রঘুনাথ ভট্টাচার্য: চিন্তন নিউজ:১৮ই এপ্রিল:-বেশখানিকক্ষণ দ্বিধায় থাকতে হ’ল। কী নিয়ে লিখছি ? ‘ হটস্পটে অর্থনীতি’
না কি ‘অর্থনীতি হটস্পটে’?ভেবে দেখলাম আগেরটা আগে আসাই উচিত। অন্যটা নিয়ে না হয় পড়ে একসময় দেখা যাবে। কারন, অর্থনীতি হটস্পট থেকে মুক্তি পেতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে।
যাই হোক, শিবের গীত ছেড়ে এখন আসল কথায় যাওয়া যাক। ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রক শুক্রবার(১৭/০৪) বেলা ১২.৩০ পর্যন্ত যে হিসাব প্রকাশ করেছে বলে খবরে জানা যাচ্ছে, তাতে দেখা যায় যে ভারতে কোভিড-১৯ শে আক্রান্ত হল ১৩,৩৮৭( সক্রিয় ১১,২০১) এবং মৃতের সংখ্যা ৪৩৭, যদিও সংবাদ সংস্থা টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রাজ্যভিত্তিক রিপোর্টে দেখা যায় যে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ১৩,৫৪১ ও মৃত ৪৪৯। শুধু বৃহস্পতিবারের আক্রান্ত হয়েছেন ১২৬০ জন।
সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত ২.১৬ মিলিয়ন আর মৃতের সংখ্যা১,৪৫,৫৬৮।( পরিসংখ্যান টাইমস অফ ইন্ডিয়ার অনলাইনে প্রকাশিত।) যাই হোক , সংখ্যা নিয়ে কুস্তি করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।এই চিত্রের প্রেক্ষাপটে , আগামী সোমবার,২০শে এপ্রিল, ২৬দিনের রুদ্ধাবাসের পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসন তার করোনা-শাসনের রাশ কিছুটা আলগা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেইসব এলাকায় যেখানে সংক্রমণ বা সংক্রমণের সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। এর বাইরে সব এলাকাকেই বলা হবে ‘হটস্পট’। এব্যাপারে কেন্দ্রীয় বিধান হল কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দেওয়া। সঙ্গে কোনো কোনো এলাকায় শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রেও ছাড়ের কথা বলা হল।
এই সিদ্ধান্ত বলবৎ হলে রোগের প্রভাব আবার বেড়ে যাবে কিনা সে কথা স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞদের বিবেচ্য, এই লেখক সেই দিকে নজর দেবার অধিকারী নয়। আমরা এখানে নূতন ব্যবস্থাপনার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কী প্রতিফলন, তা আন্দাজ করতে চেষ্টা করব, কারন এমন একটা কথা হাওয়ায় ভাসছে যে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্ষতি বাঁচানোর জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সরাসরি বলা যায় এই পদক্ষেপে দেশের কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলি কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। কারন রবিশষ্য তোলা ও খরিপের বীজতলা পর্যন্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে সেই সব রাজ্যে যদি না তারা আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে , শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ, কারন, মূখ্য শিল্পোন্নত এলাকাগুলো হল ‘হটস্পটে ‘, অর্থাৎ যেখানে লকডাউন অবস্থান থেকে কোনো রকম ছাড় নেই, বর্তমান সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩রা মে পর্যন্ত অনিবার্য ভাবে।
