দেশ রাজনৈতিক

লক ডাউন শিথিলতা আর সামাজিক প্রযুক্তি — গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ:১লা জুন:- ধর্মস্থান খোলা ঘিরে মমতার অতি আগ্রহ আর বিখ্যাত জায়গাগুলির কর্মকর্তাদের মমতার সুরে গলা না মেলানো– সঙ্ঘের সামাজিক প্রযুক্তির একটি বড়ো সাফল্য।মন্দির খোলার ঘোষণা কে আগে করেছেন, মমতা না মোদি- মন্দির খোলার কৃতিত্বের ভাগীদারিত্বের অংশীদার বেশি হবেন কে? মমতা ? না, মোদি? এই তর্কগুলি র সামনে সাধারণ মানুষদের দাঁড় করিয়ে দিয়ে পরস্পর যুযুধান বলে নিজেদের পরিচয় দিতে অভ্যস্থ দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ই সাম্প্রদায়িকতাকে নিজের নিজের টি আর পি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন বেশ ভালোভাবেই।ধর্মস্থানগুলি খুললেই এই লক ডাউনে কাজ হারানো মানুষ গুলো কাজ ফিরে পাবে কি না, এই প্রশ্নে শাসক নীরব।মানুষ ভরপেট খেতে পাবে কি না- এইপ্রশ্নের ধারপাশ দিয়ে ও শাসক হাঁটছেন না।

তাহলে কেন ধর্মস্থান ঘিরে কৃতিত্ব নেওয়ার প্রশ্নে মমতা আর মোদির ভিতরে এই তীব্র প্রতিযোগিতা? গোটা দেশের রাজ্যগুলির প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কেন্দ্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আলাপ আলোচনার নির্যাস জেনে ই কি কৃতিত্বের ভাগীদারিত্বে থাবা বসাতে মমতা ধর্মস্থান ঘিরে কেন্দ্রের অবস্থান ঘোষণার আগেই নিজের অবস্থান ঘোষণা করলেন? আর কেন্দ্রের অবস্থান না জেনে মমতার অবস্থানে সায় দিয়ে ফেললে পাছে কেন্দ্র রেগে যায়, প্রসারিত উদার হস্ত সঙ্কুচিত করে ফেলেন, তাই ই নানা প্রথম সারির ধর্মস্থান গুলি কার্যত মমতার ঘোষণার বিপরীতে গিয়ে একটা স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণার ভিতর দিয়ে কার্যত মমতাকেই চ্যালেঞ্জ জানালেন?
ধর্মনারপেক্ষতার প্রশ্নে নয়।ধার্মিক মানসিকতার প্রশ্নে তো নয় ই।ধর্মস্থান ঘিরে মমতা চিরদিন ই তাঁর নিজের অবস্থান কে পরিচালিত করেন ভোট রাজনীতির হিশেব নিকেশের ভিতর দিয়ে।মমতা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে যে ভাবে ধর্মস্থানকে ঘিরে অবস্থান নেন, তারসঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র বিজেপি নেতৃত্বের।কংগ্রেসের কিছু কিছু নেতা ভোটের মুখে একটু আধটু ধর্মস্থানে যান।তিলক কাটেন।ধর্মীয় পোষাক পড়েন।এর বাইরে তাঁরা কখনো ই কথায় কথায় ধর্মীয় লব্জ ব্যবহার করেন না।মমতা কয়েকটি ধর্মীয় শব্দাবলীর বিকৃত উচ্চারণ, ধর্মীয় পোষাকের ছদ্মবেশের ভিতর দিয়ে নিজের ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের উদ্দেশ্য কে মেলে ধরেন খুব কৌশলে। এইভাবে কখনো তিনি হাজিবিবি সাজেন , কখনো বা মা গোঁসাই , আবার কখনো নিষ্ঠাবতী মতুয়া রমণী হন।

শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে শ্রীরামকৃষ্ণের অনবদ্য উপমা সহযোগে এই ভেক ধারণ দিয়ে তীব্র কষাঘাত আছে।এক বহুরূপী সাধুর ভেক ধরে মানুষের মনোরঞ্জন করবার পর সমবেত জনতার ভাতর থেকে কেউ কেউ সেই বহুরূপীটিকে সামান্য অর্থ সাহায্য করতে চাইলেন।বহুরূপী টি সেই অর্থ নিলেন না।সাধু পোষাক বদল করে, মুখের রঙ তুলে , সাধারণ আটপৌড়ে পোষাক পরে এসে গৃহস্থের কাছে ফয়সা চাইলেন তিনি। এই উপমাটি দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বোঝাচ্ছেন; ভেকধারী অবস্থাতেও কখনো ঈশ্বরকে ঘিরে , সাধুসন্তকে ঘিরে প্রতারণা করতে নেই।

