কলমের খোঁচা

ধারাবাহিক উপন্যাস- ‘কলির রাধা ‘পর্ব৩ -গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ:২রা এপ্রিল:সেদিনের সেই চিলেকোঠার ঘটনার অল্প কয়েকদিন পরেই মেয়ে অলি আর বৌ রমাকে কে নিয়ে বাগবাজারে ভাড়া বাড়িতে চলে এসেছিল দীপ।চন্দনার গোটা পরিবার জেনেছিল, দীপ সিনেমার ডাইরেকশনের সুবিধার জন্যে কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছে।অনেকের কাছেই একটু অবাক লেগেছিল একা চন্দনা কে ফেলে বৌ , বাচ্চা নিয়ে দীপের কলকাতাতে কেবল সিনেমা করার পাগলামোতে এই বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার ব্যাপারটা।  হারু , দীপের কাঠের গোলার ম্যানেজার, অংশু, ওর শো রুমের ম্যানেজার– সকলেই একটু অবাক হয়েছিল।দীপ সবাইকে আশ্বস্ত করে; রোজ সকালে আমি আসব।গোলায় বসব।শো রুমে বসব।মার কাছেই খাব।রাতে বাগবাজারে ফিরে যাব। দীপের এই স্তোক বাক্য শুনে ওর শোরুমের স্টাফ টাপুর বৌ অবশ্য কোনো রকম ঢাক ঢাক গুড় গুড় না করে ওদের বাড়িতে এক সন্ধ্যেতে দীপ যখন চা খেতে আসে , তখন সরাসরি ই ওকে বলেছিল;কি গো দীপ, শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণ পক্ষের মদ্যিখানে পরে আমাদের চাঁদমামার একদম গেরণের দশা হলো নাকি?টাপুর বৌয়ের এই খোলামেলা লাস্যময়ী কথা দীপের আবার বেশ পছন্দের।তাই সুযোগ পেলে ই টাকার আর ইন্টেলেকচুয়ালের গরিমাকে একটু সিন্দুক বন্দি করে দীপ তার এই টাপুদার বাড়িতে আসে।আসার লোক দেখানো ছুতো টাপুদা হলেও, টাপু নিজে ও বোঝে ওর বৌয়ের এই ঢলামি টা দীপের বেশ মন পসন্দ। তবে সেদিন টাপুর বৌয়ের কথায় দীপের ফর্সা গালটা বেশ লালই হয়ে গিয়েছিল।   টাকার গরিমায় মটো মটো হয়ে যতো ইন্টেলেকচুয়াল হোক না কেন,  রমার ঠান্ডা চোখের চাউনি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি দীপের পক্ষে। আশেপাশের গুজগুজ ফিসফাসকে খানিকটা বাড়তে দেওয়ার সুযোগ দিয়েই একপ্রকার বাধ্য হয়ে মেয়ে ,বউকে নিয়ে বাগবাজারে চলে যাওয়া ছাড়া প্র্যাকটিক্যালি দীপের কাছে আর কিছু অল্টারনেটিভ ছিল না। দীপ অবশ্য এই এঁদো মফস্বল শহর ছেড়ে বাগবাজারে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার পেছনে মনে মনে একটা অঙ্ক কষে রেখেছিল ।অঙ্ক টা হলো, ওর;” সত্যজিৎ রায় রুপে আত্মপ্রকাশে”র “স্বপ্ন” অথবা “দুঃস্বপ্ন”।অনেক ঘষামাজা , অনেক ওলট-পালটের পর নিজেকে সত্যজিৎ রায়ের রেজারেকশন হিসেবে তুলে ধরতে,  নিজের ছবির স্ক্রিপ্ট দীপ নিজেই লিখেছে। মোসাহেব বন্ধুদের সঙ্গে অনেক তর্ক বিতর্ক ,বুদ্ধি পরামর্শের পর ছবির নাম রেখেছে “বাক্সের ভেতর অপয়া”। নামটা শুনেই ছোট মাইমা বলেছিল ;তোর মাথা থেকে বেরও  হয়  বটে দীপ!মাথা থেকে বের হলেই চলবে না,  তোমাকে কিন্তু অ্যাক্টিং করতে হবে।সেকিরে ?আমি পারবো দীপ? ন্যাকামির ডোজ আরো দুই চামচ বেশি করে  দীপকে প্রশ্নটা করেছিল নীরা। আসলে নীরা জানতো, সত্যিই যদি দীপ কোনো দিন সিনেমা তৈরি করতে পারে,  ওর এই ছোট মাইমাকে সে কাস্টিং করবেই করবে।
