কলমের খোঁচা

উপন্যাস কলির রাধা পর্ব- ১ — গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ ৩১শে মার্চ। ডোপামিন দিয়েও যখন দীপাঞ্জনের ব্লাড প্রেসার টা কিছুতেই উঠছে না, তখন কপালে একটা চিন্তার ভাঁজ পড়ল ডাক্তার বারীন আচার্যের। আসলে দীপাঞ্জনের প্লেট লেটের এর রিপোর্টটা সকালে শোনবার পর ই ওকে আর বাড়িতে রাখা নিরাপদ মনে করেন নি বারীন।রমার কাছ থেকে ফোনে ব্লাড রিপোর্ট টা শুনেই হরিপুর চৌমাথায় কৃষ্ণ ফার্মেসির নার্সিংহোমে দীপাঞ্জন কে এডমিট করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ওর ছোট মামা ডাক্তার বারীন আচার্য।ভাগ্নে দীপের প্রায় এক সপ্তাহ ধরে জ্বর।ফোনেই ওকে প্রথমে প্লেন প্যারাসিটামল খেতে বলেছিলেন বারীন। নীরার কাছ থেকে প্রথমে অবশ্য দীপের জ্বরের খবর টা সে চেপেই গিয়েছিল।শুনলেই তো দীপকে দেখতে নীরা ছুটবে। আর নীরা গেলেই তো মুখ হাঁড়ি হয়ে যাবে রমা।শুধু রমা কেন, ছোড়দি ও যে ঠারে ঠোরে দু কথা বলবে না, তার গ্যারান্টি কে দিতে পারে?বারীন বোঝে, সুবিধে অসুবিধে , কোনো কিছুতেই রমা ঠিক তাদের ফোন করতে চায় না ।রমার যোগাযোগের বাঁধনটা এই আলগা করার বিষয়টা ঘিরে বারীনের ভিতরে তেমন একটা রিয়াকশন ও হয় না। বরংচ রমা যে খুব একটা যোগাযোগ রাখতে চায় না , এটা বারীন কে বেশ খানিকটা খুশি ই করে ।কিন্তু দীপ? দীপ যে কোনো অবস্থাতেই, যে কোনো ছুতো নাতাতেই ছোট মামা আর ছোট মামীর পরামর্শ ছাড়া এক পাও হাঁটবে না , তা সে অসুখ বিসুখ ই হোক, নিজের ব্যবসার টিট বিটস ই হোক ,কিংবা সিনেমা তৈরি করার পাগলামোই হোক।

প্যারাসিটামল খেয়ে দু তিন দিনে ও জ্বর নামেনি দীপের ।ইতিমধ্যেই নসিয়া গ্রো করেছে। উইকনেস টাও বেশ বেড়েছে।দীপের ফোনে শপ এ সব খবর শুনেই , ফোনে অ্যাজিথ্রোমাইসিন এডভাইস করে দিয়েছিল বারীন।আসলে অ্যাজিথ্রোমাইসিনের যারা ইস্টার্ন রিজিয়ানের সোল ডিস্ট্রিবিউটর , সেই হেক্সমেডের মালিঈ শ্যামচাঁদ সাক্সেনা কিছুদিন আগে ‘সোনার বাংলা’ তে একটা কনফারেন্স কাম ককটেল পার্টাতে ওদের ভিয়েনায় কনফারেন্স করে করাতে নিয়ে যাওয়ার অফার দিয়েছিল। তাই ইউরিনারি ট্রাকের ইনফেকশন থেকে শুরু করে দেহাতি মেয়েরা কোনো জটিল গাইনোকলজিক্যাল সমস্যা নিয়ে এলে ও একধার থেকে হেক্সমেড কোম্পানির অ্যাজিথ্রোমাইসিন প্রেসক্রাইব করে বারীন ভিয়েনার হাতছানিতে। তাই নিজের ভাগ্নে দীপ কেও নিস্তার দিতে পারে নি সে । কাল রাতেই যখন শুনলো; অ্যাজিথ্রোমাইসিন কোনো কাজই করেনি একবার গিয়েছিল ছোড়দির বাড়িতে। দীপ কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। উঠে বসার ক্ষমতাটুকু ও নেই ।চোখের নীচটা দেখে বোঝা যাচ্ছে হিমোগ্লোবিন লেভেল ভয়ঙ্কর রকম ভাবে কমে গেছে। প্রেসক্রিপশন টেনে খসখস করে রক্তের কতগুলো পরীক্ষা লিখে দিয়েছিল ।সেই রিপোর্টটাই একটু আগে রমা দিল ফোনে ।