জেলা

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, একজন বিপ্লবীর নাম :-


প্রতিবেদক :মধুমিতা রায়: চিন্তন নিউজ:৬ই জুন:– গতকাল ৫ ই জুন জন্মদিন ছিল ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা’র । দিকে দিকে যখন ফ্যাসিবাদী শক্তির দৃপ্ত পদচারণা এমন সময় বিপ্লবী কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা র রচনা ও তাঁর জীবনদর্শন ভারতের বুকেও সমান প্রাসঙ্গিকতা বহন করে। ১৮৯৮ সালের ৫ ই জুন স্পেনের ফুয়েন্তে ভ্যাকুয়ারসে জন্মগ্রহণ করেন ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা।
বাবা’ ফেডারিকো গার্সিয়া রডরিগেজ ছিলেন বিত্তশালী কৃষক ।” মা ” ভিসেন্তা লোরকা রোমেরিও যিনি পেশায় স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন , এছাড়াও খুব ভালো পিয়ানো বাদকও ছিলেন।

মা’ র কাছ থেকেই তাঁর সঙ্গীত চর্চার হাতে খড়ি। পায়ের দুর্বলতার কারণে অন্যান্য শিশুদের মতো বাইরের খেলা ধূলার জগতে তার বিচরণ ছিলনা। তাই অল্প বয়স থেকেই একাকীত্বের সঙ্গে জীবন যাপন করাতে , সঙ্গীত ও লেখার জগৎকে বেছে নিতে সক্ষম হয়। ১৯১৬ সালে তিনি তাঁর প্রথম ভ্রমণমূলক রচনা ইম্প্রেশনস্ এন্ড ল্যান্ডস্কেপস
(” Impressions and Landscapes” ) লিখে ফেলেন। মধ্য তিরিশেই তিনি তাঁর কলমকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলতে সক্ষম হন। ১৯১৯ -১৯২০ সালে তিনি তাঁর প্রথম নাটক দ্য বাটারফ্লাইয়েস এভিল স্পেল “The Butterfly’s Evil Spell ” নামে একটি নাটক লেখেন , যা মঞ্চস্থ হবার পর প্রচুর সাড়া পড়ে। এর পর তিনি আরোও কয়েকটি নাটক লিখে নাট্যকার হিসেবে ও সুনাম অর্জন করেন।

১৯৩০ সালে স্পেনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হ’লে লোরকা দেশে ফিরে আসেন। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর বামপন্থী প্রশাসকেরা স্পেনের পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন । ভূমিহীন কৃষকদের জন্য , শ্রমিকদের হাতে এলো কলকারখানার চালিকা শক্তি, নারীদের অধিকার প্রদান, শিক্ষা ব্যবস্থা ক্যাথলিক প্রভাব মুক্তকরণ, এসবই জনকল্যাণমূখী কাজ শুরু হয়। লোরকা তখন দেশে ফিরে আসেন এবং “বাররাকা” নামক নাট্যবিষয়ক সংস্থার পরিচালক পদে যোগ দেন। ব্লাড ওয়েডিং , ইয়েরমা, দ্যা হাউস অব বারনারদা , অ্যালবা ইত্যাদি ছিল তাঁর রচিত বিখ্যাত নাটক। এই নাটকগুলিতে বুর্জোয়া স্পেনীয় সমাজের রীতিনীতি গুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সত্ত্বার প্রকাশ ঘটায়। লোরকার মতে তাঁর রচিত প্রথম নাটক “মারিয়ানা পিনাদা” এবং প্রথম কবিতার বই ” লিব্রো দে পোয়েমাস ” । সঙ্গীত জগতেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। ১৯২২ সালে স্পেনের “কনকারসো ডে ক্যান্টো যন্ডে” তে যোগ দেন , যা ছিল প্রথিতযশা শিল্পীদের উৎসব। এর পর ” সাতাশের প্রজন্ম ” নামে শিল্পীসংঘে যোগ দিলে সেখানে সালভাদর দালি ও লুইস বুনুয়েলের মতো বিখ্যাত শিল্পীদের সান্নিধ্যে আসেন। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তাঁর কলমকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলতে সক্ষম হন। তার লেখার মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবন দর্শন ফুটে ওঠে।ফুটে ওঠে জিপসি, ষাঁড়ের লড়াই , থেকে স্পেনীয় সংস্কৃতির ছবি ও। ধর্মীয় মৌলবাদ থেকে তার একাকীত্ব, প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ ধরা পড়ে তাঁর লেখনীতে। এককথায় বলা যায় স্পেনের সমাজ ব্যাবস্থা , তার সংস্কৃতি , প্রতিবাদী চিন্তা ভাবনা, প্রগতিশীল কৃষ্টি সব কিছুর মেলবন্ধন পাওয়া যায় তার কবিতায় , গানে, গদ্যে, নাটকে , সঙ্গীতে ।