  ” পূর্বাশা”র সব সমাজসেবীদেরই দীপের ছবি নিয়ে গল্প করা হয়ে গেছে নীরার। বর্ণালী তো বলেই ফেলল,  যাক এবার ভাগ্নের কল্যাণে নীরাদি তোমার নায়িকা হওয়া আর কেউ আটকাতে পারছে না।  বর্ণালীর কথার মধ্যে ঠেস দেওয়া ব্যাপার যে আছে, সেটা  বুঝেও না বোঝার ভান করল নীরা। আসলে দীপ বারবার বলে দিয়েছে; স্ক্রিপ্ট বা সিনেমার বিষয়বস্তু নিয়ে বাইরে কোথাও কোনো গল্প এখনই না করতে। দীপের ফিল্মের কনফিডেনশিয়ালিটি রাখতে হবে তো — তাই বর্ণালীর কথার ঝাঁজ টা হজম করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো অন্য উপায় নীরার কাছে ছিল না । তবে সিনেমাতে নীরার  সঙ্গেই ছোট মামা বারীন কেও  যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়েছিল দীপ , মনে মনে একটু বিরক্তই হয়েছিল নীরা ।তার থেকেও বিরক্ত হয়েছিল সিনেমার প্রিমিয়ার শো তে গিয়ে।

 পর্দাতে রমাকে   এক ঝলকের জন্য হলেও সিনেমায় অভিনয় করাবে দীপ ,সে কথাটা আগে নীরাকে না বলার জন্য সেদিন প্রিমিয়ার শো  দেখে ফেরার পথে এক গাড়িতে ফিরলেও, দীপের সঙ্গে একটাও কথা বলেনি নীরা। বাপের টাকা উড়িয়ে সিনেমা বানানো,  দীপের এই ব্যাপারটা রমা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি ।বাগবাজারে ভাড়া বাড়িতে উঠে আসার  পর দীপ যখন রোজ সকালে উঠেই মার কাছে যাবার নাম করে বেরিয়ে পরতো ,রমা বুঝতে পারত গন্তব্য কোথায়। তা বলে সত্যি সত্যি বউ,  মেয়ের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে, বাপের  জমানো টাকা খরচ করে সিনেমা তৈরীতে মেতে উঠবে দীপ–  এটা যেন শেষ পর্যন্ত কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না রমা ।
আসলে বাগবাজারে ভাড়া বাড়িতে আসার পর থেকেই রমা আর দীপের  সম্পর্কটা আরো বেশি রকমেরই ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করে।  ” তোমার জন্যই বিধবা মাকে ছেড়ে একা একা বৌকে নিয়ে এভাবে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হচ্ছে”– এসব ঠারেঠোরে বোঝাতে দীপ কসুর করেনি। এমনকি রমার ভাইয়ের অসুস্থতাকে নিয়ে টিটকারি করতে  গিয়ে রমার ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে আকার ইঙ্গিতে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছিল  দীপ ।বাপের বাড়ির তেমন জোর নেই ।আর এর ভিতরেই ক্রনিক রেনাল ফেলিওরে   ডায়ালিসিসের জেরে রমার বাবা প্রায় ফতুর হয়ে গেছে। তাই বাপের বাড়ির জোর বলতে কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট  নেই । বাগবাজারে থাকাকালীনই রমার বাবা মারা গেলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর রমার জন্য বাপের বাড়ির শেষ অবলম্বন টুকুও ঘুচে গেল। মা তো চিররুগ্ন। দীপ যাই বলুক না কেন, রমা তো সত্যিই জানে, তার ভাইয়ের মানসিক অসুস্থতার কথা শ্বশুরবাড়ির পাড়ার একজন সাইকোলজিস্ট কে দিয়ে ভাই কে দেখিয়ে দিয়েছিল দীপ ।