মমতার কথায় কথায় ধর্মকে নয়, ধর্মের আবেগকে, ধর্মকে ঘিরে সাধারণ মানুষের অন্তরের ভালোবাসাকে ভোট রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার আর অজয় সিং বিশোয়াতের স্বঘোষিত ‘ যোগী’ আদিত্যনাথ হয়ে গিয়ে চরম মুসলমান বিদ্বেষ– তার ভিতরে তো কোনো চরিত্রগত ফারাক নেই।এই ফারাক না থাকার কারণেই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে স্বঘোষিত ‘ যোগী’ , তাঁর নিজের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে শ্রম আইন শিথিল করার নামে কার্যত শ্রম আইনের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটান।এ নিয়ে যেমন নীরব থাকেন মোদি , তেমনিই প্রগলভ মমতাও এ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ভাবে একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেন না।কোনো রাজ্য সরকার যে কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া শ্রম আইন, যেটি জাতীয় স্তরের একটি আইন, সেটির শিথিলতা আনতে পারে না- এই বিষয়টি ও মোদি আর মমতার নানা বিষয় কে ঘিরে চাপান উতোরের ফলে প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছে।মোদি তাঁর একাধিক জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ, ‘মন কি বাত’ কোথাও ই এই উত্তরপ্রদেশ সহ বিজেপি পরিচালিত রাজ্য গুলিতে শ্রম আইন লঘু করবার উপক্রম ঘিরে একটা শব্দ উচ্চারণ করেন নি।বস্তুত কোনো রাজ্য সরকার ই এই আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র হেরফের কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া করতে পারেন না।অথচ কি মোদি , কি যোগী – প্রত্যেকেই এমন ভাব করছেন , যেন , এই আইনের অদলবদল সম্পর্কে তাঁরা বিন্দুবিসর্গ ই জানেন না।

এই যে বিজেপি শাসিত রাজ্য গুলিতে শ্রম আইন শিথিলের ভিতর দিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনটির ই কার্যত গঙ্গাযাত্রা ঘটানো , কিংবা, মানুষের ভারতের সংস্থানের দিকে এতোটুকু দৃষ্টিপাত না করেই, ধর্মস্থান খুলে দিয়ে কোবিন ১৯ জনিত সঙ্কটকে একদিকে তীব্র করে তোলা, আর একদিকে সাম্প্রদায়িকতার রকমফেরে উৎসাত প্রদান, এই প্রতিটি বিষয়ের ভিতরেই রয়েছে আর এস এসের সুনিবিড় সামাজিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। এই সামাজিক প্রযুক্তির বিষয়টি এই কারণেই খুব স্পষ্ট ভাবে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মমতার ধর্মস্থান খোলার ঘোষণাকে কার্যত বিরোধিতা করলেন প্রথমসারির ধর্মস্থান পরিচালকেরা। এইসব ধর্মস্থানগুলির পরিচালকেরা যে মমতার আজ হাজিবিবি তো কাল ইসকনে গিয়ে রাস্তা য় ঝাড়ু দেওয়া তো পরশু মতুয়া বলে নিজেকে ঘোষণার ফলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তুঘলকীপনার সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই নিজেদের মেলাতে পারছেন না- তা তাঁদের মমতার ঘোষণার অল্প সময়ে পরেই সেই ঘোষণা অমান্য করবার সিদ্ধান্তের ভিতরে পরিস্কার হয়ে গেল

এই সিদ্ধান্ত কি ধর্মস্থান গুলির পরিচালকেরা খুব স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে নিলেন? নাকি , তাঁদের কাছে মমতার প্রতি নির্ভরতার দিকটা এখন ভয়ঙ্কর রকম তলানি তে ঠেকেছে? তাই তাঁরা মমতাকে আর ভরসা করতে পারছেন না? তাঁদের ভরসার জায়গাটা এখন কেন্দ্রীয় সরকার এবং সেই সরকার যে রাজনৈতিক দল পরিচালনা করছেন, আর এস এসের রাজনৈতিক সংগঠন, সেই বিজেপির প্রতি এখন অনেক বেশি? তাই মমতার ঘোষণার অল্প সময়ের ভিতরেই এমন একটা মমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারলেন এইসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালকেরা?

ধর্মস্থান পরিচালনার ক্ষেত্রে ও নাকি এখন মমতার আচার আচরণ ঘিরে একটা বিতর্কের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ঘিরে মমতার প্রতি সাধারণ মানুষের যে ক্ষোভ , বিরক্তি, হতাশা – তারসঙ্গে তৈরি হচ্ছে দুর্নীতির বিষয় টিও।কালীঘাট মন্দির, মমতার কাছের মানুষদের ভূমিকা ঘিরে প্রশ্নটিকে ঘিরে নাকি বড় রকমের অভিযোগ নাকি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের দিকে ধাওয়া করছে? খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে নাকি এইসব অব্যবস্থা ঘিরে অভিযোগ জানিয়ে কোনো ফল পান নি এমন কিছু মানুষ, যাঁরা সংশ্লিষ্ট অব্যবস্থার শিকার।অভিযোগের সত্যতা থাকুক, বা, না থাকুক, এইসব ধর্মপ্রতিষ্ঠানের লোকজন যে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করবার মতো সাহস দেখাতে পারছেন, তার পিছনে কোনো রাজনৈতিক সমীকরণ আছে কি না- তা নিয়ে আমাদের ভাবা বিশেষ জরুরি।

