কলমের খোঁচা

কত অজানারে —-পরিবেশ দূষণ রোধে ” তরল গাছ” জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।


লেখক : মধুমিতা ঘোষ:– তরল গাছের ইতিকথা:-
আমরা সকলেই, মানে এই পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষজন গাছ বলতে বুঝি শিকড়, কাণ্ড ও শাখা যুক্ত উদ্ভিদকে। বিশাল এই জগতের মাত্র এক ভাগ স্থলের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে বন জঙ্গল ও জীবজগতের ভারসাম্য রক্ষায় এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। “একটি গাছ – একটি প্রাণ” প্রচলিত এই স্লোগানটি বুঝিয়ে দেয় যে জীবন টিকিয়ে রাখতে গাছের প্রয়োজনীয়তা কতখানি। এ তো গেল সবই মাটি আঁকড়ে বড় হয়ে ওঠা বৃক্ষ বা গাছের কথা! কিন্তু তরল গাছ! আমাদের এই পৃথিবীতে তরলগাছ আছে নাকি! অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখালেন মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত সার্বিয়ার এক দল বৈজ্ঞানিক। তাদের শ্রম ও উদ্ভাবন কুশলতায় আবিষ্কার-২০২৩ এ “একটি তরল গাছ”।

এই আবিষ্কারের নেপথ্যে তাকালে দেখি যে মানব সভ্যতা তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে ধ্বংসাত্মক গতিতে বন জঙ্গল, গাছপালা সাফ- সুতরো করতে করতে, এবং গাছের সংখ্যা কমায় বাতাসের দূষণ বাড়ছে। সরকার বা বেসরকারি সংস্থা ও বিভিন্ন কোম্পানিগুলোর চেষ্টা চলছে পরিকল্পনামাফিক গাছ লাগিয়ে বন জঙ্গল, ঝোপ- ঝাড়ের শূন্যস্থান কিছুটা হলেও পূরণ করার, কিন্তু শহুরে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যেখানে একটা গাছ লাগানোরও কোনো রকম জায়গায় নেই, বায়ু দূষণ যেখানে সর্বোচ্চ ঘনত্বে রয়েছে, সেখানে প্রাকৃতিক নিয়মে দূষণ রোধের কি উপায়?

বায়ু দূষণ মূল্যায়নের নিরিখে ২০২০ সালে সমগ্র পৃথিবীতে সার্বিয়ার নাম ছিল সবচেয়ে খারাপ গুণমানের বাতাসের জন্যে ২৮ নম্বরে। সার্বিয়ার মধ্যে বেলগ্রেড শহরে দুটো খুব বড় কয়লা পাওয়ার প্লান্ট বসানোর জন্যে এই শহরের দূষণ এবং অন্যান্য বড় বড় শহরে বিভিন্ন কারণে দূষণ আজ মাত্রা ছাড়া। পৃথিবীর সর্বত্রই কমছে গাছের সংখ্যা এবং বাড়ছে দূষণ, মানব সভ্যতার এমন অস্তিত্ব সংকটে তাই সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানী-মহল চিন্তিত। আই এইচ এম ই গ্লোবাল হেলথ ডাটা এক্সচেঞ্জ টুল এর মত অনুযায়ী এক বছরে বিশ্বে যত মানুষ এইচআইভি, যক্ষা ও ম্যালেরিয়ায় মারা যায়, দূষণ, (সে বাতাস বা জল, প্রাকৃতিক যেকোনো কারণেই হোক না কেন) তার তিনগুণ মানুষকে মেরে ফেলতে সক্ষম। দূষণ দৈত্য থেকে মুক্তির আশায় ও বিশুদ্ধ বাতাসের খোঁজে অবশেষে সার্বিয়ার একদল বিজ্ঞানী সফলতা পেলেন- আবিষ্কার করলেন লিকুইড ট্রি বা তরল গাছ-বিশ্ব দরবারে যা বাতাসে দূষণমাত্রা কমাতে এক অভিনব বিকল্প পথ বলে মনে করা হয়। এবার দেখা যাক কী এই সত্যিকারের তরল গাছ।

বর্তমানে জনবিস্ফোরণের দরুন দুনিয়াজোড়া শুধু কংক্রিটের জঙ্গল। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর মাত্রা সর্বাধিক এইসব পাশাপাশি সারিবদ্ধ ঘরবাড়ি এলাকায়। দূষণ কমাতে বৃক্ষ রোপণে যখন জোর দেওয়া উচিত তখন অপরিকল্পিত নগরায়নের দরুন একটা গাছ লাগানোর চিন্তাও কষ্টকর। দূষণ এবং কংক্রিটের জঙ্গলে সংকটের নানামাত্রা মানুষকে ঘিরে ধরেছে, আর ঠিক এই পরিস্থিতিতেই সার্বিয়ার একদল বিজ্ঞানীর হাত ধরে এলো একেবারে নতুন অপূর্ব এই আবিষ্কার’ তরল গাছ’, যা শহরে গাছ লাগানোর সুযোগ না থাকলেও গাছের বিকল্প হিসেবে কাজ করে নিয়ন্ত্রণ করবে বায়ু দূষণ। কিন্তু গাছ কি তরল হতে পারে? সত্যি কারের গাছ তো বাতাসে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড এর মাত্রা ঠিক রেখে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। তবে ( আমরা যেমন জানি যে) দুধের স্বাদ যেমন ঘোলে মেটে, নেই মামার থেকে যখন কানা মামা ও ভালো হয়ে যায় তখন এই তরলগাছ পুরোপুরি বায়ু দূষণ সমস্যা রোধে সক্ষম না হলেও, বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার দমবন্ধ করা ছটফটানি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দেবে। বিজ্ঞানীদের চমক এই’ তরল গাছ ‘আসলে তেমন কিছুই নয়, এ হলো জলের মধ্যে মিশে থাকা মাইক্রো- অ্যলগি এবং এই মিশ্রণ যদি নির্দিষ্ট পরিমাণে নগর অঞ্চলে রাখা যায় তবে তা কার্বন ডাই অক্সাইড জনিত বায়ু দূষণ অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। এই ‘তরল গাছ’ বা এই ধরনের অ্যলগি- সহ জল ভরা পাত্র যে কোন জায়গাতেই রাখা যায়। সার্বিয়ার বিজ্ঞানী দল পরীক্ষা করে দেখেছেন যে দূষণ নিয়ন্ত্রণে ছোট ছোট গাছ যে কাজ করতে পারেনা, তা পারে এই মাইক্রোঅ্যলগি। গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে এই তরল গাছ। পরিবেশ দূষণজনিত সমস্যা প্রতিরোধে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এই চমৎকার উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সারা বিশ্ব জুড়ে, যা ইতিমধ্যেই সমাধান হিসেবে যথেষ্ট স্বীকৃতি ও প্রশংসাও পেয়েছে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।