কলমের খোঁচা

নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আপেক্ষিকতাবাদের জনক আলবার্ট আইনস্টাইন স্মরণে


তুলসী কুমার সিনহা: চিন্তন নিউজ:১৮ই এপ্রিল:- এ বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন আলবার্ট আইনস্টাইন। মানবজাতির কল্যানের জন্য তার অবদান চিরস্মরণীয়। এই পদার্থবিদ আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। তিনিই থিওরি অব রিলেটিভিটির জনক। বিজ্ঞান জগতে মানুষের ধারণার বহু আগেই তিনি বহু তত্ত্ব দিয়ে গিয়েছেন। আইনস্টাইন কেবলমাত্র বিজ্ঞানীই নন, তিনি ছিলেন এক দার্শনিক।

১৮৭৯ সালের ১৪ই মার্চ মহান বিজ্ঞানী স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন জার্মানির উলম শহরে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।তাই মাঝে মাঝেই ছেলেকে নানা ধরণের খেলনা এনে
দিতেন। শিশু আইনস্টাইন ঐ খেলনা নিয়ে উদাস হয়ে পড়তেন। আইনস্টাইনরা ইহুদী ধর্মাবলম্বী হওয়ার ফলে স্কুলে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় এই কারনে স্কুলে তার কোন বন্ধু ছিল না। পড়াশুনাতে অমনযোগী হওয়ার জন্য শিক্ষক মহাশয়রা তাঁর বাবার কাছে মাঝে মাঝে অভিযোগ করতেন।ছেলে লেখাপড়ায় অমনযোগী হওয়ায় আইনস্টাইন এর বাবা খুব বিরক্ত হলেও তাঁর মা সবসময় ছেলের পাশে থাকতেন। মা ভালো বেহালা বাজাতে পারতেন বলে আইনস্টাইন এর বেহালার প্রতি আসক্তি ছিল। এই বেহালা ছিল আইনস্টাইনের আজীবন কালের সাথী। বাবা নিজের কারখানায় ব্যস্ত থাকতেন বলে তাঁকে বেশি কাছে পেতেন না আইনস্টাইন। দর্শনের বই তাঁকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করত। পনেরো বছর বয়সের মধ্যে তিনি কান্ট, স্পিনোজা, ইউক্লিড, নিউটনের রচনা পড়ে শেষ করে ফেললেন। বিজ্ঞান, দর্শনের সাথে পড়তেন গ্যেটে, শিলার, শেক্সপিয়ারের বই সমূহ।

বাবার ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে সকলে মিউনিখ ত্যাগ করে মিলানে চলে গেলেও শুধু সেখানে একা রয়ে গেলেন আইনস্টাইন। তিনি সুইজারল্যান্ডের একটি পলিটেকনিক স্কুলে ভর্তি হলেন। প্রথমবার তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলেও দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় পরীক্ষায় পাস করলেন। বাড়ির আর্থিক অবস্থা ক্রমশই খারাপ হওয়ায় সংসারের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য তিনি পদার্থবিদ্যা ও গণিত নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে শিক্ষকতার জন্য বিভিন্ন স্কুলে দরখাস্ত করতে আরম্ভ করলেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও ইহুদী হওয়ার কারণে কোথাও চাকরি পেলেন না। এরপর আইনস্টাইন খরচ চালানোর প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়াতে আরম্ভ করলেন।মাত্র ২২ বছর বয়সে মিলেভা মারেককে তিনি বিবাহ করেন।মিলেভা মারেক শুধু আইনস্টাইনের স্ত্রী ছিলেন না, প্রকৃত অর্থেই তার জীবনসঙ্গী ছিলেন। শিক্ষকতার কাজ না পাওয়ায় তিনি একটি অফিসে ক্লার্কের চাকরি নিতে বাধ্য হন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের খাতার পাতায় সমাধান করতেন অঙ্কের জটিল তত্ত্ব। স্বপ্ন দেখতেন প্রকৃতির দুর্জ্ঞেয় রহস্য ভেদ করার। তার এই গোপন সাধনার কথা শুধু তাঁর স্ত্রী মিলেভাকে বলেছিলেন।