প্লেটলেট যে নামছে সিমটমটা ক্রিনিক্যালি দীপ কে দেখে না বুঝলেও বারীন বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারছিল যে ,একটা জটিল সমস্যা কিন্তু তৈরি হয়েছে। এই জটিলতায় দাও মারতে গেলে খেমটা নাচ টা তো একটু ঘোমটা দিয়ে নাচতেই হবে ! তাই গলায় উদ্বেগের সবটুকু প্রচেষ্টা ঢেলে দিয়ে দীপ কে ইমিজিয়েট নার্সিংহোমে অ্যাডমিট করার অ্যাডভাইস দিল বারীন। দীপের প্লেটলেট মারাত্মক নেমে গেছে , ওকে লোকাল নার্সিংহোমে ইমিজিয়েটলি ভর্তি করা দরকার —খবরটা বড়দির ছেলে সায়ন্তন কে নিজেই ফোন করে দিল বারীন।সায়ন্তনের খানিকটা এনগেজমেন্ট আছে বাইপাসের ধারে একটা বড়োপ্রাইভেট হাসপাতালে । সায়ন্তন ফোনে দীপ কে নিজের গ্রিপের ভিতরে থাকা প্রাইভেট হসপিটাল টাতেই নিয়ে আসার কথা বললেও বারীন যুক্তি দিল ;প্লেটলেটের এই অবস্থা। নিশ্চয়ই বি পি টাও ও মারাত্মক নেমে গেছে। বি পি টা একটু তুলে ,খানিকটা স্টেবল করে, তারপর নিয়ে যাই তোর ওখানে ।
ছোট মামার যুক্তিটা খুব লজিক্যাল লাগলো সায়ন্তনের ।ও বলল; ঠিক আছে আমি সবার অ্যারেঞ্জমেন্ট করে রাখছি। তুমি বিকেলের ভিতরেই এই নিয়ে চলে এসো দীপ দা কে।
ইনফিউশন পাম্পে ডোপামিনের ডোজটা নিজের হাতেই কন্ট্রোল করছিল বারীন ডাক্তার সেদিন। পেশেন্ট স্যারের নিজের ভাগ্নে , তাই নার্সিংহোমের মেট্রন একটু বেশি অ্যাটেনশন দিলেও ডোপামিনের ডোজ ইনফিউশন পাম্পে নিজের হাতে কি রাখছেন স্যার কিংবা এন এসের বোতলে হঠাৎ করে কি ইনজেকশন পুশ করছেন তিনি– সেদিকে বিশেষ নজর দেয়নি নার্সিংহোমের মেট্রন সাবিত্রী। তবে এন এসের বোতলে যে ইনজেকশনটা স্যার পুশ করলেন তার খালি অ্যাম্পলটা ওয়েস্ট বক্সে না ফেলে নিজের বুক পকেটে রাখলেন –এটা কিন্তু নজর এড়ায়নি মেট্রোনের।
এলাকার নামজাদা চেস্ট স্পেশালিস্ট , নার্সিংহোমে লক্ষ্মী, মালকিনের বিশেষ কাছের মানুষ এই বারীন ডাক্তারৃর এর কাজের উপর আর যাই হোক নজরদারি তো আর মফস্বলের একটা ছাপোষা নার্সিংহোম, নামেই নার্সিংহোম, আদতে মেটারনিটি হোম, সেখানকার গালভরা পদাধিকারী ‘মেট্রন’ করতে পারেন না ।
ল্যাসিক্সের খালি অ্যাম্পুলটা যে নিজের পকেটে পোড়ার ঘটনা টা সাবিত্রী সিস্টারের নজর এড়ায়নি, সেটা বুঝতে পোড় খাওয়া ডাক্তার বারীন আচার্যের অসুবিধা হয়নি। তাই ব্যাপারটা সামাল দেবার জন্য একটু আগ বাড়িয়েই সাবিত্রী কে সে বলে;এটা খুব লেটেস্ট অ্যান্টিবায়োটিক কয়েক মাস হল ইংল্যান্ডে বেরিয়েছে ।আমি লাস্ট বার কনফারেন্সে গিয়ে কিছু স্যাম্পল নিয়ে এসেছিলাম। সেটাই চার্জ করলাম।হঠাৎ করে বারীন ডাক্তারের নিজের ভাগ্নের ট্রিটমেন্টের প্যাটার্ন নিয়ে একজন অতি সাধারণ মফস্বলী নার্স ,যার কোনো এ এন এম বা জি এন এম ডিগ্রি পর্যন্ত নেই, তার কাছে যেন জবাবদিহি করছেন বারীন স্যার– একটু অবাকই হল সাবিত্রী সিস্টার।