বেলুড় মঠে মমতা তাঁর শিকড় বিস্তারের অনেক চেষ্টা করেছেন।মমতার চেষ্টা বিশেষ যে সফল হয় নি, মোদির নিজের সামাজিক প্রযুক্তি ই যে সেখানকার ক্ষমতাসীন সাধুদের বেশি প্রভাবিত করেছে– তা এখন দিনের আলোর মত পরিস্কার। একটা সময়ে বেলুড় মঠের ক্ষমতাসীনেরা মমতাকে এতোটাই প্রাধান্য দিয়েছিলেন যে , তাঁদের বরিষ্ঠ সন্নাসীদের মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে পর্যন্ত দেখা যেত।

মমতার বেলুড় মঠে শেকড় বিস্তারের চেষ্টাটা কার্যত হাইজ্যাক করে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের উপর( সার্বিক অর্থে এই ‘ বাঙালি ‘ শব্দটি বলা হল, কারণ, জন্মসূত্রে মুসলমান, মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা অংশ এই ধারাতে আছেন) রামকৃষ্ণ মিশনের একটা প্রভাব সুবিদিত।এই প্রভাবের দ্বারা বাংলার বাইরে মধ্যবিত্ত হিন্দুকে নিজেদের শিবিরভূক্ত করবার সুযোগ টা আর এস এস – বিজেপি ছাড়ে নি।ফলে একটা বিপুল অঙ্কের অনুদানের ভিতর দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটির সামান্য মমতার প্রতি ইতিবাচক মানসিকতাকে সম্পূর্ণ নিজেদের পালে টেনে আনতে এখানে আসরে নেমেছিলেন খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী। লক ডাউন ঘিরে মমতার কেন্দ্রের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়ার মানসিকতায় যে মুখ্যমন্ত্রীকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গ দিল না রামকৃষ্ণ মিশন– এই রাজনৈতিক সমীকরণটি কিন্তু লুকিয়ে আছে সঙ্ঘের হয়ে সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং য়ে প্রধান কো অর্ডিনেটর হিশেবে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদির ভূমিকা এবং সাফল্য।

প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োগ ও প্রসারের লক্ষ্যে মমতার আত্মনিবেদনের দৌলতে এই লক ডাউন কালে সুপ্ত মুসলমান বিদ্বেষ এখন প্রায় সঙ্ঘ – বিজেপির সুরেই সুর মিলিয়েছে।লক ডাউনের ভিতরে ও দুই এক জায়গাতে বিক্ষিপ্ত ভাবে সাম্প্রদায়িক সমস্যা তীব্র হয়েছে।সংঘর্ষ হয়েছে।সেইসব সমস্যা সমাধানে রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা জনমানসের একটা বড়ো অংশেরই ভিতরে ভুল বার্তাকে স্থায়ী হতে দিয়েছে।প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ভাবে রাজ্য সরকারের সমস্যা সমাধানে পঙ্গুমত্ব কে মোকাবিলা করতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।ফলে মানুষের মনে গুজব আরো বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলাতে যে রাজনীতিক কার্যক্রম শাসকের নেওয়া দরকার ছিল, শাসক তার ধারপাশ দিয়েও হাঁটে নি। নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে বিরোধীদের কাছ থেকে ও কোনো সহযোগিতা নেয় নি।ফলে বিজেপি তাদের সামাজিক বিভাজন ছড়াবার সুযোগটা অনেক বেশি পরিমাণে পেয়ে গিয়েছে।

বাংলাদেশে একদম ভূমিস্তর থেকে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত নির্বিচিত জনপ্রতিনিধি আছেন প্রায় আটষট্টি হাজার।এই করোনা এবং লক ডাউনে সে দেশের সরকার সাধারণ মানুষদের জন্যে দেশের শষ্য ভান্ডার খুলে দেন।চাল, ডাল ইত্যাদি শষ্য সাধারণ নাগরিকদের তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে মাত্র শ তিনেশ ( শাসক – বিরোধী মিলিয়ে) জনপ্রতিনিধির ভূমিকা ঘিরে অভিযোগ উঠেছে সে দেশে।শাসক শিবির ইতিমধ্যেই তাঁদের দিকের অভিযোগ ওঠা জনপ্রতিনিধিদের ভিতর প্রায় সত্তর জন কে দলীয় স্তরেই কেবল শাস্তি দেয় নি, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্ত ও শুরু করেছে।

আমাদের জাতীয় প্রেক্ষিতে বিজেপি কিংবা রাজ্যের ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসকে ঘিরে কি আমরা এমন কোনো প্রত্যাশা আদৌ করতে পারি? কখনো ভাবতে পারি, বিজেপি বা তৃণমূল সরকার, প্রতিবেশি বাংলাদেশ সরকারের মত আদৌ এইরকম কোনো ভূমিকা নিতে পারে চাল চোরদের সম্পর্কে?


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।