কলমের খোঁচা

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি – নোট বই


রঞ্জন মুখার্জী:চিন্তন নিউজ:২রা মে:- লিওনার্দো যদি মোনালিসা অথবা লাস্ট সাপার না লিখতেন, রঙের বাটিতে কোনদিন তুলি না ডোবাতেন, তবুও তিনি মানব সভ্যতার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকতেন তাঁর ওই নোটবইয়ের জন্য। সারা পৃথিবীতে এমন কোন শিক্ষিত মানুষ নেই যিনি এই নোটবইয়ের কথা শোনেন নি অথবা সে সম্পর্কে কিছু জানেন না। কি নেই সেই নোটবইতে। কিভাবে টাঁকশালে মুদ্রার ওপর চাপ দিতে হয়, পরিপ্রেক্ষিতের প্রেক্ষিতে কিভাবে দ্বিমাত্রিক চিত্রে গভীরতার আভাস আনা যায়, সিংহের শ্রবণ যন্ত্রের কার্যক্রম, মানবদেহে ফুসফুস বা জরায়ুর কার্যকারিতা, চন্দ্র কলার হ্রাস বৃদ্ধির সাথে জোয়ার ভাটার সম্পর্ক, কেটে ফেলা গাছের কাণ্ডের বলয় বৃত্ত গুণতি করে গাছের বয়স নির্ণয় , লেদ মেশিন, লেন্স ঘষার সহজ পদ্ধতি, হেডো মিটার, ছোটো ছোটো ব্যবহার উপযোগী ঘরোয়া জিনিস, ইত্যাদি , ইত্যাদি।

এবার আসা যাক নোটবুক প্রসঙ্গে। লিওনার্দো তাঁর সারা জীবন ( ১৪৫২ – ১৫১৯) ধরে এই নোট বই গুলি লিখে গেছেন। নোট বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের উপর। লিখেছেন ইটালিয়ান ভাষায়, কিন্তু আদ্যন্ত উল্টো করে, যা শুধু আয়নার সামনে ধরলে পড়া যায়। প্রায় প্রতি পাতায় লেখার সাথে মানানসই ছবি। ভাষার চেয়ে ছবি এঁকে তিনি সহজে বোঝান। লেখার সাথে সাথে এসেছে চিত্রাংকন, তার সাথে এসেছে বিভিন্ন গাণিতিক হিসাব নিকাশ । লিওনার্দোর মৃত্যুর পর একজন গবেষক জে .বি ভেনচুরি ওই পান্ডুলিপির বিধিবদ্ধ পাঠোদ্ধার করেন।

লিওনার্দো এক বিশ্ববিশ্রুত পন্ডিত । তিনি না লেখক, না শিক্ষক, না মূলত বিজ্ঞানী, তিনি একজন শিল্পী। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির জীবন ধারা পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, তিনি এভাবে উল্টো করে লেখা শুরু করেন ২১ বছর বয়স থেকে। তিনি স্বাভাবিকভাবে ছিলেন বাম হাতি, তিনি লিখছেন বাহাতে আবার ছবিতে শেড দিতেন সেটাও উল্টোদিক থেকে। বাহাতে তো অনেকেই লেখেন, কিন্তু তারাতো দর্পণ প্রতিবিম্ব লিখেন না। লিওনার্দো হঠাৎ এই পদ্ধতি অবলম্বন করলেন কি জন্য? নিঃসন্দেহে তার হেতু গোপনীয়তা ।গ্যালিলিওর দুর্ভাগ্য তখনও কল্পনার অতীত, ব্রুনো – র অনাগত দুর্ভাগ্যের ইতিহাস তার অজানা, তবুও তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে তার বৈপ্লবিক চিন্তা-ধারা তদানীন্তন পন্ডিত সমাজ বিশেষ করে চার্চ সম্প্রদায় সহ্য করবে না। তিনি গোপনে কমসে কম ৩০ টি মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করেছেন মানব দেহের অভ্যন্তর জানতে, সেটা ছিল সে আমলে বেআইনি। ধরা পড়লে হয়তো তাকেও জীবন্ত দগ্ধ করা হতো। কি এমন ছিল এই নোটবইতে, যা তিনি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন ?

