কলমের খোঁচা

লেনিনের জীবনে ক্রুপস্কায়া- র প্রভাব —মৈত্রেয়ী দাস


চিন্তন নিউজ:৯ই মে:- “দুজনের দেখা হল…..১৮৯৪ সালে এক মার্কসবাদী আলোচনা চক্রে।সেটাই স্বাভাবিক।মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে আজীবন লড়াকু দুই সহযোদ্ধার প্রথম দর্শনের প্রেক্ষাপট আর কিই বা হতে পারে!

ক্রুপস্কায়ার জিমনাসিয়ামের বান্ধবীAriande Tyrkova বলছেন,লম্বা শান্ত ক্রুপস্কায়া চরিত্রে চিরকালই ছিল গভীরতা,কোনকালেই কৈশোরের চপলতায় ছেলেদের সঙ্গে চটুল প্রেমের ভান করা ইত্যাদি তাঁর স্বভাবে ছিল না।আর ছিল নিজস্ব চিন্তাভাবনা বা আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা।জীবনের কোন পদক্ষেপেই ক্রুপস্কায়া তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হননি।
নাদেজহদা ক্রুপস্কায়ার বাবা Konstantin Ignatevich Krupski ছিলেন রাশিয়ান মিলিটারী অফিসার।পরিবারটি ছিল একদা উচ্চশ্রেণিভুক্ত ক্রমদরিদ্রক্রুপস্কায়ার মা এলিজাভিটা ভ্যাসিলিভনা তিস্ট্রোভা ছিলেন ভূমিহীন রাশিয়ান অঢিজাতদের কন্যা।প্রাকবিবাহ যৌবনে তিনি পেশায় ছিলেন গভর্নেশ।বাবা -মার কারণেই ক্রুপস্কায়া শৈশব থেকেই প্রতিবাদী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন।পিটাসবার্গের এক বিশিষ্ট বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উদার শিক্ষায়(‘উদার’কেননা এই স্কুলে বেশ কিছু প্রাক্তন বিপ্লবী ছিলেন) তিনি শিক্ষিত হন।একনিষ্ঠ ও আজীবন ছাত্র ভূমিকা য় ক্রুপস্কায়া স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন।কাজেই মার্কসবাদ পাঠচক্রে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন,মার্কসবাদী গ্রন্থসমূহ তখন সাবেক রাশিয়ায় নিষিদ্ধ।বইগুলি বিপ্লবীরা ভূগর্ভস্থ গ্রন্থাগারে।রাজরোষে পড়ার ভয়-অনিশ্চিত জীবন—কোনকিছুই ক্রুপস্কায়াকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি।
আলোচনা গোষ্ঠীর প্রথম আলাপে ক্রুপস্কায়া লেনিনের বক্তব্যে মুগ্ধ হন।কী আশ্চর্য !প্রথম সাক্ষাতে লেনিনের ব্যক্তত্ব তাঁকে মুগ্ধ করেনি!লেনিন এবং ক্রুপস্কায়া তাঁদের কোর্টশিপ নিয়েবিশেষ মুখ না খুললেও এই কথাটি’প্রথম দেখা’র স্মৃতি রোমন্থনে ক্রুপস্কায়া বলেছেন।
“কিছু নাহি ভয়,জানি নিশ্চয় তুমি আছ,আমি আছি…”
১৮৯৬-এর অক্টোবরেলেনিন গ্রেপ্তার হলেন।কয়েক মাসের ব্যবধানে ক্রুপস্কায়াও।কারাগারে যোগাযোগ ছিলনা।স্থলপথ-জলপথ-আকাশপথে যোগানা হলেও দুটি মন একে অপরের জন্য কেবলমাত্র নয়,আদর্শের জন্যই মূলত জোট বাঁধার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।ইতোমধ্যে লেনিনের সাইবেরিয়ায় নির্বাসনদণ্ড হয়েছিল।ঠিক এই সময় লেনিনের এক ‘গোপন নোট’ক্রুপস্কায়ার কাছে পৌঁছায় তাঁর (ক্রুপস্কায়ার) মা মারফৎ।লেনিনের ‘প্রেম প্রস্তাব ‘ বলে কথা!আর পাঁচজনের মত তা কেবল ফুল-পাখি-প্রকৃতি গদগদ প্রেমনিবেদন মাত্র নয়।বক্তব্য হল-ক্রুপস্কায়া যদি নিজেকে দেনিনের বাগদত্তা বলে চিহ্নিত করেন,তবে জার প্রশাসন লেনিনের সাথে সাইবেরিয়াসঙ্গী হবার অনুমতি দিতে পারে ক্রুপস্কায়াকে।বিচারের গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী ক্রুপস্কায়াও তখন বুঝতে পারছিলেন আসন্ন তাঁরও সাইবেরিয়ায় নির্বাসনদণ্ড।1898 সালে ক্রুপস্কায়া সে অনুমতি পান শর্তসাপেক্ষে। শর্ত হলো -ক্রুপস্কায়া লেনিনের কাছে পৌঁছালেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে।
স্মৃতিচারণায় ক্রুপস্কায়া বলছেন,নির্বাসনের দিনগুলিতে তিনি এমনকি অনুবাদের যে কাজ করতেন তা ও ছিল প্রেমময়।যদিও শ্রমের পেশাদারী বিষয়টি নিতান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে ছিল।তবুও পেশার প্রতি তো বটেই,প্রেমের প্রতিও তাঁর অবিচল আনুগত্য বজায় ছিল।
শোনা যায়,ক্রুপস্কায়া গ্রাভস্ রোগের শিকার ছিলেন,সে কারণেই লেনিন দম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান।
আগে ১৯০০ সালে লেনিন,পরেে ক্রুপস্কায়া ১৯০১ সালে মুক্ত হন এবং দাম্পত্য জীবনের সঠিক সূচনা হয়।
“কমরেড মানে পাশাপাশি চলা….

