্মিক লেখা দেবেন্দ্রনাথের – আজ আর নেই। তিনতলার চিলেকোঠার সেই ঘরেই ১৮৬৩ সালের ৩১ শে মার্চ জলের দরে( বার্ষিক ৫ টাকা ৯৯ বছরের লীজ,পরে ৫ টাকাটাও সিংহরা নেয় নি) শান্তিনিকেতনের ২০ বিঘে জমি দেবেন্দ্রনাথকে বিক্রি করেন ভূবন সিংহ নন, তার পুত্র প্রতাপ নারায়ন সিংহ – বিক্রির কোবালাতে প্রতাপ নারায়ণ সিংহের সই আছে। দলিল কোবালাতে শান্তিনিকেতনের ২০ বিঘে জমির কথা আছে – অর্থাৎ শান্তিনিকেতন নাম আগেই ছিল – দেবেন্দ্রনাথ তার নামকরণ করেননি।


★(সূত্র– @অঙ্কুশ দাস,গবেষক,যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়,বাড়ী বোলপুরের রায়পুর,বীরভূম)
★এরপর ১৮৭৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পিতার সঙ্গে কয়েক মাসের জন্য কলকাতার বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয় রবীন্দ্রনাথের। প্রথমে তাঁরা যান শান্তিনিকেতনের পারিবারিক এস্টেটে। ১৮৬৩ সালের শেষে এখানকার আম্রকুঞ্জ ও উদ্যানমধ্যে দেবেন্দ্রনাথ দুই কামরার ঘর নির্মাণ করেছিলেন।প্রকৃতির সান্নিধ্যে এই দিনগুলি সম্পর্কে পরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—–
“যাহা দেখিলাম না তাহার খেদ মিটিতে বিলম্ব হইল না – যাহা দেখিলাম তাহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট হইল। এখানে চাকরদের শাসন ছিল না। প্রান্তরলক্ষ্মী দিক্‌চক্রবালে একটি মাত্র নীল রেখার গণ্ডী আঁকিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাতে আমার অবাধসঞ্চরণের কোনো ব্যাঘাত করিত না।”
★দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)। ইনি জয়রামের প্রপৌত্র‚নীলমণির পৌত্র‚রামমণির পুত্র‚রামলোচনের পোষ্য পুত্র‚ দেবেন্দ্রনাথের পিতা‚রবীন্দ্রনাথের পিতামহ। দ্বারকানাথ না জন্মালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি কোনওদিন খুঁজে পেত না তার অতুলনীয় বৈভব ও মহিমার ঠিকানা।
★ দ্বারকানাথ ইংল্যান্ডে মারা গেলেন। পনেরো বছর অতিক্রান্ত। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আর্থিক অবস্থায় তখন ভাঁটার টান । বাংলার সাল ১২৬৮, ২৫ বৈশাখ। ইংরেজি তারিখ ৭ মে‚ ১৮৬১, মঙ্গলবার।জোড়াসাঁকোর ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুরবাড়ির মূল বাসভবনে জন্মালো দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদা সুন্দরীর চোদ্দতম সন্তান‚ অষ্টম পুত্র। কনিষ্ঠতম। রাত্রি ২ টো ৩৭ মিনিট ৪১ সেকেন্ড। তৈরি হল শিশুর জন্মকোষ্ঠী একেবারেই জন্মগ্রহণের সাথে সাথেই। কৃষ্ণা ত্রয়োদশী। জন্ম ঠিকুজির ওপর লেখা হল ভবিষ্যৎবাণীটি—-_ : “শুক্লের দশা ভোগ্য।”
১) এই জাতক আজীবন সংগ্রামের পথে প্রতিষ্ঠিত করবে নিজের বিপুল ও বিশাল পরিচয়।
২) আজীবন ইন্দ্রিয়ঘন উপলব্ধি ও উপভোগের সন্ধানী হবে। ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে সে কখনওই যাবে না বৈরাগ্যের পথে। এসে গেল শিশুটির নামকরণের দিন। শিশুর পিতা দেবেন্দ্রনাথ‚ ব্রাহ্ম।