আইনস্টাইনের কোনো গবেষণাগার বা ল্যাবরেটরি না থাকায় খাতা কলমে গবেষণার কাজ চালিয়ে যান।অবশেষে মাত্র ২৬ বছর বয়সে শেষ হলো তার গবেষণা। এরপর একদিন ত্রিশ পাতার একটি প্রবন্ধ নিয়ে হাজির হলেন বার্লিনের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক পত্রিকা Annalen der physik-এর অফিসে। এই পত্রিকায় আইনস্টাইন পাঁচটি রচনা প্রকাশ করলেন। এসব রচনায় প্রচলিত বিষয়কে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে আইনস্টাইনের নাম বিজ্ঞানী মহলে ছড়িয়ে পড়ল। অবশেষে ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হলো তার চারটি রচনা-প্রথমটি আলোর গঠন ও শক্তি সম্পর্কে। দ্বিতীয়টি অ্যাটমের আকৃতি-প্রকৃতি। তৃতীয়টি ব্রাউনিয়াম মুভমেন্টের ক্রমবিকাশের তত্ত্ব। চতুর্থটি তার বিখ্যাত আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। এই সময় জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ জানানো হলো আইনস্টাইনকে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেবার জন্য। ১৯০৭ সালে তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হলেন। এরই সাথে পেটেন্ট অফিসের চাকরিও করেন।বিজ্ঞান জগতে ক্রমশই আইনস্টাইনের নাম ছড়িয়ে পড়ছিল।

১৯০৮ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার পদে রাজনৈতিক মহলের চাপে আইনস্টাইনের সহপাঠী ফ্রেডরিখ এডলারকে নিয়োগ করা হয়। আইনস্টাইনকে নিয়োগ না করে তাকে নতুন পদে নিযুক্ত করা হয়েছে জেনে তিনি কর্তৃপক্ষকে জানালেন এই পদের জন্য আইনস্টাইনই যোগ্য ব্যক্তি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও উপলব্ধি করতে পারলেন ফ্রেডরিখের কথার গুরুত্ব। অবশেষে ১৯০৯ সালে আইনস্টাইন পুরোপুরি শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করলেন এবং জুরিখে এসে বাসবাস শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার সুযোগে বহু মানুষের সাথে, গুণী বিজ্ঞানীদের সাথে পরিচয় হয়। ১৯১১ সালে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে তিনি যোগদান করেন। মাইনে আগের চেয়ে বেশি। অবশেষে দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত জুরিখের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক পেয়ে আইনস্টাইন ১৯১২ সালে প্রাগ ত্যাগ করে এলেন জুরিখে। এখানে তখন ছুটি কাটাতে আসা মাদাম কুরির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয় ।
সেই সময় বার্লিনে কাইজার তিলহেলম ইনস্টিটিউট নামে একটি বড় গবেষণাগার তৈরি হয়। সেখানে আইনস্টাইনকে যোগদানের জন্য আহ্বান করা হয়।

মহান বিজ্ঞানী স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন বার্লিনে এসে সবকিছু দেখে মুগ্ধ হলেন । শুধু গবেষণাগার নয়, বহু বিজ্ঞানীকেও কাছে পাওয়া যাবে ও একসাথে কাজ করা যাবে বলে ওখানে যোগদান করেন। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর ১৯১৪ নিজের শহরে ফিরে এসে পরিচিত মানুষজন ও দূরসম্পর্কিত বোন এলসাকে কাছে পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন। এলসার সান্নিধ্য বরাবরই মুগ্ধ করত আইনস্টাইনকে। অল্পদিনেই অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।।

