কলমের খোঁচা

‘গোরার ফিরে আসা’ — অর্ণব রায়


চিন্তন নিউজ:২৭/১২/২০২০— ভয়ঙ্কর নয়া কৃষি আইন বাতিলের জন্য বছরশেষের তীব্র ঠান্ডায় জীবন বাজি রেখে গত একমাস ধরে রাজধানীর প্রান্তে রাজপথকেই ঘর বানানো পাঞ্জাবী কৃষক হাতে তুলে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের “গোরা”।

মাসখানেক আগে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড: শুভঙ্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে দূরভাষে এক আলাপচারিতায় এল গোরার প্রসঙ্গ। সাহিত্যে কিছুটা আগ্রহী হলেও , প্রথাগত ছাত্র নই, তাই এই অসম আলাপচারিতায় আমি কিছুটা যেন বিব্রতও। রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনার বিবর্তন নিয়ে এক পুস্তিকায় নিজের এক দীর্ঘ নিবন্ধের কথা প্রাসঙ্গিক কারণেই উল্লেখ করছিলেন তিনি। জানালাম -“স্যার, পড়েছি আপনার লেখাটা।’ তিনি বলছিলেন – ” কবির এই বিবর্তন যাত্রার সীমারেখা…” । তাঁর কথার মাঝখানেই বলে ফেললাম – “গোরা। স্যার,আপনিই ত লিখেছেন -গোরার আগের রবীন্দ্রনাথ, গোরার পরের রবীন্দ্রনাথ– কবির ধর্মচিন্তাকে এভাবে দুই পর্বে ভাগ করা যেতে পারে । ” বললেন – “গোরা পড়েছ নিশ্চই” । বললাম – “তিনটি প্রিয়তম উপন্যাসের নাম বলতে বললে , একটি অবশ্যই “গোরা” । প্রাজ্ঞ শিক্ষক প্রশ্ন করলেন , “একটি বাক্যে “গোরা”র দর্শন যদি বলতে হয়, কি বলবে ?” কঠিন প্রশ্নে , উপন্যাসটির নির্যাস যা বুঝেছি এক লহমায় জড়ো করে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম দুটি শব্দে – “আমি ভারতীয় “। দূরভাষের অন্য প্রান্তে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক , মনে হল, পাশ-মার্ক দিলেন। এক রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ প্রাক্তন উপাচার্যের সঙ্গে এক সাধারণ রবীন্দ্রঅনুরাগী আমার কথোপকথনটির এই অংশ হঠাৎ মনে করিয়ে দিল আজকের এই ছবিটি ।

রবীন্দ্রনাথ নিয়ে দেশের সরকারের প্রথম ও দ্বিতীয় জন ইদানীং অবান্তর কথা বলে চলেছেন । হিন্দুধর্মের বহু ঐতিহাসিক অন্যায়ের মধ্যেও যে বৈচিত্র্যের প্রকাশ তার বিরুদ্ধে এক মনোলিথিক ভারতবর্ষের উগ্র হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচীতে যারা বেপরোয়া , তারা আজ বাংলার শাসকসৃষ্ট বিভ্রান্তির জমিতে বাংলা দখলের দামামা বাজাচ্ছেন।‌ তারা চাইছেন তাদের ভোট-অভিমুখী হঠাৎ রবীন্দ্রপ্রেমকে প্রমাণ করতে , কিন্তু হারিয়ে ফেলছেন কবির সম্পর্কে ণত্ব-ষত্ব বোধও ।‌ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হাস্যকর অনৈতিহাসিক কথা বলেছেন কয়েকবার , রাজ্যপ্রধানও– তবু দুঃখপ্রকাশ‌ করেননি একবারও। অন্তরে বিভেদের ঘৃণা নিয়ে বা ইতিহাসজনিত পল্লবগ্রাহিতা দিয়ে বা কপটতার পথে রবীন্দ্রনাথকে যে বোঝা যায়না , তা আমরা বুঝি।‌ তাই, তাদের রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ অর্বাচীনতা ছাড়া কিছু মনে হয় না। কিন্তু দেশের অন্নদাতারা মাটি কামড়ে মরণপণ সংগ্রামের মধ্যেও রাস্তায় বসেই যখন পড়তে শুরু করেন অনূদিত ” গোরা” – আমরা সত্যিই উজ্জীবিত হই।

উপন্যাসের শেষ লগ্নে এক নাটকীয় মোড় পরিবর্তনে গোরার উপলদ্ধিতে আসে, “হিঁদুয়ানী” র গোঁড়ামি পেরিয়ে সে একজন মুক্তপুরুষ । সে তখন অনুভব করে বহুত্ববাদী ভারতের মর্মকথা – ” আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান কোন সমাজের কোন বিরোধ নেই । আজ এই ভারতবর্ষের সকল জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন ।” আর, সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দুজনেরই অব্যক্ত প্রেমকে বাঙ্ময় করতে ব্রাহ্ম সুচরিতার হাত সে ধরে।

শহীদের মৃত্যুঞ্জয়ী আজকের অভূতপূর্ব কৃষক আন্দোলনকে খালিস্তানী , পাকিস্তানি তকমায় বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন, কৃষিকে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মৃগয়াক্ষেত্র করতে উদগ্র সাম্প্রদায়িক শাসকরা। পারেননি।‌ কারণ আন্দোলনবদ্ধ কৃষকরা জানেন তাদের ভারত-বোধ । তাই তাদের হাতে হাতে ঘুরছে “গোরা” উপন্যাসের পাতাগুলি। এক বিশ্ব-মনীষার চেতনায় একশ দশ বছর আগে সৃষ্টি করা গোরা আজ নেমে এসেছে পথের মরণপণ আন্দোলনে । যে আন্দোলন জাতধর্মের ঊর্ধ উঠে দেশের ভবিষ্যতকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে চাইছে।‌ গোরার এই পরিক্রমা চিনিয়ে দিচ্ছে তাই ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞাও।

আজকের বাংলায় যে রাজনৈতিক- ধর্মখেলোয়াড়, প্রতারক , ক্ষমতামদমত্তদের লোকদেখানো পারস্পরিক নাটকের বিজ্ঞাপন, তাদের উভয়ের বিরুদ্ধেই বহু ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ আজ এক বড় আয়ুধ- গোরা তার এক উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোন। রাস্তাকেই রাস্তা চিনে পঞ্চনদের তীরের অধিবাসীরা গোরার ফিরে আসার বার্তা কি পাঠিয়ে দিলেন আজকের কিছুটা দিশেহারা রবীন্দ্রজন্মভূমিতেও !!


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।