বিশেষ প্রতিবেদন: রীতা মুখার্জী: চিন্তন নিউজ: ০১/১২/২০২৩:- ইতিহাস কথা বলে। কি বলে? কতটা বলে? তাকে নিয়ে সাধ্য মতো বিশ্লেষণে আরেক ইতিহাস রচিত হয়। মানুষের কৌতূহল মানুষকে যেমন বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবায়, তেমনি তার অতীতকে, শিকড়কে নিয়েও ভাবায়। কারণ অতীতের ইমারতের উপর বর্তমান গড়ে ওঠে।সে যাই হোক। ইতিহাসের কবর খুঁড়ে নতুন ইতিহাসের পত্তন ঘটে।
প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের প্রারম্ভিক হরপ্পা সভ্যতার কবরস্থানের সন্ধান পাওয়া গেছে।২০১৬ সালে কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি বিভাগের উদ্যোগে গুজরাটের কচ্ছ জেলার জুনা খাটিয়া গ্ৰামে প্রত্নক্ষেত্র জরিপের কাজ চালানো হয়। জুনা খাটিয়া গ্ৰামটি পাকিস্তান সীমান্তের কাছে ধোলাভীরার সন্নিকটে অবস্থিত। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সহযোগিতায় কচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথভাবে তিন বছরে তিনটি খনন কার্য চালায়। ২০১৯ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক গণ জানান যে এখানে ১৬ হেক্টর এলাকা জুড়ে একটি অতি প্রাচীন কবরস্থানের হদিশ পাওয়া গেছে যা জুনা খাটিয়া গ্ৰাম থেকে মাত্র তিনশো মিটার দূরে। ৫০০ টি মৃতদেহ থাকার অনুমান করলেও কবরে পাওয়া গেছে মাত্র ১৯৭ টি দেহ বা দেহাবশেষ।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এই কবরস্থান ব্যবহৃত হয় আনুমানিক ৩২০০ পূর্বাব্দ থেকে ২৬০০ পূর্বাব্দ সময়কালে।উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করেই তাঁরা সময়কালকে চিহ্নিত করেছেন। যদিও অর্থাভাবে মৃতদেহের হাড়গুলির সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা যায়নি। কিন্তু কবরস্থানের সময়কাল নির্ধারণের পরে এই কবরস্থানকে হরপ্পা সভ্যতার প্রাথমিক দিকের বলেই মনে করা হচ্ছে। আর ঠিক এখানেই এই কবরস্থানের গুরুত্ব। নানা কারনে মৃতদেহগুলির দেহাবশিষ্টাংশ প্রায় কিছুই পাওয়া যায়নি। তবুও যে অসংখ্য হাড় , খুলি , বা দাঁত পাওয়া গেছে তা থেকে কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈজ্ঞানিকেরা মৃতদেহের ডি এন এ সহ বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে কবরস্থানে প্রাপ্ত দেহগুলির ভৌগলিক পরিচিতি জানার চেষ্টা করছেন।
সবগুলি কবর অতি সাধারণ মানের বলে জানা গেছে। ছোট ও বড়দের জন্য পৃথক পৃথক মাপের কবর। অদ্ভুত বিষয় হলো অন্যান্য হরপ্পান সভ্যতার নিদর্শন গুলিতে কবর উত্তর দক্ষিণে থাকলেও এই কবরস্থানে নাকি কবরের দিক নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবনা চিন্তা ছিলোনা। কবরগুলি আকারে আয়তাকার বা ডিম্বাকার। মাটির হাঁড়িতে হাড় নিয়েও কবর দেবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কবরের মধ্যে দান সামগ্ৰী দেবার রীতি ছিলো। দান সামগ্ৰী হিসাবে মাটির বাসন থেকে শুরু করে পুঁতি , চুড়ি, ল্যাপিস ল্যাজুলি নামের মূল্যবান পাথরও পাওয়া গেছে। সম্ভবত এগুলি মৃতদেহের জীবদ্দশায় ব্যবহৃত সামগ্ৰী। সাথে পাওয়া গেছে শাঁখা, শঙ্খের পুঁতি, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য সবধরণের প্রয়োজনীয় বাসন। মেয়েদের কবরে তামার আয়না পাওয়া গেছে । এ থেকেই এটাও প্রমাণিত হয় যে সেই সময়ে ধাতুর ব্যবহারও প্রচলিত ছিলো। আরও পাওয়া গেছে কাপড়ের অস্তিত্বের প্রমাণ ও পাথরের হাতিয়ার ও হাতিয়ার তৈরির পাথর।
প্রচুর সংখ্যায় কবর খালি অবস্থায় পাওয়া গেছে।অনুমান করা হচ্ছে এই কবরস্থানের সম্পর্কে স্থানীয় মানুষ অবহিত ছিলো। সম্ভবত বহুমূল্য পাথর , পোড়া মাটির বাসন যার প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য অনেক বেশি , বহুদিন যাবত সেইগুলি চুরি হচ্ছিল। কবরস্থ মানুষের বসবাস করার অঞ্চল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া না গেলেও যুক্তির ভিন্নতায় ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়।কেউ বলেন তারা যাযাবর ব্যাবসায়ী গোষ্ঠী বা ভ্রাম্যমান যাযাবর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
প্রসঙ্গত এই সম্পর্কে হরপ্পান খননের প্রখ্যাত প্রত্নবিদ অধ্যাপক কেনয়ের মতের উল্লেখ করতে হয়। তাঁর মতে এই মৃতদেহের বসবাস হয়তো এই কবরস্থানের কাছাকাছি অঞ্চলেই ছিলো। কিন্তু সেই বসবাস বা বাসস্থানের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এই ক্ষেত্রে অধ্যাপক কেনয় এর যুক্তি ছিলো এই যে বাসস্থান থাকলেই যে তার প্রমান মজুত থাকবে তা নাও হতে পারে। হয়তো সেই বাসস্থানের ধ্বংসাবশেষের উপরে নতুন ভাবে কোনও বসতী গড়ে উঠেছে। জানা গেছে মৃতদেহেরা জীবিতকালে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলো। হাড়ের ক্ষয় রোগ বা অস্থিসন্ধির রোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যতটুকু গবেষণাকার্য চালানো সম্ভব হয়েছে তাতে বৈজ্ঞানিকেরা একে হরপ্পা সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের কবরস্থান বলে চিহ্নিত করেছেন।যদিও শেষ কথা এখনো বলা সম্ভব হয়নি।পরীক্ষা-নিরিক্ষা , প্রমাণ, তথ্য , বিশ্লেষণ এখনও অপেক্ষায়। বর্তমান সময়ে অতীত নিয়ে গবেষণা বিলাসিতার সমান, তাই সরকারি অর্থ অমিল বা অপ্রতুল। স্বাভাবিকভাবেই, অনুসন্ধান পর্ব দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।