গবেষণায় মনোযোগী হওয়ায় সংসারের প্রতি আসক্তি কমে যায়। স্ত্রী মিলেভার ক্রমশই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দুই ছেলেকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডে চলে গেলেন। কয়েক মাস কেটে গেল আর ফিরলেন না মিলেভা। প্রথম মহাযুদ্ধে বিজ্ঞানীদের অধিকাংশই জড়িয়ে পড়লেন । আইনস্টাইন এই যুদ্ধের বীভৎসতা এবং সংসারের একাকিত্ব, স্ত্রী-পুত্রকে হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সময় অসুস্থ আইনস্টাইন এলসার অক্লান্ত সেবা-যত্নে ক্রমশই সুস্থ হয়ে উঠলেন। শেষপর্যন্ত মিলেভাকে ডিভোর্স দিয়ে আইনস্টাইন এলসাকে বিয়ে করলেন। কাইজারের পতনের পর প্রতিষ্ঠা হলো নতুন জার্মান রিপাবলিকের। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রমানে এগিয়ে এলেন ইংরেজ বিজ্ঞানীরা। সূর্যগ্রহণের একাধিক ছবি তোলা হলো। সেই ছবি পরীক্ষা করে দেখা গেল আলো বাঁকে। অবশেষে ৬ নভেম্বর ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটিতে ঘোষণা করা হলো সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার, আলো বেঁকে যায়। এই বাঁকের নিয়ম নিউটনের তত্ত্বে নেই। আলোর বাঁকের মাপ আছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সূত্রে। আপেক্ষিক তত্ত্ব সত্যি বলে প্রমাণিত হয়।

অবশেষে এল সাধক বিজ্ঞানীর জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার। পদার্থবিজ্ঞানে Law of the Photo Electric Effect এর জন্য নোবেল পুরস্কার পান। আইনস্টাইনের তার প্রথমা স্ত্রী মিলেভার সাথে বিবাহবিচ্ছেদের শর্ত অনুসারে নোবেল পুরস্কারের পুরো টাকাটা তাকে পাঠিয়ে দেন।১৯৩০ সালের ডিসেম্বর মাসে বক্তৃতা দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অভূতপূর্ব সম্মান পেলেন। শুধু আমেরিকা নয়, যখন যে দেশেই যান সেখানেই পান সম্মান আর ভালোবাসা। এদিকে স্বদেশ জার্মানি ক্রমশই আইনস্টাইনের কাছে পরবাস হয়ে উঠেছিল। একদিকে তার সাফল্য স্বীকৃতিকে কিছু বিজ্ঞানী ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখতে থাকে, অন্যদিকে হিটলারের আবির্ভাবে দেশজুড়ে এক জাতীয়তাবাদের নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে একদল মানুষ। ইহুদিরা ক্রমশই ঘৃণিত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন জার্মানিতে থাকা তার পক্ষে মোটেই নিরাপদ নয়। কিন্তু কোথায় যাবেন? আহ্বান আসে নানা দেশ থেকে। অবশেষে স্থির করলেন আমেরিকার প্রিন্সটানে যাবেন। জার্মানি থেকে ইহুদি বিতাড়ন শুরু হয়ে যায়। আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন এবার তারও যাওয়ার পালা। প্রথমে গেলেন ইংল্যান্ডে। সেখান থেকে ১৯৩৪ সালের ৭ জুলাই রওনা হলেন আমেরিকায়। তখন তার বয়স পঞ্চান্ন বছর।

হিটলারের ইহুদী নিধন ও আগ্রাসীনীতিতে তিনি ক্রমশই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যতের কথা ভেবে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করছিল, দলমত নির্বিশেষে তিনি তাদের সমর্থন করলেন। যদিও জার্মানীর আগে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন বলে পরে আফশোষ করেন। শেষপর্যন্ত তিনি চেয়েছিলেন এই গবেষণা বন্ধ হয়ে যাক।অবশেষে ১৯৩৬ সালে চিরদিনের মতো প্রিয়তম আইনস্টাইনকে ছেড়ে চলে গেলেন এলসা। এই মানসিক আঘাতে সাময়িকভাবে ভেঙে পড়লেন আইনস্টাইন।

১৯৫০ সালে প্রকাশিত হলো তার নতুন তত্ত্ব A generalised theory of Gravitation। মহাকর্ষের সর্বজনীন তত্ত্ব। ১৯৫৫ সালের ১৮ই এপ্রিল তার জীবনাবসান ঘটে।তার ইচ্ছা অনুসারে মৃতদেহটা পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।