এ জন্য বরের প্রতি রমার একটা মনে মনে কৃতজ্ঞতা ও আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর সিনেমা তৈরীর জন্য শ্বশুরের জমানো টাকায় হাত দেওয়া নিয়ে দীপ কে আর একটা কথাও বলেনি রমা। এই না বলার পিছনের সব থেকে বড় কারন হল; বিয়ের পর থেকে এতদিন ধরে দীপ কে দেখে রমা  বুঝেছে যে ,কোনো কিছু বলে সেখান থেকে দীপকে  সরিয়ে আনা আর যাই হোক   রমার কম্ম নয়। বিশেষ করে বিয়ের রাত থেকেই সে শুনছে সিনেমা হল তার বরের ধ্যান-জ্ঞান ।সেই অভিশপ্ত চিলেকোঠায় ভি সি ডি , ভি সি আর , আর ভিডিও ক্যাসেটের স্তুপের ভেতর দীপ কে দেখতে রমার যে খুব খারাপ লাগতো তা কিন্তু নয়। কয়েকবারে  গ্রাজুয়েশন করা দীপ রমার প্লেন গ্রাজুয়েট হওয়া নিয়ে নানারকম উপহাস করলেও সেই প্লেন গ্রাজুয়েশনের বুদ্ধি  নিয়েই  কিন্তু বরের এই সিনেমা অবশেসনকে  নিয়ে বাপের বাড়িতে জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো, ভাই, বোনদের সামনে  গর্ব করতে ছাড়তো না রমা।
দীপের শুটিংয়ের মাঝেই ইংল্যান্ড থেকে বউ , বাচ্চা নিয়ে ওর দাদা অভ্র ,মায়ের কাছে এলো।একলা মাকে মফস্বলের বাড়িতে ছেড়ে এভাবে বাগবাজারে ভাড়া বাড়িতে দীপের থাকার ব্যাপারটা নিয়ে নানারকম কানাঘুষো আত্মীয়স্বজনদের ভেতর থেকেই অভ্রের  কানে এসে পৌঁছেছিল।আসলে দীপ আর ছোট মাইমা নীরার সম্পর্কটা অত দূরে থেকেও অভ্র যে একদম আন্দাজ করতে পারত না,  তা কিন্তু নয় ।অভ্রর  বউ ঈশিতা, ইনিয়ে বিনিয়ে   নয় , একদম সরাসরিই দীপ আর নীরার সম্পর্ক নিয়ে অনেকবার অভ্র কে বলেছে।অভ্র আন্দাজ করে,  রমা হয়তো অবচেতন মনে নয় , সম্পূর্ণ সচেতনভাবেই ছোট মাইমাকে ঘিরে নিজের বিরক্তির কথা ঈশিতার কাছে গোপন করে নি ।মা যে ইংলন্ডের মাটিতে অভ্র প্রতিষ্ঠিত, যথেষ্ট  টাকা পয়সা করেছে সেখানে ব্যবসা করে–  এগুলোকে যথেষ্ট সম্ভ্রমের চোখে দেখে ও দীপের দিকে একটু বেশি দুর্বল ,এটা বুঝতে অভ্রের  কখনো অসুবিধা হয়নি ।ঈশিতা ও আকারে-ইঙ্গিতে মায়ের এই ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা টা অভ্র কে বুঝিয়ে দিতে ছাড়েনি। ইন্টেলেকচুয়াল  আঁতলামো করে বাবার ব্যবসা টা যে প্রায় লাটে ওঠাচ্ছে দীপ, ওর প্রোডাক্টের কোয়ালিটি নিয়ে কাস্টমার গ্রেভেন্স ক্রমশঃ বাড়ছে, সেগুনের সঙ্গে গামারি কাঠের পাইলিং পালিশের জৌলশে ঢাকলেও কাস্টমার আস্তে আস্তে সব ধরে ফেলছে–  কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে থাকলেও এসব খবর ইমেল, ইন্টারনেটের যুগে অভ্রর কাছে উইফ প্রুফ পৌঁছতে দেরি হয় নি।এসব কিছুই  বুঝতে পারলেও বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের ব্যবসা নিয়ে অভ্রকে  এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে   পশ্চিমবঙ্গের কোন এঁদো মফস্বল  শহরে তার বাবার কাঠের গোলা , জমি- জিরেত, জমানো টাকা — এসব নিয়ে ভাববার খুব একটা সময় বা ইচ্ছে কোনটাই অভ্রের  কখনো হয়নি ।