তিনি ঘোষণা করলেন‚ আমার এই ছেলের নামকরণ ও অন্নপ্রাশনে কোনও দেবদেবীর পূজা হবেই না।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে থমথমে পরিবেশ তারমধ্যে বাজ পড়লো যেন। পুরোহিতরা সব কয়জন বেঁকে বসলেন। নারায়ণশিলা ছাড়া নামকরণ ও অন্নপ্রাশন কখনই সম্ভব নয়। দেবেন্দ্রনাথ আস্তে আস্তে বললেন ‚ শুধু একটি পিঁড়ি চাই। হোমাগ্নির পাশে পিঁড়িটি রেখে আলপনা এঁকে দেওয়া হলো তার চতুর্পার্শ্বে। পিঁড়ির চারপাশে ছোট ছোট গর্ত করা হল – সারিবদ্ধ গর্ত। সবই গৃহকর্তার নির্দেশে । দেবেন্দ্রনাথ বললেন‚ ওই গর্তগুলির মধ্যে সারি দিয়ে বসিয়ে দাও মোমবাতি। দেবেন্দ্রনাথ নিজের হাতে পিঁড়ির মাঝখানে রক্তচন্দন দিয়ে লিখে সাজিয়ে দিলেন অক্ষরগুলি। উজ্জ্বল হলো একটি নাম — ” রবীন্দ্রনাথ “। জ্বালিয়ে দিলেন সব কটি বাতি। আগুন কাঁপছে, আগুনে কাঁপছে “রবীন্দ্রনাথ ” নামটি। নাম নয়‚ উদ্ভাসিত হলো নূতন দিনের আলোর পরিক্রমা। ধীরে ধীরে দেবেন্দ্রনাথের মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো একটি শব্দ, একটি নাম‚ “রবীন্দ্রনাথ”। বললেন‚ ” সূর্যের সূর্য “। যেন আষাঢ়ের হিমাদ্রিশৃঙ্গের দুর্বার বর্ষণের ধারা নেমে আসছে মহানদ ব্রহ্মপুত্রের সারা শরীর দিয়ে। যেন গঙ্গোত্রীর গলিত হিমবাহ আর বজ্রনির্ঘোষ বর্ষণের জলরাশি আজ একে অপরকে জড়িয়ে চুম্বনে একাকার। পরস্পরের মিলিত হওয়ার প্রথম আনন্দ যেন সারা ভারতবর্ষকে বলছে,”আমি বিশ্বজয়ের পথিক। আমি পথ হারাইতে আসি নাই। আমি পথনির্দেশ করিয়া দিব তোমাদের।”
★ রবীন্দ্রনাথ আমাদের দ্বিতীয় পিতা।
আমার ফেসবুকের বন্ধু KN Swarna তামিলনাড়ুর মেয়ে। লিখেছেন,” রবীন্দ্রনাথ কি শুধু বাঙালীর একার ?? রবীন্দ্রনাথ সব্বার। আমি তামিল। আমি বাঙালী হলে গর্ববোধ করতাম। রবীন্দ্রনাথ আমারও। “
★ আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী দুজনেই বক্তৃতায় বলছেন,রবীন্দ্রনাথ বীরভূমে জন্মেছিলেন। আরে,বোলপুরের জমি কেনা হয়,১৮৬৩ সালের ৩১ মার্চ,আর রবীন্দ্রনাথের জন্ম তার ২ বছর আগে। ১৮৬১ সালের ৭ মে।
★ হে ভারতবাসী,তুমি অশিক্ষার সংস্কৃতিকে আর কতদিন বইবে ?? আর কতকাল আমরা গাইবো,বিস্তীর্ণ দুপারের গান, আর কবে আমরা বলতে পারবো,” ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম। আমরা রয়েছি সেই রবীন্দ্রনাথের দেশে……।
★ ভাবছেন,আমি ভুল বললাম ?? মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ উচ্চারণের ক্ষণটা মনে করুন। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। আনন্দে চোখ জলে ভরে যাচ্ছে। বোবা হয়ে,বধির হয়ে যাচ্ছি। অস্পষ্ট চোখে আমি দেখতে পাচ্ছি মোমবাতির কম্পিত আলোয় মহর্ষি বলছেন…
” ★রবীন্দ্রনাথ ★ সূর্যের সূর্য।
দেরী হয়ে গেলো এতটা পড়তে। তাড়াতাড়ি ভোট দিতে যান। মেশিনে সেই বোতামে টিপ দিন। যেখানে ভেসে উঠুক রবীন্দ্রনাথ। আমাদের চেতনাটুকু। এছাড়া আর আমাদের কি ই বা আছে ??


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।