কলমের খোঁচা বিদেশ

ক্যাথরিন জনসন- হিডেন ফিগার


সূপর্ণা রায়:চিন্তন নিউজ:১০ইমার্চ:–কালো মেয়ের মহাকাশ জয়__ক্যাথরিন জনসন। ২০১৬ সালে অস্কার মনোনয়ন পাওয়া”হিডেন ফিগার্স”সিনেমার আগে কজনই বা জানত এই কৃষ্ণাঙ্গ গনিতবিদের নাম।। পাঁচের দশকের গোড়ার কথা।। আমেরিকার মতো উন্নত দেশে বিভিন্ন জটিল গবেষনায় কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হয়েছে। কিন্তু যন্ত্র থেকে পাওয়া তথ্যের থেকে মানুষের হাতের গননাকে অনেক বেশি ভরসা করা হতো তখন।। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থাও এর ব্যাতিক্রম ছিল না।। মহাকাশ অভিযানের নানা জটিল গবেষনা ও গননার কাজ তখন কাগজ কলমেই করতেন নাসার গবেষকেরা।।যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ক্যাথরিন জনসন।। তাঁরা জানতেন একটা ভুল মানে বিপুল বিপর্যয়।।তাই কার্যত দিনরাত এক করে বছরের পর বছর অজস্র জটিল অঙ্ক কষে গবেষণা থেকে শুরু করে আস্ত একেকটা মহাকাশ অভিযানকে সাফল্যের পথ দেখিয়েছেন ক্যাথরিন।।

অথচ ২০১৬ সালের আগে পর্যন্ত ক্যাথরিন ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে।।২০১৬ সালে তাঁর জীবনী নিয়ে তৈরি হয় হলিউডের ছবি “হিডেন ফিগার্স”। তারপরই গোটা দুনিয়ার সামনে আসে এই ” মানব কম্পিউটার”এর কৃতিত্ব।।মারগট লি শেটারলি নামে আর এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা হিডেন ফিগার্স নামে বইটি লেখেন। বইটি প্রকাশের একবছর পর একই নামে হলিউড থেকে ছবিটি মুক্তি পায়।।

তখনকার দিনে আফ্রো_মার্কিন পরিবারের মেয়েদের অষ্টম শ্রেণীর পর আর পড়তে দেওয়া হত না। তা স্বত্ত্বেও ক্যাথরিন ষরা কীভাবে যাবতীয় বাঁধা টপকে নাসায় কাজ করার সুযোগ পান এবং সেখানে গিয়ে কি প্রচন্ড জাতি,বর্ন ও লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হন, তারই গল্প বলে হিডেন ফিগার্স।এই ক্যাথরিন নাসার প্রথম চন্দ্র অভিযানের আগে চাঁদের কক্ষপথ নিয়ে সমস্ত হিসাব নিকাশ করার মূল দায়িত্বে ছিলেন।। আর এই হিসেবের উপর নির্ভর করে আমেরিকার প্রথম চন্দ্র অভিযান।।

১৯৬২ সালে প্রথম পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমণ করতে মানুষ পাঠিয়েছিল আমেরিকা।সেই মহাকাশযানের আরোহী ছিলেন জন গ্লেন।। প্রথম কোন আমেরিকান হিসেবে তিনিই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছিলেন।। ততদিনে নাসায় এসে গেছে ডিজিটাল কম্পিউটার।।সব হিসেব নিকেশ করা হয় কম্পিউটারে।। কিন্তু তারপর‌ও ভরসা পাননি গ্লেন।। তিনি চুড়ান্ত যাচাইয়ের জন্য ক্যাথরিন এর সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন।।। গণিতবিদ হিসেবে এতটাই নির্ভরযোগ্য ছিলেন ক্যাথরিন।। এই প্রসঙ্গে ২০১৭ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্যাথরিন বলেন, গ্লেন জানতো তার জন্য এই হিসাব নিকাশের কাজটি আগেই করা হয়েছে।। তিনি বলেন তাঁর উপর খুব ভরসা ছিল গ্লেন এর।।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে যখন মহাকাশ জয় নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে, তখন ক্যাথরিন ও তাঁর সহকর্মীরা মানুষ বিহীন রকেট উৎক্ষেপণ এর হিসাব নিকাশ কষতেন।। পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ, মহাকাশ যানের নিরাপত্তা, গতিবিধি ইত্যাদি গানিতিক হিসাব নিকাশ তখন মেয়েরাই করতেন।। আর এইসব জটিল হিসাব নিকাশ হত খাতা পেন্সিল ও যান্ত্রিক গননা যন্ত্রে।। ক্যাথরিন ছিলেন এই কাজে অসম্ভব দক্ষ।। নাসায় তাঁকে কম্পিউটার বলা হতো।। কিন্তু এই সময় আমেরিকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বর্ণবাদের স্রোত।। নাসার মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কৃষ্ণাঙ্গ সহকর্মীদের জন্য আলাদা কাজের জায়গা।। খাওয়া ও বিশ্রাম এর জায়গা ছিল শ্বেতাঙ্গ দের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।। তাঁদের অফিসের সামনে লেখা ছিল “কালার্ড কম্পিউটার্স”।

ক্যাথরিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন এসব তিনি খুব ভালো ভাবে জানতেন কিন্তু পাত্তা দেন নি কোনদিনই।। তিনি শুধু তাঁর কাজটুকু করতে চাইতেন।। সেটা তাঁর গবেষণার কাজ।। নাসায় তিনি কাটিয়েছেন তেত্রিশটি বছর। ১৯৮৬ সালে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত ক্যাথরিন কাজ করেছেন মহাকাশ প্রযুক্তিবিদ হিসেবে।। তার আগে ১৯৫৩_১৯৫৮ অবধি তাঁর কাজ ছিল মুল্য গানিতিক হিসাব নিকাশ।।পদের নাম ছিল কম্পিউটার।১৯৬১ সালের ৫ ই মে আ্যলান শেফার্ডের মহাকাশ ভ্রমণের গতিপথ তিনিই হিসাব করেছিলেন।।একই বছর বুধ অভিযানের লঞ্চ উইন্ডোর গানিতিক হিসাব তাঁর হাতে।।

১৯৭০ সালে আ্যপেলো _১৩ চান্দ্র অভিযানে একটি দূর্ঘটনা ঘটতে চলেছিল কিন্তু ক্যাথরিন এর গবেষনা নভোচারী দের নিরাপদে ফিরিয়ে এনেছিল।। হালের মঙ্গল অভিযানে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ২০১৫ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে আমেরিকার সর্বোচ্চ অসামরিক সন্মান “প্রেসেডেনশিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম” দেন।। এই মহীয়সী মহিলা ২৪ শে ফ্রেব্রুয়ারি সোমবার ১০১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।