আর পুরুত বাড়ির মেয়ে ঈশিতা বিয়ের পরে এসে যখন দেখে তার বিধবা শাশুড়ি মাছ , মাংস,  ডিম-  সবই খায় ,সেটা নিজের বাপের বাড়িতে দেখা সংস্কার থেকে সে কখনোই মেনে নিতে পারেনি ।ইংল্যান্ডের মাটিতে দুবেলা হ্যাম,  পর্ক, বিফ খেলেও শাশুড়ির খাওয়া দাওয়া নিয়ে খোঁচা অভ্র কে দিতে শারে ছাড়ে না ঈশিতা ।
চন্দনা বুঝতে পেরেছিল,  তার এই মাছ মাংস খাওয়ার ব্যাপারটাতে বড় বউয়ের আপত্তি ।তাই দীপের বিয়ের আগেই চন্দনা ছেড়ে দিয়েছে মাছ মাংস, এই ভয়ে যে, ছোট বৌয়ের সঙ্গে তো ঘর করতে হবে।সে যদি আবার খাওয়া দাওয়া নিয়ে খোঁটা দেয়!তবে ছেলেদের পীড়াপীড়িতে বৈদিক বামুন বাড়ির মেয়ের হাড়ের গরম দেখাতে মসুর ডালের প্রতি ও ভক্তি দেখানোর মতো অতটা দ্রাবিড় ঘেরাটোপে ও নিজেকে বন্দী করে নি চন্দনা।সিনেমার শুটিং চলাকালীনই বরদাভাই অভ্রের  খানিকটা চাপে পড়েই বাগবাজারের ভাড়াবাড়ির পাট উঠিয়ে মেয়ে ,বউকে নিয়ে দীপ আবার ফিরে আসে মায়ের কাছে। হয়তো বড় বৌদি ঈশিতাকে অকপটে সব কিছু বলেছিল রমা । তাই ঈশিতার খানিকটা বিরক্তির জেরেই নীরা এখন খুব একটা ননদের বাড়িতে আসে না।যদিও বা আসে,  রাস্তায় গাড়িতেই বসে থাকে ।বারীন ওপরে গিয়ে চন্দনার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে আসে । রমা কিন্তু  নীচে নেমে এসে ছোটমাইমাকে উপরে যাওয়ার অনুরোধ করে না। আর দীপ অনুরোধ করলেও সেই অনুরোধ কে কানে তুলে ওপরে ওঠার ইচ্ছে দেখায় না নীরা ।একদম নিরাসক্ত মুখেই খানিকটা সময় গাড়িতে বসে ড্রাইভারের  সঙ্গে দু’চারটে কথা বলার পর ড্রাইভারকে দিয়ে ডেকে পাঠায় বারীন কে বলে; তোমার নতুন বাজারের চেম্বারে সময় হয়ে গেল তো। সব ক্রিটিক্যাল পেশেন্টরা কতো কষ্ট করে বসে আছে ।আর তুমি আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করছো? নীতিগতভাবে এটা কি ঠিক?
বারীন নীরার নীতি কথার কথামালায় বুঝতে পারে চেম্বারে যাওয়ার দেরিতে যদি দুটো চারটে পেশেন্ট  ফসকে যায়,  তাহলে লক্ষ্মীর কৃপা টা আজকে আশানুরূপ নাও হতে পারে। তাই বউয়ের বাধ্য বর হয়েই ,বউয়ের  নীতিকথায় সায় দিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসে ড্রাইভারকে গাড়ি ছোটানোর নির্দেশ দেয় সে। কার্টুনিস্ট সুদীপ্ত যে টাকার তাগাদায় একদম ওর বাড়িতে চলে আসবে এটা আন্দাজ করতে পারে নি দীপ।ছোটমাইমার বাড়িতে সেদিন বসে চা খাচ্ছে।হঠাৎ মোবাইলে রমার ফোন।রমা ইদানীং খুব দরকার না হলে মোবাইলে ফোন করে না।হাতের ইশারায় ছোটমাইমাকে চুপ করতে বলে ফোন টা ধরলো দীপ;এই শোনো এক ভদ্রলোক এসেছেন।বলছেন, তোমার সিনেমাতে কিসব কার্টুন এঁকেছেন।অনেক টাকা পাবেন তোমার কাছে।গোলায় এসে খুব চিৎকার চ্যাচামেচি করছেন।হারুদা এসে আমাকে বললো।হারুদা ও লোকটাকে ঠিক মতো সামলাতে পারছে না।তুমি একটু তাড়াতাড়ি চলে এসো।