বিদেশ

২০২৩ এ শান্তির নোবেল জিতে নিলেন কারান্তরালের ইরানি কন্যা – নার্গিস মোহম্মদী।


বিশেষ প্রতিবেদন: মধুমিতা ঘোষ: চিন্তন নিউজ:০৮/১০/২০২৩:- নার্গিস মোহম্মদী – ইরানের মহিলাদের শোষণ- বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লাগাতার যুদ্ধের এক লড়াকু সেনাপতির নাম। বহু বছর ধরে ইরানে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সব মানুষের স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামী এই নারী কারাবন্দী অবস্থায় জিতে নিলেন ২০২৩ এর নোবেল শান্তি পুরস্কার।

৫১ বছর বয়সী নার্গিসের এই সাহসী জীবন- যুদ্ধ প্রায় ছাত্রাবস্থা থেকেই ভীষন রকম আত্ম- কৃচ্ছতার মধ্যে দিয়ে চলেছে। অত্যাচারী ধর্মীয় মৌলবাদী ইরানি প্রশাসনের দ্বারা তিনি ১৩ বার গ্রেফতার,৫ বার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তাঁর জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে সর্বমোট ৩১ বছরের জেল ও ১৫৪ ঘা চাবুক। নার্গিস আজও ইরানের কুখ্যাত এভিন জেলে বন্দী।২০২২ এর সেপ্টেম্বরে একজন যুবতী কুর্দিশ মহিলা মাশাহ জিনা আমিনি , গাড়িতে যাওয়ার সময় হিজাব ব্যবহার না করার মতো লঘু অপরাধে , ইরানি নীতি -পুলিশের হেফাজতে নিহত হলে– ১৯৭৯ তে অন্যায়ভাবে অধিষ্ঠিত ইরানি সরকারের নারীদের ওপরে অতিনিষ্ঠুর ও হিংস্র অত্যাচারের বিরুদ্ধে ” নারী – জীবন – স্বাধীনতা” নার্গিস এর তৈরি এই স্লোগান মুখে নিয়ে হাজার হাজার ইরানি মানুষ- জনপথে নেমে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ গ্রহণ করেন। মাশাহর অকালমৃত্যুতে হাজারো প্রতিবাদী কন্ঠস্বরে মুখরিত স্লোগানে জর্জরিত অত্যাচারী সরকার ক্ষিপ্ত নেকড়ের মতো এ সব বন্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর সাহায্যে যথেচ্ছ গ্রেফতারী ও হত্যালীলা সংগঠিত করে। কিন্তু ” যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,প্রাণপনে সরাবো পৃথিবীর জঞ্জাল ” ,কবি সুকান্তের এই কথাগুলো বুকে আগলে যেন নার্গিস সাহস সঞ্চয় করে আন্দোলন চালাতেই থাকে।

ছাত্রাবস্থাতেই,১৯৯০ সাল থেকে পদার্থবিজ্ঞান এর এই ছাত্রী যখন ইঞ্জিনিয়ারিঙ আয়ত্ত করছেন তখনই লক্ষ্য স্থির করেছিলেন যে বর্বর ইরান প্রশাসনের মধ্যযুগীয় নারী – নৃশংসতা থেকে বাঁচতে ও নারীর মর্যাদা, সম্ভ্রম বাঁচাতে তাকে সব মানুষের সমানাধিকার এর দাবিতে প্রশাসকের ধারালো নখ- দন্ত ও রক্তচক্ষুর সামনে রুখে দাঁড়াতে হবে। সেই নয়ের দশকেই লড়াই টা মূলত তিনি শুরু করেন, যাকে বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কবিগুরুর ভাষা” ওদের বাঁধন যতোই শক্ত হবে,ততোই বাঁধন টুটবে ” , বুকে ধারণ করে, শৃঙ্খলা বদ্ধ নারী – শোষণ ও মৌলবাদী শাসন থেকে নারী জাতির জননী হিসেবে পর্দা প্রথার অবসানে, সুন্দর স্বাভাবিক জীবন যাপনে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করতে এবং সমস্ত মানুষের স্বাধীনতা ভোগের অধিকার কায়েম করতে জেলবন্দী অবস্থাতেও নার্গিস সরব হলেন। সোচ্চার হলেন ইরানের কুখ্যাত এভিন জেলের অন্ধকূপে বন্দী নারীদের ওপর যৌন – নির্যাতনের প্রতিবাদে, যেখানে প্রায়শ ই ঠাঁই হয় ইরান সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের।জেল থেকেই উপযুক্ত নেতৃত্ব দিয়ে তিনি লড়াই করছেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা র জন্য এবং ইরান থেকে সম্পূর্ণ ভাবে মৃত্যুদণ্ড উচ্ছেদের জন্যে। মৃত্যু দন্ড বিরোধী আন্দোলনে র জেরেই তাঁর ১৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগার থেকেই সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাবার প্রেরণা দেন আন্দোলনকারীদের।
অ্যলফ্রেড নোবেল শান্তি পুরস্কারের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী সমস্ত দেশগুলোকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যেই এই পুরস্কার এর সূচনা। নোবেল শান্তি কমিটির নার্গিস মোহম্মদীকে নির্বাচন ইরান থেকে অশান্তির বাতাবরণ নির্মূল করার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে।

নার্গিস মোহম্মদীকে কুর্নিশ – বছরের পর বছর ধরে এমন একটা অসম লড়াই জারি রেখে, অসংখ্য অভিযোগ সত্ত্বেও, ইরানের মানবাধিকার এর লড়াই এ, নারী স্বাধীনতা র আন্দোলনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করার জন্যে।২০০৩ এ শিরিন এবাদী নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। ২০ বছর পরে আবার নার্গিস মোহম্মদী । ইরান কিন্তু যেখানে ছিল সেখানেই আছে। মানুষ আজও আশাবাদী নার্গিস মোহম্মদী র নেতৃত্বে, ইরান নিশ্চিত একদিন দেখবে স্বাধীনতা র আলো। রক্তিম অভিনন্দন বর্ষিত হচ্ছে নার্গিস মোহম্মদীর উপর দুনিয়ার সমস্ত মুক্তিকামী মানুষদের পক্ষ থেকে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।