আর ও অবাক হল ইনঞ্জেকশনের ভাঙা ফাঁকা শিশিটা স্যার জামার বুক পকেটে রাখাতে। রমার সামনেই পেশেন্টের কেস হিস্ট্রি টা নিজেই গড় গড় করে বলে গেল বারীন।দীপকে মেটফর্মিন নিতে হলেও ওর সুগার লেভেল টা যে এখন বর্ডার লাইনের থেকে বেশি উঁচুতে নেই সেটা আর বলার তেমন প্রয়োজন মনে হয় নি বারীনের । মফস্বলের এই নার্সিং হোম , নামে তাল পুকুর হলেও আদতে যে ঘটি ডোবে না — তা আর কেউ জানুক না জানুক চটকলের দেহাতি লেবার রোগীদের তেড়ে স্টেরয়েড দিয়ে’ জলদি ইলাজ ‘ করানো ‘ ডাগদর সাব’ বারীন আচার্য খুব ভালো করেই জানে।তাই নার্সিংহোমের আর এম পি রেসিডেন্সিয়াল মেডিকেল অফিসার বারীন স্যারের উপর দিয়ে গিয়ে পেশেন্টের ডায়াবেটিক হিস্ট্রি থাকা সত্ত্বেও রানডাম সুগার টেস্টের সাহস দেখাতে পারেনি।প্লেটলেট মারাত্মক রকম নেমে যাওয়ার যাবতীয় সিমটম থাকা সত্বেও দীপকে ঠিক একদম আনকন্সাস পেশেন্ট বলা যায় না ।তাই ঘনঘন পেচ্ছাপের জন্য ওয়ার্ড বয় দের দেওয়া ইউরিন পট সে কিছুতেই ব্যবহার করতে চাইছে না। মফস্বলের এইসব নার্সিংহোম গুলোতে ব্রাদার নার্সের কোন রেওয়াজ নেই। মেল পেশেন্টদের কনশাসনেসের উপর নির্ভর করে ইউরিন পট বা বেটপ্যান পুরুষ জমাদার দেবে না মহিলা জমা দেবে– সেই বিষয়টি। কোনরকমে ধরে ধরে খানিকটা সময় পর পর দুবার বাথরুমে গিয়ে পেচ্ছাপ করে এসেছে দীপ।বারবার ওঠার জন্য ইনফিউশন পাম্পের তারটা চ্যানেল থেকে খুলতে হচ্ছে ,আবার বাথরুম থেকে আসার পর সেটা লাগিয়ে দিচ্ছে সাবিত্রী । এই রকম চলতে চলতেই বিকেল সন্ধ্যে ছটা নাগাদ আবার রাউন্ডে এলেন বারীন আচার্য ।নিজের হাতে দীপের বি পি দেখলেন। বি পি নেমে গেছে এইট্টি বাই ফর্টি তে।
ওদিকে ঘনঘন বড়দি দির ছেলে সায়ন্তন ফোন করছে। সকাল থেকেই ইনফিউশন পাম্প চালিয়ে ডোপামিন দেওয়া সত্ত্বেও বি পি না ওঠায় খানিকটা জোর করে ই ছোট মামাকে বলে সায়ন্তন , আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। একটা আই সি ইউ ফেসিলিটি আছে ,এমন অ্যাম্বুলেন্সে করে তুমি যেভাবেই হোক দীপদাকেকে নিয়ে সোজা কলকাতায় চলে এসো ।বারীন বিরক্তি চেপে গলায় উদ্বেগ ঢেলে বলে;আরে, এ কি তোদের কলকাতা শহর ?এখানে কোনো আই সি ইউ ফেসিলিটিওয়ালা অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না । তাহলে যে করেই হোক একটা স্পেসিয়াস এ সি অ্যাম্বুলেন্স করে ইমিডিয়েট চলে এসো । সায়ন্তনের কথার সুরে উত্তরে একটু বিরক্ত হয়েও গলায় উদ্বেগ বজায় রেখে বারীন বলে; সেই ভালো।সকাল থেকে হাই ডোজে ডোপামিন চালিয়েও সেভাবে বি পি উঠলো না, তোর ওখানেই ওকে নিয়ে যাচ্ছি ।বড় এম্বুলেন্স পাওয়া যায় না ।মারুটি ওমনি অ্যাম্বুলেন্সে ই ওঠে দীপ ।পেছনে বসে রমা , আর দীপের কারখানার ম্যানেজার, কাম অল ইন অল, হারু । অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে নিজের গাড়িতে থাকে বারীন।