রমার ফোনটা ছেড়ে একটু অবাকই হয়ে গেল দীপ।সুদীপ্তর আঁকা বেশ কিছু কার্টুন সিনেমায় ব্যবহার করেছিল।অল্প কটা টাকা ওকে ঠেকিয়েই ভেবেছিল ,কাজ হয়ে যাবে।পরে অবশ্য দীপ জানতে পারে, সিনেমার হিরো দিব্যব্রতর সঙ্গে সুদীপ্তর ছোটবেলাকার বন্ধুত্ব।দিব্যব্রতের লাস্ট ইনস্টলমেন্ট এক লাখ সত্তর হাজার টাকা আজ দিচ্ছি, কাল দেব করে ,এখনো পর্যন্ত না দেওয়ার জেরে , দিব্যব্রত ই কায়দা করে সুদীপ্ত কে পাঠিয়েছে বলে ধারণা হলো দীপের।দিব্য নামি এক্টার।ওর পক্ষে তো আর এতোদূর উজিয়ে এসে গলায় গামছা দিয়ে বকেয়া টাকাটা আদায় করা চক্ষু লজ্জার খাতিরে সম্ভব হবে না- এটা ভেবে একটু নিশ্চিন্ত ই ছিল দীপ।কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিব্য যে সুদীপ্ত কে দিয়ে টাকা আদায়ের জন্যে এই চাল চালবে– এটা দীপের ভাবনার বাইরে ছিল।গোলায়  ফিরে দীপ দেখে হারুদার সঙ্গে সুদীপ্তর প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড়। দীপ ঢুকতেই উত্তেজিতভাবে হারু বলে; দেখো দীপ, তুমি নাকি ওর পয়সা মেড়ে দিয়েছো ।কোন্  হিরো কে নাকি পুরো টাকা দাওনি। কোথাকার কে এসে এখানে তোমার নামে উল্টোপাল্টা ভাট বকছে। তুমি একবার বল, ওর থোবড়া টা বানিয়ে ছেড়ে দিই।

 দীপ দেখল পরিস্থিতি খানিকটা আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে। পুরনো ফর্মে ফিরে এসে হারুদা যদি এক ঘা, দু ঘা সুদীপ্ত কে দিয়ে দেয় ,দীপের লোকসান বাড়বে বই কমবে না।। গোটা ব্যাপারটাই মারাত্মক গোলমেলে হয়ে যাবে এইসব টাকা-পয়সার ব্যাপার স্টুডিও পাড়ায় তিল থেকে  তাল হয়ে ছড়িয়ে পড়তে সময় নেবে না ।সুদীপ্তের   কথা ট্রেডের লোকেরা  তেমন একটা পাত্তা না দিলেও, দিব্য র সোশ্যাল রেপুটেশন কোনো অংশে কম নয়। দিব্য আর সুদীপ্তর বোঝাপড়াটাও ভীষণ সুন্দর ।দিব্য যদি একবার সরাসরি মুখ খোলে, দীপ সত্যি সত্যি ভয়ঙ্কর মুশকিলে পড়ে যাবে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে সুদীপ্তকে খানিকটা ঠান্ডা করে নিজের বাড়ির দোতলায় নিয়ে এলো টি দীপ। ডাইনিং টেবিলে বসে ধীরে সুস্থে কথা বলতে বলতেই রমা এসে দাঁড়ালো ওদের মাঝখানে।আসলে রমা যে রাস্তার দিকের ব্যালকনি থেকে গোলার ভিতরে সুদীপ্ত আর হারুদার যে গোলমাল হচ্ছিল, তার পুরোটাই শুনতে না পেলেও ,দেখতে পেয়েছে ,দীপ প্রথমে সেটা ঠিক বুঝতে পারে নি।সবটা ক্যাজুয়াল ভাবে নেওয়ার ভঙ্গিতে রমাকে চা দেবার কথা বললেও সে কথার ধার পাশ দিয়ে না গিয়ে রমা সোজাসুজি সুদীপ্ত কে বলল ;দাদা,  কি ব্যাপার আমি জানিনা ।জানতে চাইও না ।যদি সত্যিই আপনি পয়সা পান, এই নিন আমার এই হারটা। এটা প্রায় তিন ভরি ওজন হবে। এটা বিক্রি করে আপনার টাকাটা আপনি বুঝে নেবেন।একটা তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে এরপর দীপের দিকে চেয়ে সে  বলে; এটা কিন্তু আমার মায়ের হার। বাপের বাড়ির গয়না ।