গতিবিদ্যা: লিওনার্দো কে বলা হয় গতিবিদ্যার জনক, কারণ পূর্ববর্তী কোন বিজ্ঞানী স্থিতিবিদ্যা এবং গতিবিদ্যাকে পৃথক ভাবে আলোচনা করেননি । মহাকর্ষ , বল , ত্বরণ এইসব বিষয় তখন ধারণার অতীত । নিউটনীয় গতিবিদ্যার যে মূলসূত্র পি= এমxসি এই মৌলিক তথ্য তখনও অনাবিষ্কৃত। লিওনার্দো ওই মূল তথ্যটির নাগাল পাননি, কিন্তু বল, শক্তি এবং গতি -র যে পারস্পরিক সম্পর্ক সে সম্পর্কে একটা ভাষা ভাষা ধারণা তার লেখা থেকেই পাওয়া যায়। প্যারাসুট আবিষ্কার প্রসঙ্গেও লিওনার্দোর তত্ব পরবর্তী বৈজ্ঞানিকরা অনুসরণ করেছেন । প্যারাসুট প্রসঙ্গে লেওনার্দো লিখে গিয়েছিলেন “কোন ভাসমান বস্তু বাতাসে ততখানি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যতখানি বাতাস করে ওই ভাসমান বস্তুর ওপর।” ত্বরণ সম্পর্কেও ওই একই কথা। সে ব্যাপারেও তিনি পুরোপুরি ব্যাখ্যা না করতে পারলেও ভাসাভাসা একটা ধারণা দিয়ে গিয়েছেন। এছাড়াও তার নোটবইতে যে বিষয়গুলো বিস্তৃতভাবে পাওয়া গেছে সেগুলো হলো লিভার এর যান্ত্রিক সুবিধা , পুলি – র যান্ত্রিক সুবিধা ইত্যাদি। সব চেয়ে উল্লেখ যোগ্য যে বিষয় টা নিয়ে তিনি অনেকদুর পর্যন্ত এগিয়ে ছিলেন, সেটি হল বিহঙ্গ বিজ্ঞান বা এরোনটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং।

বাতাসের চেয়ে ওজনে ভারী কোনো যান নিয়ে আকাশে পাড়ি দেবার যে প্রয়োগ বিদ্যা , তা নিয়ে তার গবেষণা মনে রাখার মত । এই বিষয়ে তিনি মূল সমস্যা অতিক্রম করতে না পারলেও তার গবেষণা তার চিন্তা ভাবনা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানকে অনেক সাহায্য করেছিল । তার পর্যবেক্ষণ যে শুধু পাখিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, তিনি তিমি মাছের উপরেও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন দীর্ঘ দিন । পাখির লেজ এর ভূমিকা – র সাথে সাথে মাছের পাখনা এবং লেজ এর ভূমিকা নিয়েও দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ নথিবদ্ধ করে ছিলেন । গ্লাইডার এর চিন্তা ভাবনাও তার বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্যারাসুট তৈরি করার দিকে তিনি অনেকটাই এগিয়েছিলেন ।

লিওনার্দোর যুগে এসব ভাবনা করা টাই ছিল কল্পনার অতীত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োগ কৌশল এর হদিস তিনি পান নি এটা সত্যি । তিনি পান নি কোনো আধুনিক ল্যাবরেটরি , তাই তাঁর নাগালের বাইরে থেকে গিয়েছিল কম্বাশন ইঞ্জিনের কৌশল।

সব শেষে বলতেই হবে , সমকালের চেয়ে শুধু কয়েক দশক না , কয়েক শতাব্দী এগিয়ে তিনি চিন্তার জগতে এক বৈপ্লবিক নজির রেখে গেছেন। বহুমুখীনতার বিচারে তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিস্ময়।।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।