দীপ কে যে কলকাতায় ট্রান্সফার করা হচ্ছে – এটা নীরাকে জানাতেই , হাউ মাউ করে উঠে সে নিজের যাওয়ার ইচ্ছেটা বারীন কে বলেছিল।চেস্ট মেডিসিনের ভগবান ডি সেনের হাউজ স্টাফ ছিল বারীন কিছু দিন।সেটা ভাঙিয়েই এই হদ্দ মফস্বল শহরে চেস্ট স্পেশালিষ্ট হয়ে যাওয়া বারীন ডাক্তার রোগীর অ্যানাটমিকাল সিনট্রমের থেকেও সাইকোলজিকাল সিনট্রম টা অনেকের থেকে ভালো বোঝে।তাই নীরা কে বলে;রমা বিরক্ত হতে পারে। বিষধর সাপের ফনাতে ধুলো পড়া দেওয়ার মতোই কাজ হয় বারীনের এই কথা ।এরপর নীরা আর কথা বাড়ায়নি।
অ্যাম্বুলেন্স টা তখনো এক্সপ্রেস ওয়েতেই রয়েছে , পরিতক্ত টোল ট্যাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো ।পেছনের গাড়ি থেকে একটু হন্তদন্ত হয়ে নামলেন বারীন। উদ্বেগের ছবিটা পুরোপুরি ফুটিয়ে তুলে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ;কোনো সমস্যা হয়নি তো? রমা বললো ;জোর বাথরুম পেয়েছে ওর।
এম্বুলেন্স ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেন বারীন; তোমাদের কাছে ইউরিন পট নেই ?এসব মফস্বলী অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেনই থাকে না , ইউরিন পট তো দূরের কথা ।হারু বারবার দীপকে বলে;বৌদি নেমে যাচ্ছে ।তুমি জলের বোতলে বাথরুম করো ।আমি ফেলে দিচ্ছি।
বারীন বোঝে বিকেলের ল্যাসিক্সের এফেক্ট এখনো জোরদার। শারীরিক অস্বস্তির ভেতরেও জলের বোতলের ভেতরে পেচ্ছাপ করতে কিছুতেই রাজি নয় দীপ।আস্তে আস্তে ওকে নিয়ে রাস্তার ধারের দিকে এগিয়ে গেল হারু। পেচ্ছাপ করতে শুরু করার এক, দুই সেকেন্ডের ভেতরেই হঠাৎ হারু গায়ের উপর এলিয়ে পড়ছে দীপ।কিছু বুঝে উঠতে না পেরে হারু জোরে চেঁচিয়ে ওঠে ; ছোটমামা ।কলকাতা অব্দি যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চায় না তখন আর বারীন।পাশেই রামকৃষ্ণ সেবা সদনে ঢোকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে । এই নার্সিংহোম টি কলকাতার আরও খানিকটা কাছে হওয়া সত্ত্বেও এদের কাছে ভেন্টিলেটার মানে আম্বু। স্ট্রেচারে তুলে দীপকে দেড় তলার নাম সর্বস্ব আই সি ইউ তে ঢুকানোর আগেই ওর কোন পালস পায় না বারীন। আম্বু ইনকিউবেট করবার মতো অ্যানাস্থেসিস্ট খুঁজে পাওয়া মুহূর্তের ভেতরে এসব নার্সিংহোমে সম্ভব নয় ।ও টি টেকনিশিয়ান আম্বু ইনকিউবেট করে। খানিকক্ষণ পাম্প করতে থাকে আর এম ও ।কার্ডিয়াক মনিটরের সাদা দাগ গুলো আম্বুর পামপিং য়ের হাজারো চেষ্টাতেও আঁকা বাঁকা হয় না, স্ট্রেটই থেকে যায়।একটু পরে কার্যত বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে লবিতে দাঁড়িয়ে রমা আর হারুর সামনে বারীন যখন বলে ; দীপ আর নেই —কথাটা যেন বিশ্বাসই হয় না রমার ।একটা অদ্ভুত অসহায় ঘোর লাগা ফেল ফেলানী নিয়ে নার্সিংহোমের লবিতে বসে থাকে রমা।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।