শ্বশুরবাড়ির গয়না নয়। রমার  হঠাৎ সোনার হার দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাতে একটু হকচকিয়ে গেল প্রদীপ্ত ।তার সপ্তকে   তোলা গলা হঠাৎই একদম খাদে নামিয়ে এনে মোলায়েম গলায় সে বলে উঠলো;   কি করছেন কি বৌদি? আমাকে কি শেষ কালে এই রকম ভাবলেন ?আপনার সাথে আমার কোন পরিচয় নেই। তা বলে আপনার গয়না বিক্রি করে আমি আমার প্রাপ্য টাকা বুঝে নেব ,তেমন মানসিকতার মানুষ ও কিন্তু আমি নই,  অনেকদিন ধরে ,অনেক ভাবে ভালো  মন্দে দীপ দা কে আমার প্রাপ্য টাকা টার  কথা বলেছি ।আমি কিন্তু কেবল আমার নিজের টাকার কথাই বলছি। দিব্যর  টাকার কথা কিন্তু বলতে আমি আসিনি । দিব্যর  টাকা দিব্যর ব্যাপার। সেটা ও বুঝবে ।ওর টাকার ব্যাপারে র মধ্যে আমি ঢুকব না ।আজ বাধ্য হয়ে, দিনের পর দিন দীপ দা এড়িয়ে যাওয়া তে, আপনাদের এখানে এসে টাকার কথা বলতে  হয়েছে।
আমি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। কার্টুন এঁকে সংসার চালাই। বুঝতেই তো পারেন বৌদি ,আজকের বাজারে কার্টুন এঁকে ক পয়সা হয় ।আর কীভাবেই বা সংসার চলে । কাজ করে দেওয়ার পরও যদি কমিটমেন্টের টাকাটা না পাই মাথাটা কি রকম গরম হয়ে যায় বুঝতে পারেন , তা বলে আর যাই হোক, আপনার সোনার গয়না বিক্রি করে প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার মতো অতটা চশমখোর নই।গোটা বিষয়টা আপনার উপরই ছেড়ে দিয়ে গেলাম। দেখবেন যেন প্রাপ্য টাকাটা পাই। আর একটা কথাও না বাড়িয়ে প্রদীপ্ত সোজা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল। রমার অতি নাটকীয়তাতে  পরিস্থিতি যে এত সহজে আন্ডার কন্ট্রোলে চলে আসবে, এটা ভাবতেই পারেনি দীপ। তবে পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে চলে আসার পর ,রমার উপরে তর্জন-গর্জন করতে কিন্তু ছাড়লো না সে। তুমি জানো না ,বোঝো না। কোনো কিছুর ভেতরে থাকো না ।হঠাৎ তোমার বাপের বাড়ির সোনার হার নিয়ে বাইরের লোকের সামনে আমার প্রেস্টিজ পাংচার না করে দিলেই চলছিল না?
রান্না ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে রমা শুধু শান্তভাবে একটা কথাই বলল;গোলাতে  এসে যখন ভদ্রলোক তুমি ওর প্রাপ্য টাকা দিচ্ছ না বলে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করেছিল ,তখন বুঝি তোমার প্রেস্টিজ টা খুব বার ছিল ?আর একটা কথা ও না বলে রমা সোজা ঢুকে গেল রান্না ঘরে।রমার কথায় যেন সম্বিত ফিরে এলো নীরার।এতোক্ষণ কি এসব স্লাইডের মতো ফ্যাশ ব্যক দেখছিল সে? ছোটমাইমা, জোড় পোখরি তেও যে জমিটা কিনেছিল, তার দলিল টা তো তোমার কাছে ই আছে–রমার বরফের মতো ঠান্ডা গলায় বলা কথার জবাব দিতে গিয়ে নীরার মনে পড়ে গেল দীপের বডি তো এখনো নীচের শোরুমেই রাখা আছে।অভ্ররা আসার পর তো বডি নিয়ে শ্মশানে রওনা হবে।
                             :সমাপ্ত:


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।