ভারতের প্রধান প্রধান আক্রান্ত স্থানগুলি মোটামুটি ১৫ টি শহর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত বলেছেন বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা। যার মধ্যে দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু প্রমুখ পড়ছে। তাঁর মানে বাকী অংশ যদি পূর্ণ উৎপাদনেও যায়, তা হলেও কোনো সুরাহা নেই,কারন শহরের বাজার নিস্ক্রিয় থেকে যাবে, বর্তমান সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তেশরা মে পর্যন্ত। তারপরও টেক্ অফ স্থিতিতে আসতে তো বেশ খানিকটা সময় তো নেবেই। মনে রাখা ভাল, বেসরকারি উপভোক্তা-জনতার চাহিদার ঘাটতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যহত হওয়ার অ্যতম প্রধান কারণ। এবং, আরও উল্লেখ্য হল , সেই অবস্থাটা কোভিড-১৯ এর আক্রমণের আগে থেকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ।এখন, ১৭০টি জেলায় ‘হটস্পট’ ঘোষণা অনিবার্য হওয়ার ফলে ৩৭% শতাংশ জনসংখ্যা সহ ২৯% ভৌগোলিক ক্ষেত্র প্রভাবিত হবে বলে আশঙ্কা (হিন্দুস্থান টাইমস)।অন্যদিকে বিশ্লেষণ হল, এই ১৭০টি জেলায় মোট ব্যাঙ্ক-দাদনের ৮০% আছে বলে হিসাব।অর্থাৎ এই ‘হটস্পট’ভূক্ত এলাকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। খবরে প্রকাশ, যে হিরো মোটর কর্প দেশের সর্ব প্রধান দু-চাকার গাড়ী তৈরির সংস্থা, তাঁরা (TOI কে) জানাচ্ছে যে , তাদের যারা মাল সরবরাহ করে তারা এই ছাড়-না-পড়া এলাকায় আটকে পড়েছে, অবশ্যই অনিবার্য ভাবে।
কাজেই বিশেষজ্ঞদের মতে ,কেন্দ্রের গাইডলাইনকে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়েও একথা বোঝা যায় যে, যদি এই ৮০% ব্যাঙ্ক ঋণ অনাদায়ী থাকে তবে সারা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা। মান্য ক্রেডিট রেটিং সংস্থা-‘ইন্ডিয়া রেটিং’-এর মূখ্য অর্থনীতিবিদ শ্রী ডি কে পন্থের রিপোর্টে একথাই উঠে আসছে বলে জানা গেল(TOI)।
দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এই সত্যটি যে অনেকের মতেই করোনা বিষ্ফোরণের আগে থেকেই নানা কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ঢিলেঢালা অবস্থাতেই ছিল। যেমন, যাত্রীবাহী গাড়ির হোলসেল বিক্রি কমেছিল ১৪.৬৮% আর বাণিজ্যিক গাড়ির বিক্রি কমে গিয়েছিল ২১.৫৬%(ফেব্রুয়ারির শেষে রিপোর্টে)। বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রির ওঠাপড়া অর্থনৈতিক অবস্থার যাচাইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরিখ, একথা সুবিদিত। কিছু দিন আগে থেকেই এই অটোমোবাইল বিক্রেতারা অবিক্রিত গাড়ির মজুত মালে ভারাক্রান্ত ছিল। বাজারের এই অবস্থায় উৎপাদকরা কোনো মতেই আশু নতুন উৎপাদনে উৎসাহী হবেন না , একথা বলা যায়।
মার্চের রিপোর্টে তথ্য ছিল ,ভারতের রপ্তানি কমে গিয়েছে ৩৪.৫%, যা বিগত ২৫ বছরে নিম্নতম।এছাড়াও লকডাউনের প্রভাবে বাজারে উৎপাদন তথা ব্যবসাক্ষেত্রে নগদের চলন ও আদান-প্রদান খুবই ব্যাহত হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ নেতি-প্রভাব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনিবার্য।
অবশ্যই আশার কথা , রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-য়ের গভর্নর, শ্রী এস,কে দাস, নিশ্চিত করেছেন যে ব্যাঙ্কগুলি যাতে কোম্পানীগুলিকে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় কার্যকরী মূলধনী ঋণ সরবরাহ করতে পারে সেদিকে নজর রাখা হবে।অনাদায়ী ও অনুৎপাদনশীল ঋণের সমুদ্র সাঁতরে ব্যাঙ্কগুলি কতটা কী করে উঠতে পারে সেদিকে সবাই চেয়ে আছে। একটা কথা খুব মনে পড়ছে। এখনও আলোচনা চক্রে টাটকা রয়েছে দেশের গর্ব অর্থনীতির নোবেলজয়ী শ্রী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ঘোষণা – গরিবের হাতে টাকা পৌঁছে দিতে দরকারে টাকা ছাপাতে হবে !