১৯০৫ সালে লেনিন দম্পতি রাশিয়ায় ফিরে আসেন।শারীরিকভাবে অসুস্থ ক্রুপস্কায়া তখন লেনিনের ব্যক্তিগত সচিব,দলের সংবাদপত্র ও জার্নালের
সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।১৯০৩ সাল থেকে ক্রুপস্কায়া রাশিয়ান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির বলশেভিক গোষ্ঠীর সর্বক্ষণের ভাতাবিহীন কর্মী ছিলেন।১৯০৫ সালেই ক্রুপস্কায়া কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক হন,তবে ১৯০৫ সালে বিপ্লবের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর তিনি ফ্রান্সে গিয়ে কয়েকবছর শিক্ষকতা করেন।
“বিপ্লব স্পন্দিত বুকে……”

১৯১৭-র বিপ্লবের পরে ক্রুপস্কায়া দেশের প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা বিভাগের ভোকেশনাল শিক্ষার দায়িত্ব নেন।ডেপুটি পদে আসীন হন ‘আনাটেলি লুনাচারস্কি’তে এবং ‘পিপলস্ কমিসার ফর এডুকেশন ‘-এ।তাঁর মৌলিকত্ব তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন সোভিয়েত গ্রন্থাগার বিকাশের ক্ষেত্রেও।

১৯২৪ সালে ক্রুপস্কায়া সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন,১৯৩১-এ সুপ্রিম সোভিয়েতের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ঐ একই সালে তিনি ‘সম্মানীয় নাগরিক’ হিসাবে বিবেচিত হন।
“সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমার “

১৯২৪ সালে লেনিনের প্রয়াণের পর ক্রুপস্কায়া ট্রটস্কির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এবং তাঁর ভূমিকা কেবলমাত্র ‘বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা” ছিল না।বরং তা ছিল নিয়মিত দর্শন -চিন্তন ও পঠন প্রসূত।

1936 সালে ‘গর্ভপাতের উপর নিষেধাজ্ঞা ‘প্রয়োগে সোভিয়েত সরকার সচেষ্ট হলে তিনি এর যুক্তিসহ বিরোধিতা করেন।এতটাই মুক্তমনা এবং আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন ক্রুপস্কায়া।
বিপ্লবের পরবর্তী দিনগুলিতে ক্রুপস্কায়া ব্যক্তিগতভাবে জোর দিতেন ‘যুব সংগঠন ও শিক্ষার সমস্যা ‘-র উপর।গ্রন্থাগারকে শিক্ষার উৎস হিসেবে ব্যবহার করা,গ্রন্থাগারের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি,গ্রন্থাগারকে জনহৃদয়ে স্থান করে দেওয়ানোর জন্য ক্রুপস্কায়া অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
লেনিনের ব্যাপারে ক্রুপস্কায়া কেডলমাত্র তাঁর স্বামী হিসেবে শুধুমাত্র নয় চিন্তাবিদ ও দেশনায়ক হিসেবে ও অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি রাখতেন।1905-এর ব্যর্থ বিপ্লবকে বুঝতে গেলে বা লেনিনের লেখা ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বইটির প্রেক্ষিত বুঝতে গেলে যে লেনিনের লেখা পঞ্চ পত্রের সমাহার ‘Latters from Afar’ পড়া জরুরী তা ক্রুপস্কায়াউল্লেখ করেছেন তাঁর ‘Riminiscences of Lenin’ বইয়ে।
প্রকৃত প্রস্তাবে লেনিন দম্পতির জীবনাচরণে হয়তোতথাকথিত,প্রত্যাশিত প্রেমের ঘনঘটা ছিলনা,কিন্তু ছিল আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা, নূতন সমাজ গঠনের স্বপ্নকে রক্ষা করার দৃঢ় সংকল্প।
তাঁদের লন্ডন প্রবাসের দিনগুলির টুকিটাকি স্মৃতিচারণায় ক্রুপস্কায়ার কলমে সদ্যদাম্পত্যের কিছু উল্লেখ থাকলেও তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি লেনিন লন্ডনের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ঘুরতেন আর আত্মমগ্নভাবে উচ্চারণ করতেন এক শহরের অভ্যন্তরে দুই শহরের অবস্থান।বিত্তবান ও বিত্তহীনদের।
বিবাহিত জীবনের কোন পর্যায়েই লেনিনের ছায়ামাত্র নন। নিজস্বতা ছিল, রাজনৈতিক গভীরতা ছিল,আদর্শে দৃঢ় আস্থা ছিল।এমতাবস্থায় বহু দাম্পত্যেই একটি ‘ইগো ‘ সমস্যা জন্ম নেয়।কিন্তু প্রবল লেনিনবিদ্বেষীও বলবেন না সে পরিস্থিতি কখনো এ দাম্পত্যে তৈরী হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেই শেষ করবো,
ক্রুপস্কায়া বোধহয় বাংলা জানলে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করতেন,-
“আমার প্রেম রবিকিরণ হেন/
জ্যোতির্ময় মুক্তি দিয়ে তোমায় ঘেরে যেন।”


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।