তাঁর রচিত নাটকে বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ধ্বনিত হয়। তাঁর রচনায় ধর্মীয় কুসংস্কার, শ্রেনী, নারীর অধিকার, যৌনতার প্রসঙ্গ ঠাঁই পায়। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ” সোনেতাস দে আমোর অস্কুরো বা তামসিক প্রেমের সনেট রচনা যা সমকামী ভালোবাসা নিয়ে রচিত , তৎকালীন সমাজে যা সামাজিক বিপ্লবের নামান্তর। মানুষের যন্ত্রনা দূঃখ কষ্ট লোরকা কে ভাবায় । নিগ্রো, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি নির্যাতন তাঁর রচনায় ধরা পড়ে। লোরকার রচনায় তার একাকীত্ব নজর কাড়ে। কৈশোর বয়সে এসে প্রেম সম্পর্কে লেখেন …“ চরিতার্থ হওয়া সম্ভব নয়”। চিন্তা চেতনায় সমতার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কবি লোরকা ব্রাজিলের কম্যুনিস্ট নেতা লুইস কার্লোস প্রেসতেস এর মুক্তির দাবিতে সোশ্যালিস্ট জমায়েতে কবিতা পাঠ করেন। বামপন্থীদের বিভিন্ন সমাবেশে তাঁর উপস্থিতি স্পষ্ট করে তাঁর বামপন্থী মতাদর্শ। তিনি স্পষ্ট ভাষায় দেশ ও জাতির দূঃসময়ে শিল্পীর দায়িত্ব সম্পর্কে সকলকে সচেতন হবার আহ্বান জানান। তিনি লেখেন “ যতদিন পৃথিবীতে আর্থিক অসাম্য থাকবে ততদিন চিন্তার মুক্তি নেই” । মে দিবসের শুভেচ্ছা অভিনন্দন বার্তা পাঠান স্পেনীয় শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে। ফ্যাসিবাদের উন্মন্ততা রুখতে লোরকা বামপন্থীদের সাথে ছিলেন সবরকমভাবে। রুশ বিপ্লবে তাঁর উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তাঁকে ”সোভিয়েত রাশিয়ার বন্ধু” আখ্যা দিয়েছেন, তাকে“ লাল বুদ্ধিজীবী” বলে প্রচার করা হতে থাকে। এই সময় সারা বিশ্বে তার নাম অনুরণিত হচ্ছে গুণী শিল্পী সঙ্গীতজ্ঞ নাট্যকার হিসেবে। ঠিক এই সময়েই ১৯৩৬ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত। একদিকে রিপাবলিকানরা আর অন্য দিকে ফ্রাঙ্কো র সাথে হিটলার, মুসোলিনি। এক অসম লড়াইয়ে হার মানলো রিপাবলিকানরা।ফ্যাসিবাদী চরিত্রের জঘন্য রূপ দেখলো দুনিয়া। সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ পাবলো পিকাসো থেকে রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মুখর হলেন। বিশ্বের ৫৪ টি দেশ থেকে ৩৫ হাজার ভল্যানটিয়ার্স এই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন, যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছিলেন কম্যুনিস্ট। যা ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড নামে খ্যাত। এই গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে কিউবা মেক্সিকোতে মঞ্চস্থ হচ্ছে তার নাটক, প্যারিস বেতারে সম্প্রচারিত হচ্ছে ইয়ের্মা ।

দেশের মাটিতে জনগণের মুগ্ধতা তাকে ঘিরে। সারা বিশ্ব তখন প্রত্যক্ষ করলো ফ্যাসিবাদী চরিত্রের ভয়াবহ রূপ। ফ্রাঙ্কো র নেতৃত্বে হিটলার মুসোলিনির সহায়তায় স্পেনের রিপাবলিকান সরকারের পতন ঘটলো। এর পর থেকে শুরু হলো বামপন্থী মতাদর্শের কারনে ক্রমাগত উক্ত্যক্ত, দমন-পীড়ন করা। বিভ্রান্ত হয়ে কবি বন্ধু লুইসের আশ্রয়ের শরনাপন্ন হন। আর সেখানেই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। দিনটি ছিল ১৬ ই আগস্ট। আর দু’দিন পর ১৮ ই আগস্ট এক ফাঁকা মাঠে তার রক্তাক্ত শরীর ফেলে দিয়ে গেল ফ্যাসিস্ট ঘাতক বাহিনী। নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি, ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয় তাঁর শরীর। সারা বিশ্ব শিউরে ওঠে লোরকার মৃত্যুতে। মৃতদেহ কোথায় তা আজোও কেউ জানতে পারেনি। লোপাট করে দেওয়া হয়েছিল তার মৃতদেহ পর্যন্ত। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি লিখেছিলেন …“ একফোঁটা হাঁসের রক্তের /
বহুগুনিতাঙ্কের নিচটাতে/…
কোমল রক্তের এক নদী/
যে নদী গান গেয়ে বয়ে চলে /
মহল্লার যত শয্যাঘর একে একে পিছে ফেলে/
পিছে ফেলে নিউইয়র্কের যত নকল ভোরের /
সিমেন্ট, বাতাস টাকাকড়ি ”..।

কোনো মৃত্যু কেড়ে নিতে পারেনা লোরকা’দের । তাই মৃত্যুর একশো বছর পরে ১৯৯৮ সালে আবারও তার রচনা, তাঁর মৃত্যু রহস্য, তার মৃতদেহ উদ্ধার করার আবেদন করা হয় দেশবাসীর পক্ষ থেকে। আজ ভারতের বুকেও ফ্যাসিবাদের করাল থাবা । আর তাই আজো প্রগতিশীল মানুষের কাছে সমান প্রাসঙ্গিকতা বহন করে ফেদিরিকো গার্সিয়া লোরকা।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।